হলুদ গাড়ির সবুজ চালক

রিমি রুম্মান ২৫ নভেম্বর ২০১৯, সোমবার, ০৬:২০:২১অপরাহ্ন সমসাময়িক ৭ মন্তব্য

কেমন আছেন নিউইয়র্ক শহরের হলুদ গাড়ির চালকেরা ? বলা হয়ে থাকে, তাঁরা সবসময় সবুজ, সতেজ। তাঁরা এই শহরের প্রাণ। জীবন যুদ্ধ কিংবা অস্তিত্বের সংগ্রাম যাদের রোজকার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, এমন ক’জন ইয়োলো ক্যাব চালকের বয়ানে তাঁদের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছি এবারের লেখায়।

১। আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে, ভদ্রলোকের বয়স আশি ছুঁই ছুঁই, কিংবা তারও বেশি হতে পারে। বয়সের ভারে অনেকটাই কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ম্যানহাঁটনের ঠিক যে স্থানে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি, বিশাল এক এপার্টমেন্ট বিল্ডিং মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল তার ঠিক পিছনে। মনে হোল তিনি সে বিল্ডিং এর বাসিন্দা। পরনে ওভারকোট, মাথায় উলের টুপি, গলায় মাফলার। আভিজাত্যের চাপ স্পষ্ট। কণকণে শীতের রাত ছিল সেদিন। ট্যাক্সির জন্যে হাত তুললেন। কাছে গিয়ে থামতেই ট্যাক্সির জানালায় মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘দশ ব্লক দূরে একটি রেস্তোরাঁয় যাবো রাতের খাবার পিকআপ করতে। অলরেডি ফোনে অর্ডার দিয়ে রেখেছি। খাবারটা নিয়েই আবার ফিরে আসবো। অর্থাৎ আপ এন্ড ডাউন। যাবে ?’ মনে মনে খুশি হলাম এমন যাত্রী পেয়ে। বললাম, ‘অবশ্যই যাবো, কেন নয় ?’ নিয়ে চললাম ফিফথ্‌ এভিনিউ ধরে। রেস্তোরাঁর কাছাকাছি আসতেই অস্ফুটে ‘ ওহ্‌ হো’ শব্দ শুনতে পেলাম। সামনের আয়নায় তাকালাম। পিছনের সিটে ভদ্রলোক কিছু খুঁজছেন মনে হোল। আবার তাকালাম। তিনি বেশ চিন্তিত এবং দুঃখিত স্বরে বললেন, ‘একটা ভুল হয়ে গেছে। আমি তো ভুল করে মানিব্যাগ ফেলে এসেছি বাসায়। তুমি কি আমায় ষাট ডলার দিতে পারবে ? খাবারের বিল পরিশোধ করে খাবারটা নিয়ে আসি। বাড়ির সামনে ফিরে এসেই চট জলদি ভাড়া সহ তোমার পাওনা মিটিয়ে দিবো।’ আমি সাতপাঁচ না ভেবেই ষাট ডলার এগিয়ে দিলাম। তিনি বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে গেলেন। আমি তার ফিরে আসার অপেক্ষায় রেস্তোরাঁর একমাত্র দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। দশ মিনিট, বিশ মিনিট পেরিয়ে যায়। তার আসবার চিহ্নটি নেই। ট্যাক্সি ক্যাব সড়কের একপাশে পার্ক করে ভেতরে যাই। মৃদু আলো আঁধারিতে একজোড়া কপোত-কপোতী ডিনার করছে আর নিজেদের মাঝে নিচু স্বরে কথা বলছে গভীর মনোযোগে। রেস্টরুমে গেলাম। কাউকে পেলাম না। ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে জানতে চাইলাম খাবার অর্ডার দিয়ে পিকআপ করতে আসা বৃদ্ধের কথা। কৃষ্ণাঙ্গ দীর্ঘদেহী লোকটি জানালেন, এখানে কেউ খাবার অর্ডার করেননি। তবে একজন বৃদ্ধলোককে ঢুকতে দেখেছেন এবং পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছেন বলে জানালেন। বুঝতে পারি, আমি প্রতারিত হয়েছি। সেই রাতে আর কাজে মন বসাতে পারিনি। বিষণ্ণতায় পেয়ে বসে। ম্যানহাঁটনের রাস্তায় উদ্দেশ্যহীন গাড়ি চালাই। মায়ের মুখখানা ভেসে উঠে। তিনদিন যাবত মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। সেদিনের আয়ের পুরোটাই দেশে মায়ের চিকিৎসার্থে পাঠানোর কথা ছিল। রাত্রি দ্বিপ্রহরে অদ্ভুত এক বিষাদে ভরা মন নিয়ে ফিরে এলাম রোজকার ঠিকানায়।

২। যাত্রীর বয়স সত্তরের কোঠায়। একটি মাঝারি সাইজের স্যুটকেস নিয়ে তিনি আমার ট্যাক্সিতে উঠলেন। বললেন, ‘ কুইন্স ভিলেজ’। ম্যানহাঁটনের ডাউনটাউন থেকে কুইন্স ভিলেজ যেতে হবে। চাইলেই সোজা রাস্তা ধরে যেতে পারতাম। কিন্তু মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেলো। অনেকটা পথ ঘুরে হাইওয়ে ধরে অবশেষে পৌঁছুলাম নির্দিষ্ট গন্তব্যে। মিটারে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ভাড়া উঠলো। এমনটিই তো চেয়েছিলাম মনে মনে। ভদ্রলোক ভাড়া মিটিয়ে নেমে যেতে যেতে বললেন, ‘ ইয়ং ম্যান, তুমি কী ভেবেছ আমি কিছুই বুঝিনি ? তুমি যে বেশি ভাড়া উঠাবার জন্যে আমাকে এ পথ ও পথ ঘুরিয়ে গন্তব্যে এনেছ, তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। হ্যাভ অ্যা গুড ডে’। দরজা বন্ধ হবার শব্দ আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো। এ শব্দ কামান দাগার শব্দের ন্যায় বুকের ভেতরে গিয়ে বিঁধল যেন! তাঁর চলে যাবার পথের দিকে আমার আর ফিরে তাকাবার সাহস হোল না। কথাটি আমার ভেতরের বোধকে এমনভাবে নাড়া দিয়ে গেল যে, জীবনে কখনো, কোনদিন আর মানুষকে ঠকাবার কথা ভুল করেও মনে আসেনি। তিরস্কার কিংবা অপমান না করেও মানুষের ভুলগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া কিংবা সংশোধনের পথ দেখিয়ে দেওয়ার এমন চমৎকার ভাষা সেদিনই প্রথম দেখা আমার।

৩। রাতের অন্ধকারের বুক চিরে কেবল ভোরের আলো নগরীর উঁচু উঁচু দালান আর প্রকাণ্ড সব গাছের মগডালে এসে পড়তে শুরু করেছে। সেদিনের মতো কাজ শেষ করে বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করেছি সবে। দরজা লক করবো কেবল, অমনি পিছনের সিটে একটি মানিব্যাগের দিকে চোখ পড়ে। ব্যাগটি হাতে তুলে নেই। ভেতরে আইডি, ক্রেডিট কার্ড, কিছু ডলার। গুনে দেখি এগারো’শ ডলার। ধারণা করি, যাত্রী সম্ভবত এই শহরে টুরিস্ট হিসেবে এসেছে। নইলে এতো অর্থ তো কেউ সাথে বহন করে না। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেই বিছানায়। ঘুমিয়ে পড়ি সহসাই। ঘুম ভেঙ্গেই আবার কাজে বেড়িয়ে পড়ি। মানিব্যাগের বিষয়টি বেমালুম ভুলে যাই। কাজের মাঝেই আচমকা মনে পড়ে ! অস্বস্তি লাগতে থাকে। অসময়ে বাড়ি ফিরে আসি। আইডিতে থাকা নাম সার্চ দেই ফেইসবুকে। একই নামের অগণিত মানুষের ভিড়ে খুঁজে পাই লোকটিকে। ছোট্ট ম্যাসেজ দিয়ে রাখি ফোন নাম্বার সহ। পরদিন ম্যানহাঁটনের নির্ধারিত স্থানে দেখা হয় আমাদের। মানিব্যাগ ফিরিয়ে দিতেই জড়িয়ে ধরেন। ধন্যবাদ জানিয়ে কিছু বখশিস দিতে চান। আমি বিনয়ের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করি। ঘটনার বেশ কয়দিন বাদে নিউইয়র্ক ট্যাক্সি এন্ড লিমুজিন কমিশন ( টি এল সি)এর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ সমেত প্রশংসাসূচক এক চিঠি পাই। জীবনের গতিপথে যতটা পথ পেরিয়ে এসেছি, এমন ঘটনা সেদিনই প্রথম নয়। যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেবার মাঝে যে আনন্দ, তা বৈচিত্র্যময় এই জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর অন্যতম একটি হয়ে স্মৃতির পাতায় জমা থাকুক।

৪। শহরের নামী এক হোটেলের সামনে অপেক্ষা করছিলাম যদি কোন যাত্রী পাওয়া যায় সেই আশায়। স্যুট-টাই পরা অশীতিপর এক বৃদ্ধ হোটেল গেটের বাহিরে এসে দাঁড়ালেন। হাত উঠালেন ট্যাক্সি ক্যাবের জন্যে। আমি গাড়িটি বৃদ্ধের কাছাকাছি গিয়ে থামালাম। হাতে থাকা স্যুটকেস নিজেই গাড়ির পিছনের ট্যাঙ্কে রাখলেন। গন্তব্যের ঠিকানা বললেন। জিপিএস এ ঠিকানা বসিয়ে সার্চ দিলাম। অনেক দূরের পথ। মন ভালো হয়ে গেলো। দু’শ ডলারের ভাড়া পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার বটে ! সামান্য একটি ভুলের জন্যে সেদিন পুলিশের জরিমানার শিকার হয়েছিলাম বলে মনটা বিষণ্ণ ছিল। কাজের শুরুতেই পুলিশের জরিমানার মুখোমুখি হলে কারই বা স্বাভাবিক মানসিকতা নিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় ! এমন নানান ভাবনায় শাঁইশাঁই করে ছুটে চলি হাইওয়ে ধরে। গন্তব্যের কাছাকাছি আসতেই যাত্রী বললেন, ‘তুমি কি সামনের দোকানে একটু থামবে ? আমার সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছে। আজ না কিনলেই নয়।’ আমি রাস্তার একপাশে গাড়ি পার্ক করি। তিনি এক ব্লক পিছনের একটি ডেইলি শপে যান। অনেকটা সময় পেরোলেও তার আসার নাম নেই। মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। লোকটি ফিরে আসবে তো ! পরক্ষণেই মনে পড়লো যাত্রীর স্যুটকেস তো গাড়ির ট্যাঙ্কে। অবশ্যই তিনি ফিরে আসবেন। এমন ভাবনার মাঝে আরো অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে আবারো ভাবনা হয়, আশংকা জাগে। ট্যাঙ্ক খুলে স্যুটকেসটি হাতে নিয়ে দেখি একেবারেই ওজনহীন। খুলে দেখি শূন্য স্যুটকেস। কেউ ফেলে দিয়েছে এমন পুরনো স্যুটকেস রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে এমন নিখুঁত অভিনয় করেছেন অশীতিপর এই বৃদ্ধ। অভিনব এক প্রতারণার শিকার হই সেদিন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বিষণ্ণ মনে ফিরে আসি। ভাবি, আমাদের বহমান এই জীবনে অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি হাত ধরাধরি করে চলে। সিটিতে ফিরে আসি যখন, ততক্ষণে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে সেখানে। যাত্রী পাওয়া দুরহ। ভাগ্য যখন খারাপ থাকে তখন যেন সবদিক থেকেই খারাপ ঘটনা ঘটতে থাকে একের পর এক। এমন ভাবনার মাঝে একটি বারের সামনে থেকে একজন মধ্যবয়েসি নারী উঠেন ট্যাক্সিতে। গন্তব্যের ঠিকানা বললেন জড়ানো কণ্ঠে। একটু বেশিই পান করে ফেলেছেন হয়তো। গন্তব্যে পৌঁছুলে বখশিস সহ ভাড়া মিটিয়ে দেন। যাক্‌ যেমনটি আশংকা করেছিলাম, তেমনটি ঘটেনি। ট্যাক্সিতে বমি করে ভাসিয়ে দেয়নি, কিংবা ভাড়া দেওয়া নিয়ে ঝামেলা করেনি। শহরের অলিতে গলিতে ঘুরছি পরবর্তী যাত্রীর খোঁজে। আচমকা ফোনের রিং বেজে উঠে। সামনেই ফোন হোল্ডারে রাখা নিজের ফোনের দিকে তাকাই। সেটিতে লাইট জ্বলে উঠেনি! তবে ? পিছনের সিট থেকে ফোন রিং এর শব্দ। কেউ ফোন ফেলে গিয়েছেন ভুলে। সম্ভবত শেষ যাত্রীর কাজ এটি। ট্যাক্সি থামিয়ে ফোন ধরতেই অচেনা পুরুষ কণ্ঠস্বর। বেশ বিনয়ের সাথে বললেন, ‘ আমার মা কিছুক্ষণ আগে তোমার ট্যাক্সি ক্যাবে ফোনটি ফেলে এসেছেন। তুমি কি দয়া করে ফোনটি দিয়ে যেতে পারবে যেখানে আমার মাকে নামিয়ে দিয়েছিলে, ঠিক সেখানে ?’ ব্যস্ততা নেই, ট্র্যাফিক জ্যাম নেই, নিস্তব্ধ শহর। নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগেনি। শ্বেতাঙ্গ তরুণ এগিয়ে এলেন, হ্যান্ডসেক করলেন। ফোনটি ফেরত নিলেন। ধন্যবাদ জানিয়ে হাতে কিছু ডলার দিয়ে বললেন, ‘ তোমার বখশিস।’ বিদায় নিয়ে গাড়িতে বসে মুঠো খুলে দেখি দুই’শত ডলার! আনন্দে চোখে জল এসে যায়। মন ভালো হয়ে উঠে। পৃথিবীতে খারাপ মানুষ যেমন আছে, তেমনি ভালো মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এমন মানুষ আছেন বলেই পৃথিবীটা এখনো সুন্দর। সুন্দর আমাদের বেঁচে থাকা।

------------
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক

0 Shares

৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ