হাওর বন্দি

মাসুদ চয়ন ৭ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ০৩:০৬:১৮অপরাহ্ন গল্প ১৬ মন্তব্য

(প্রথম পর্ব)
আজ আষাঢ়ের ১৪ তম প্রহর_ আমাদের নববিবাহিত জীবনের তৃতীয় দিন।
পারিবারিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে বিয়েটি সংঘটিত হয়েছে।মেয়েটিকে আগে কখনো দেখিনি।এ জন্য বিয়ের দিন মন খারাপ ছিলো।ভীষণ রকম অস্থিরতা কাজ করছিলো। একরকম জোর করেই বিয়ের আসরে নিয়ে গিয়েছিলো।একদিকে না যাওয়ার জবরদস্তি আরেকদিকে চার পাঁচজনের টানা হ্যাঁছড়া।
খুব উদাসীন ঘরানার মানুষ আমি।একবার বাড়ি ছাড়লেই বহুকালের জন্য নিরুদ্দেশ।
কখনো ৫/৬ মাসো অতিবাহিত হয়ে যায়।তাই এমন সিদ্ধান্ত।তাদের ধারণা_বউকে একা রেখে কোথাও পালাতে পারবেনা ছেলেটা।ছেলে কি আর কারো কথায় থোড়াই কেয়ার করে!
সে একজন বিপ্লবী ব্লগার-শিরা উপশিরায় রক্তের ওম ভেসে বেড়ায়।
মৃত্যুর কাছে মাথা নুয়ে দেয়ার মতো ছেলে নয়।চোখে মুখে একটি চিত্রই ভাসে সবসময়-স্বাধীনতা,মুক্ত চেতনা।সভ্যতার ভয়াল অন্ধকার দূর করার জন্য চলছেই নিবিড় প্রয়াস।চারদিকে শত শত আক্রমনকারী।কখন যে কে এসে কিভাবে হামলে পড়বে।মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বিপরীতে অবস্থান নেয়।স্বৈরশাসন নিয়ে কথা বলতে মানা।বাকি সব নির্ভয়ে চালিয়ে যাও।

তাই ডাক এলেই নিরুদ্দেশ হয়ে যাই।গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হয় মাঝে মাঝে।মূল অপারেশন শুরু হতে এখনো কয়েক মাসের অপেক্ষা।বিপ্লবীদের রক্তে আবারও রাজপথ ভেসে যাবে।আবারও মুক্তির কেতন উড়বে।স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি।
মিন্নিকে প্রথমবার দেখার পর এক অন্যরকম শিহরণ বয়ে যেতে শুরু করলো হৃদয়ে।ভীষণ লাজুক মেয়ে,আমারো লাজুক মেয়ে ভালো লাগে।লাজুক মেয়ে দেখলেই প্রেমিক হয়ে ওঠার ইচ্ছে জাগে।
লাল টকটকে মুখখানা নিয়ে মাথা নিচু করে বসে ছিলো।কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছিলামনা।প্রচন্ড রকম ভালোলাগা কাজ করতে শুরু করলো।প্রেমতো এমনই-প্রেম মানে মুগ্ধতাকে কাছে পাওয়ার প্রয়াস।আমিও সেই প্রাপ্তিকে কাছে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম।

--অবশ্য তা আর হয়ে উঠলো কই।মধুর মিলনটাই হয়ে উঠলোনা। বিয়ের দিনের গল্প বলছি_রাত তখন সোয়া ১০ টা।
বাসর ঘরে প্রবেশ করার পর থতমত খেয়ে গেলাম_মিন্নিকে ভেবে ঘোমটা তুলেই দেখি অন্য এক রমনী।আমার দুষ্ট বড় ভাবী।নতুন বউয়ের মতো সেজেগুজে অপেক্ষারত।উদ্দেশ্য আমাকে চমকে দেয়া। মাথায় হাত চেপে ভাবীর পাশে বসে পড়লাম।ফাইজলামির একটা সীমা আছে বুঝলা!আমিতো লাইট নেভায় দিতে চাইছিলাম।
কি যেনো ভেবে জ্বালিয়েই রাখলাম।বিরক্ত করছো ক্যান ভাবি!মিন্নিকে পাঠিয়ে দাও।
ভাবী,আমার কানটা শক্ত করে চেপে ধরলেন।
আহারে!দেবর আমার!
এবার আটকা পড়ে গেছে বউ বাঁধনে।হ্যাঁ হ্যাঁ,পাঠায় দিচ্ছি।মেয়েটাকে একটু দেখে রাখিস ভাই।ওর শরীরটা ভালো নেই।বেশ ভালো রকমের জ্বর।
আজ একটু রেহাই দিস বউকে।সারাজীবন তো কাছে পাবি।

মিন্নিকে পাশে বসিয়ে রেখে যে যার মতো অদৃশ্য হয়ে গেলো।ভাবী ড্রিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে মেইন লাইট অফ করে দিলেন।
কি এক আজব সিস্টেমের বাড়ি!এক বোর্ডেই পুরা বাড়ির সুইচ-তাও আবার আউটডোরে!
মিন্নির লজ্জাতূর মনোভাব আরও গভীরভাবে ঘনীভূত হচ্ছিলো।ঘোমটা সরিয়ে কপালে হাত রেখেই চমকে উঠলাম।
আহারে!অনেক জ্বর!তুমি শুয়ে পড়ো মিন্নি।আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি-
অনেক পেইন হচ্ছে তোমার তাইনা?
ও আমার হাতের আঙুল টেনে ধরলো।মৃদু স্বরে আওয়াজ তুললো।না,থাক।সকালে যাবেন প্লীজ।আমি ট্যাবলেট খেয়েছি।জ্বর কিছুটা কমেও গিয়েছে।
এখন বাহিরে গেলে বাড়ির সবাই হাসাহাসি করবে।
এরপর ওকে শুইয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে থাকলাম।
তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো।অনেক ঘেমে গেছো।শাড়িটা চেঞ্জ করলে আরাম পেতে।
মিন্নি আধো খোলা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
প্রতি উত্তরে কিছুই বললোনা।
মাঝে মাঝে চোখের ভাষা পড়ার অভ্যেস আয়ত্ব করা উচিৎ।না হলে জীবনের পাঠ চক্রে পরিপূর্ণতা আসেনা।

বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছে সময়ের তালে তালে।
কি মহান মানুষ আমি!
আজ তো বাসর রাত।আর আমি কিনা তাহার সেবায় নিমগ্ন।
মিন্নি হয়তো এমন কিছুই ভাবছে।
এভাবে তিন তিনটি রাত অতিবাহিত হয়ে গেছে।
দৌহিক মিলনটা হয়ে ওঠেনি।
বউ এখন পুরোপুরি সুস্থ।তাই পরিবারের সিদ্ধান্তে হানিমুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা।গন্তব্যস্থান নাটোরের চলনবিল।মিন্নির খুব ইচ্ছে ওখানে যাওয়ার।প্রেয়সীর ইচ্ছে বলে কথা।রাজি না হয়ে কি পারা যায়।
দু'জনে প্রস্তুত হলাম।মেঘলা আকাশ গুড়ুগুড়ু ধবনিতে  ডাকছে।

৫ ঘন্টার যাত্রা শেষে নাটোরে এসে পৌঁছলাম।এখন দুপুর দুটা।সন্ধ্যায় রিসোর্ট বুকিং করতে হবে।তার আগে একটু ঘুরাঘুরি করে নিতে ইচ্ছে হলো।এরপর আরও বেশ কয়েক সপ্তাহ পাওয়া যাবে।

একটা ডিঙি নৌকা ভাড়া করতে চাইলাম।মিন্নি সায় দিলোনা।ও বিলের তীর ঘেঁষে হাঁটতে চায়,বসে থেকে উপভোগ করতে চায় সবুজ আর জলো বৈচিত্র।
পানির গভীরত্বকে প্রচন্ড রকম ভয় পায় ও।
এই যে বর সাহেব-আমার আঙুল সবসময় শক্ত করে ধরে রাখবেন।আমি কিন্তু উপভোগ করবো মুক্ত বিহঙ্গের মতো।আমার কিশোরী বয়সের স্বপ্ন এটা।বরকে নিয়ে নির্জনতায় হারিয়ে যাওয়ার। পিছলে পড়লে তোমার দোষ-বুঝলে বর বাবু।
ও নিয়ে ভেবোনা মিন্নি।ভয়টা তো অন্য কিছু নিয়ে।
মিন্নি,বিস্মিত হয়ে আমার লাল ঘোলাটে চোখের দিকে তাকায়।কি হয়েছে তোমার!এভাবে ঘামছো কেনো!আর ভয়টাই বা কিসের!তোমার কি শত্রু আছে এই এলাকায়!
.
..তোমাকে খুলে বলতে আপত্তি কিসের।তুমিতো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আমাকে বিয়ে দেয়া হয়েছে বিশেষ এক কারনে-যেটা তোমার অজানা।আমি যেনো বিপ্লবী কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসি।তাদের চিন্তাভাবনাও খারাপ নয়।আত্নকেন্দ্রিক চিন্তা এমনই হয়।
একজন বিদ্রোহী প্রগতিশীল ব্লগারের জীবনের নিরাপত্তা এই রাষ্ট্র এখনো দিতে পারেনি,ভবিষ্যতেও পারবেনা।
এই নিয়ে যতো ভয়।বিয়ের আগে ভয়টা তেমন স্পর্শ করতোনা।কিন্তু-এখন খুব করে অনুভূত হচ্ছে।এমন নির্জন প্লেস।সমস্ত ভয় তোমাকে নিয়ে।এমন অনিন্দ্য সুন্দর রমনী-কেনো যে আমায় বিয়ে করলে।আর আমার পরিবার!সব কিছু আড়াল করে রাখলো।হায়রে মানুষ।নিজের পরিবার ছাড়া অন্য কিছু অনুধাবন করতে পারেই না।
বহুক্ষণ থেকে কারা যেনোো অনুসরণ করছে আমাদেরকে।স্পষ্ট বুঝতে পারছি।ওদের টার্গেট আমি নই-বরঞ্চ তুমি।
ওরা জানে প্রেমিক পুরুষের হৃদয় প্রেয়সীকে ঘীরে আচ্ছন্ন থাকে।
মিন্নিকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরলাম।ও ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছে,আর ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
এই মেয়ে কাঁদছো কেনো!
পৃথিবীতে সবকিছুই আপেক্ষিক।আনন্দ নিয়ে বাঁচতে হবে।
বেদনাকে বয়ে নিয়ে চলতে নেই।
মিন্নি আমার কাঁধে হেলান দিয়ে ঘাঁসের আস্তরনে বসে আছে।হাওরের বুক ছেঁয়ে গেছে প্রচণ্ড জলস্রোতে।ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও পড়ছে।মানুষের সমাগম নেই বললেই চলে।এমন হাওর অঞ্চলে অনেক দূরে দূরে জনবসতির সন্ধান মেলে।এখানেও একই চিত্র।
আমরা যে জায়গাটায় বসে আছি_তার একটু পাশেই একটি গৃহ নিবাস।হাওরের জলে উঁচু টিবির মতো স্থান।চারপাশে জলোরাশি।মাঝখানে জনবসতি।খুঁটি গেড়ে রাখা হয়েছে ডিঙি নৌকা।ওটায় করেই এপারে ওপারে চলাচল করে সকলে।জলজ উদ্ভিদ আর মাছই তাদের জীবিকার মূল উৎস/
(মাসুদ চয়ন)

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ