হাতের রেখায়-পর্ব ২

রেজওয়ানা কবির ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, সোমবার, ০১:৪৪:৪২অপরাহ্ন গল্প ৬ মন্তব্য

এই ছেলে এত সিগারেট খাচ্ছেন কেন? আজ না আমাদের ফুলশয্যা আসুন ! আমরা কতদিন এই রাতটার জন্য অপেক্ষা করেছি,ভুলে গেছেন ? শুনতে পাচ্ছেন কত সুন্দর গান বাঁজছে আহা!

এই রাত তোমার আমার,,,

এই চাঁদ তোমার আমার শুধু দুজনার,,,

দারুন! বাইরে কি সুন্দর জোস্না! জোস্নার এই আলোতে তোমায় দেখতে রক্তিম সূর্যের মত লাগছে। মনে হচ্ছে একেবারে এক নিমিষেই এই আলো শুষে নেই।

কি হলো ! এসো তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। রাত অনেক হয়েছে,এভাবে শুধু সিগারেট খেলেতো রাত তাড়াতাড়ী শেষ হয়ে যাবে । এবার টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দাও,দেখো এই লাল আলোয় তোমায় ছুঁয়ে তোমাতে আমাতে গল্পে মিশে গেলে কত ভালো লাগবে ? কি হলো! ওভাবে মিষ্টি করে হাসছো কেন? তুমি জানো না তোমার এই ইনোসেন্ট হাসিতে আমি ডুবতেই থাকি। ফুলশয্যা প্রত্যেক মানুষের জীবনেই খুব কাংখিত তাই না? কত গল্প জমা হয়ে আছে তোমাকে বলার। তোমার কপালে চুমু এঁকে দিবো আসো না আর সিগারেট খেও না প্লিজ। এই ছেলে,তুমি না রোমান্টিকতা খুব পছন্দ করো ! তুমি প্রকাশ করতে না পারো তো কি হয়েছে আমি কিন্তু বহুত রোমান্টিক। দাঁড়াও তোমার জন্য চা করে নিয়ে আসি। এরপর চায়ে চুমুক দিয়ে মুখোমুখি বসে তোমাতে চুমুক দিয়ে তৃষ্না মেটানোর পালা।কি ভাবছো! জানো, আমার বান্ধুবীরা বলে এই রাতেই নাকি বিড়াল মারতে হবে বুঝলে🥰।

টপ করে শব্দে রাজ চোখ মেলে দেখলো একটা কালো কুৃচকুচে বিড়াল টেবিলে রাখা দুধের গ্লাস ফেলে দিয়ে গেল।

কোথায় এখন রাজ? কোথায় সেই ফুলশয্যা আর কোথায় এখন সে ? তার মানে ক্লান্তিতে খানিকটা চোখ বুজে গিয়েছিল রাজের। আর এইসময়ে স্বপ্নগুলো ডানামেলে একসাথে মনের আনন্দে স্বাধীনভাবে ভর করেছিল ? কি সুন্দর ফুলশয্যা ! রাজ তো এরকম একটি রাতই চেয়েছিল,বেশি কিছু কি চেয়েছিল?

সামনে তাকাতেই, এই মেয়েকে কাল রাতে বিয়ে করেছি! যেকিনা আমার সুন্দর বিছানায় হাত পা ছাড়িয়ে দিব্বি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। মেয়ে মানুষ ও যে এভাবে বিচ্ছিরিভাবে নাক ডাকতে পারে তা রাজের জানা ছিল না। তবে বিচ্ছিরিভাবে নাক ডাকলেও মেয়েটির মুখে বাইরের জোঁস্না এমনভাবে মেঁখে গিয়েছে যে মুখখানা মায়ায় জোঁস্নার সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

এই যে শুনছেন,,,,

আরে বাবা কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে!

আরে বাবা ভোর হয়ে গেছে উঠুন, আমাকে একটু জায়গা দিন, আমি একটু ঘুমাবো।

ধরমর করে মেয়েটি ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতেই ও আল্লাহ ! ভোর হয়ে গেছে ! আমারতো এবার যেতে হবে!

কি ! কোথায় যেতে হবে?

আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।

এখন আমার সময় নেই, সারা রাত ঘুমাইনি আপনি সোফায় ঘুমান। পরে শুনবো বলতেই রাজ এই প্রথম রিনির দিকে ভালোভাবে চোখ পড়তেই দেখল মেয়েটির চোখগুলো তে তো দারুন মায়া!

আমার এখনি বলতে হবে, আমি ভোরের অপেক্ষায়ই কখন ঘুমিয়ে গেছি  যে,,,

রাজ ভাবতে লাগল যাক বিয়ে হয়ে গেছে, রাজের সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে তবুও মেয়েটি হয়ত তার হাতের রেখায়ই লেখা ছিল,মেয়েটির মায়াভরা সেই চোখে ডোবার চেষ্টা করাতো যেতেই পারে।

শুনুন আমি সরি, আমায় মাফ করে দিয়েন।

কেন?

আমি আসলে এই বিয়েটা করতে চাই নি।

কি???( রাজ বিয়েটা  নিজেই মেনে নিতে পারছে কি না নিজেও জানে না আর এই মেয়ে বলে কি?)

জ্বি। আসলে আমি অয়ন নামে একজন ছেলেকে ভালোবাসি। কিন্তু বাবা মা কোনভাবেই আমার কথা শোনেন নি। আমি কাল অয়নের সাথে পালিয়ে যাবো ভেবেই বাসায় ধরা খাই তাই আমার সবকিছু উপেক্ষা করে বাবা কাল সারাদিন আমায় বন্দি রেখে আপনার সাথে জোর করে  বিয়ে দিয়ে দেয়। আমি কোনভাবেই আটকাতে পারিনি।

রাজ কি শুনছে কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না। কান দিয়ে শুধু শোঁ শোঁ শব্দ বের হচ্ছিল।

শুনছেন,,,, কিছু বলেন,,,

দেখেন আমাকে কোন সিনেমার ডায়ালগ দিবেন না। বিয়েটা কোন ছেলেখেলা নয়। আমি নিজেও আপনায় বিয়ে করতে চাই নি।  শুধুমাত্র মায়ের কথা শুনে,, আর আপনি এখন এইসব কি বলছেন?আমাদের পরিবার, সমাজ এইসব একবারও চিন্তা করেছেন? আর যদি তাই করবেন তবে আপনার বাবাকে বাধ্য করতেন? আমার জীবন শেষ করে দিবেন নাকি?(রাজ আবার সিগারেট ধঁরালো,এবার রাজের সিগারেটে আগুন জ্বালাতে হাত বিমর্ষভাবে কাঁপছিল। )

আমি সরি, প্লিজ বুঝুন। অয়নের সাথে আমার ৭ বছর সম্পর্ক। আমি কোনভাবেই ওকে মনে রেখে আপনার সাথে সংসার করতে পারব না। আর যদি তাই হয় তবে আমার সুইসাইড করা ছাড়া কিচ্ছু উপায় থাকবে না। আমি চাই না আপনার আর কোন ক্ষতি হোক।

তো এখন কি করতে চান?

অয়ন আপনার বাসার সামনে রাত থেকে অপেক্ষা করছে,আমি এখান থেকে বের হয়ে সকাল ৭ টায় চিটাগাং এর ট্রেন ধরবো। তারপর ৩ মাস হয়ে গেলে আপনায় ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবো।

জীবন কি এত সহজ? আমি যদি না যেতে দেই? আগে উত্তর দেন, আমিতো আপনার কোন ক্ষতি করিনি। কেন এমন করলেন? আবার শুরু করা যায় না নতুন করে। চেষ্টা তো করাই যেতেই পারে!

দেখেন প্লিজ আমায় মুক্তি দিন। পারলে মাফ করে দিয়েন, আসি।।।।।

রাজ কি বলবে বুঝতে পারল না, চোখের সামনে দেখল তার বাসর রাতে বিয়ে করা বউ যার সাথে নাকি সারাজীবন কাঁটাবে ভেবে জীবনের সব স্বপ্ন এক নিমিষেই বিসর্জন দিয়ে নতুনভাবে  নিজেকে  প্রিপেয়ার্ড করছিল মেনে নেয়ার। আর সেকিনা এভাবে চলে যাচ্ছে? একবারও তাকে আঁটকাতে পারছে না, কোন জোড়ে তাকে আঁটকাবে? শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। মানুষের জীবন এমনও হয়? রাজ কি এইটা ডিজার্ভ করে?কিছু মানুষের অতিরিক্ত টেনশনে অসময়ে গভীর ঘুম পায়। রাজ সেরকমই টেনশনে গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল।

পরদিন সকালে গ্রামের সবাই নতুন বউ দেখতে এসে পুরো বাড়ী  হৈ হৈ করে উঠল,যে নতুন বউ পালিয়েছে। রাজ সহ তার পরিবার বাড়ী থেকে বের হতে পারছিল না সমাজের কু সমালোচনার ভয়ে।

এরপর রাজ নিজের ভিতর দুমরে-মুচড়ে আবার রাজশাহী চলে যায় পড়াশুনার জন্য। কিন্তু কিছু মানুষের জন্য মাঝে মাঝে এতসব পরীক্ষা জীবনে দিতে হয় যে মানুষটা তখন বুঝে উঠতে পারে না,বা বুঝলেও চাইলেই নিজের মত করে পরিস্থিতি বদলাতেও পারে না। রাজের ক্ষেত্রেও তাই হলো।

রাজেরা অনেক ভাইবোন হওয়ায় তার প্রায় পড়াশুনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম।  রাজের পরিবারে দুবেলা খাওয়াটাই তখন অনেক বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার উপর এতগুলো ভাইবোনের পড়াশুনা, রাজের মা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল সেইসব পরিস্থিতিতে।

অপরদিকে রাজের শ্বশুর মশাই রাজের বাসায় এসে অনেকভাবে মেয়ের অপকর্মের জন্য হাতজোঁড় করে ক্ষমা চায়, আর লজ্জায় সংকোচে রাজের জীবনের পুরো দায়িত্ব নিতে চায়। তার শ্বশুরের আরও দুটি মেয়ে আছে,তিনি রাজের মামাকে কনভিন্স করে যে তাদের যে মেয়েকে পছন্দ তার সাথেই আবার রাজের বিয়ে দিতে চায়।

রাজের মামা সবদিক বিবেচনা করে। রাজের জীবনের প্রথম ঘটনার জন্য মামা নিজেকে দায়ী মনে করে রাজের যেন পড়াশুনা নামক বাকি স্বপ্ন আর নষ্ট না হয় ভেবে শ্বশুরের দ্বিতীয় মেয়ের সাথে রাজের বিয়ে দেবে বলে কথা দেয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তিনমাস যেদিন শেষ হবে সেদিন দুটো খাতায় সাইন করলেই হবে, এক ডিভোর্স লেটার আরেক নতুন বিয়ে রেজিষ্ট্রি।

কিছুদিনের মাঝেই রাজের মায়ের অসুস্থতার কথা চিঠিতে জেনে আবার রাজশাহী থেকে রাজ বাড়ীতে আসে। এসেই সে তার আবার বিয়ের কথা শোনে। রাজ অবাক! এখনো সে সেই ক্ষত জায়গায় মলম লাগাতেই পারেনি, তাতেই কাঁচা ঘা আরও দগ্ধ করবে! তাও আবার একই বাড়ীর মেয়ে? এখনো তো ডিভোর্স ও হয় নি। এবার যাইহোক রাজ আর রাজী হবে না।

বিয়ে নাকি মানুষের হাতের রেখায় লেখা থাকে, তিনমাসও হয়নি তাতেই কি রাজের হাতের রেখা পাল্টিয়ে নতুন রেখা উঠছে নাকি? যে আবার বিয়ে করতে হবে? মানুষের এক হাতের রেখায় কত বিয়ে লেখা থাকে? তবেতো সবার ঘরে ঘরে এক জনেরই  অনেক বউ থাকত!

একদিকে রাজের উপর গোটা পরিবার নির্ভর। সবাই চাঁতকপাখির মত চেয়ে আছে রাজের দিকে, কখন রাজের পড়াশুনা শেষ হবে আর কখন রাজ ভালো একটা জব করে সংসারের হাল ধরবে? রাজের মায়ের অসহায় মুখখানা আর সে দেখতেও পারছে না।

অন্যদিকে রাজ টিউশনিরও চেষ্টা করেছে কিন্তু তাও সহজ নয়। আর কবে টিউশনি পাবে সেটাও জানে না, এদিকে ৩ মাস থেকে বাসা থেকে তার কোন পড়াশুনার খরচ দিতে পারছে না,এলাকার সবাই তার প্রথম বিয়ে নিয়ে ছি ছি করছে, সবমিলায়ে  কিভাবে রাজ পড়াশুনা শেষ  করবে, কিভাবে মায়ের বা পরিবারের দায়িত্ব নিবে??

কথায় বলে, মেয়েরা জন্মগতভাবেই বেশি আবেগপ্রবন বলেই  যেকোনো পরিস্থিতে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে অতি সহজে কান্না করে নিজেরা হালকা হতে পারে।

ছেলেরা মেয়েদের বিপরীত,তারা যত কঠিন পরিস্থিতিই হোক না কেন মেয়েদের মত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে পারে না, তবে আবেগে  ভিতর ভিতর অতিরিক্ত দহনে নিজে নিজে এমনভাবে জ্বলতে, পুঁড়তে থাকে যে পোঁড়ায় নিজে নিজে ছাই হয়ে যায় তবে সেই ছাইয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না,চোখে দেখা যায় না। সেইসময়  সিগারেট ও সেই পরিস্থিতির কাছে ম্লান হয়ে যায়।

রাজ পূর্বের ন্যায় তার প্রিয় জায়গা নদীর পাড়ে গিয়ে একা বসে পর পর সিগারেট ধরিয়েই যাচ্ছে। ধোঁয়াও উড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিতে কিন্তু সিগারেটের কোন স্বাদ আজ আর রাজ খুঁজে পাচ্ছে না।রাজের বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই রাজ খারাপ লাগলেই এই নিরালয়ে গভীর রাতে বাবাকে খুঁজতে, বাবার সাথে গল্প করতে এখানে আসে। বাবার কথা খুব মনে পড়ছে 😭।

খোলা আকাশে হারিয়ে যাওয়া বাবার কাছে রাজ উপায় খুঁজতে আজ এখানে এসেছে?? এবার কি করবে রাজ? আবার বিয়ে? নাকি অন্যকোন উপায়।।।।।

চলবে।।।।।

ছবিঃ নেট থেকে।

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ