“নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই এক অভূতপূর্ব আন্দোলনের শুরু হয়েছিল। ফুটপাতে বাসচাপায় সহপাঠীর মৃত্যুর পর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমেছিল। ধীরে ধীরে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় থেকে বড়দের ভুল-বিশৃঙ্খলা ধরিয়ে দেয়”{ সূত্র প্র/ আলো, ২৯ জুলাই’২২}। সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চতুর্থ বর্ষপূর্তিতেই ভয়াবহ রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১১ জন। অথচ নিরাপদ বাহন হিসেবে রেল বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই  বেশিরভাগ মানুষেরই পছন্দের।  যদিও দেশের বিভিন্ন স্থানে লেভেল ক্রসিং মানুষের জন্য ক্রমশ মৃত্যুফাঁদ হয়ে উঠেছে।  বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, “গত ২৯ জুলাই’২২ বেলা দেড়টার দিকে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার বড়তাকিয়া রেল স্টেশনের কাছে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ১১ জন আরোহী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৬ জন তাঁদের মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর”। পুলিশ ও কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, খৈয়াছড়া ঝরনা নামের পর্যটন স্পট থেকে গোসল করে ফেরার পথে এ দুর্ঘটনা ঘটে। হতাহত সবাই মাইক্রোবাসের যাত্রী। ট্রেনটি ছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী মহানগর প্রভাতী। ট্রেনটি ধাক্কা দেওয়ার পর মাইক্রোবাসটিকে প্রায় এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায়। এই এক কিলোমিটারজুড়ে ট্রেনটি পুরো রেললাইন এলাকায় তাণ্ডবলীলা চালায়। রেললাইনের ওপর দিয়ে যেন হাজার মাইল বেগের টর্নেডো বয়ে গেছে। উপড়ে পড়ে রেললাইনের পাশে খুঁটিগুলো। দুমড়ে-মুচড়ে যায় মাইক্রোবাসটি। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায় যাত্রীদের জামা জুতা ব্যাগ মাইক্রোবাসের যন্ত্রাংশ। দুমড়ে মুছড়ে যাওয়া মাইক্রোবাস থেকে যখন একে একে ১১টি লাশ বের করে রেললাইনের পাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় তখন সেখানে উপস্থিত কয়েক শ মানুষ এক দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যুতে হাহাকার করতে থাকেন। তখনে সেখানে এক হৃদয়বিদারক মর্মস্পর্শী পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ভারী হয়ে উঠে আকাশ বাতাস।

এক তথ্য থেকে জানা যায়,২০১৪- ২০২১ সালে রেল ক্রসিঙয়ে মারা গেছেন ১৮৭ জন অর্থাৎ ৮৫ %। পাশাপাশি রেল ক্রসিংয়ে পাহারাদার থাকা সত্ত্বেও পাহারাদারের অবহেলায় কিংবা চালকের অসতর্কতায় সেগুলোতেও দুর্ঘটনা ঘটছে ১৮ %।  ২০১৫ সাল থেকে রেলক্রসিংকে নিরাপদ করতে খরচ হয়েছে ১৯৬ কোটি টাকা।  পাশাপাশি রেলওয়ের তথ্য অনুসারে,“সারা দেশে মোট রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ২ হাজার ৫৬১। এগুলোর মধ্যে অনুমোদন নেই ১ হাজার ৩২১টির। এসব ক্রসিংয়ের বেশির ভাগই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কে। আরও আছে পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি করপোরেশন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সড়কে। সব মিলিয়ে দেশের ৮২ শতাংশ রেলক্রসিংই অরক্ষিত”। রেলওয়ে সূত্র জানায়, “মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুতি, এক ট্রেনকে অন্য ট্রেনের ধাক্কা, রেলক্রসিংয়ে গাড়িকে ট্রেনের চাপা—এসবকে দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রেলপথে দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি হয়, এর ৮৫ শতাংশই মারা যান রেলক্রসিংয়ে। অবশ্য রেললাইনে কাটা পড়ে মৃত্যুর হিসাব রেল কর্তৃপক্ষ রাখে না”। পাশাপাশি “রেলওয়ের নথিপত্র অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে রেলক্রসিংকে নিরাপদ করতে ১৯৬ কোটি টাকা খরচ করেছে রেলওয়ে। দুটি প্রকল্পের আওতায় রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে ৭০২টি রেলক্রসিং উন্নয়ন করা হয়েছে। এর আওতায় পাহারাদার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৫৩২ জন। রেলক্রসিং উন্নয়নের মধ্যে প্রতিবন্ধক বসানো ও পাহারাদারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এরপরও রেলক্রসিং নিরাপদ হয়নি”{সূত্রঃ প্র/ আলো, ৩০ জুলাই’২০২২}। একথা দিবালোকের মতো সত্য রেলে পাহারাদার সঙ্কট অত্যন্ত প্রবল। রেলওয়ে থেকে জানা যায়, পাহারাদারের চাকরি স্থায়ী নয়। প্রকল্পের অধীনে সর্বসাকল্যে ১৪ হাজার টাকার মতো তাঁদের বেতন। ২০১৫ সালের পর দুটি প্রকল্পের অধীনে তাঁদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। প্রকল্প শেষ হলে বেতন থাকবে না। এ জন্য শুরুতে নিয়োগ পাওয়া অন্তত ৩০০ পাহারাদার চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন। অস্থায়ী চাকরি বলে তাঁদের প্রশিক্ষণেরও খুব একটা ব্যবস্থা নেই। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, সড়কে প্রাণহানির দায়ে শাস্তির সুনির্দিষ্ট আইন আছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানির দায়ে শাস্তির বিধান নেই। উল্টো যানবাহনের চালককে দায়ী করে রেল কর্তৃপক্ষ। বড়জোর পাহারাদারের ভুল পেলে তাঁকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু রেলে পাহারাদারের সংকট থাকায় কদিন পরেই আবার দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হয় বলে রেলওয়ে সূত্র জানায়।

এক তথ্য থেকে জানা যায়, “রেলওয়ে গত এক যুগে রেললাইন তৈরি ও কেনাকাটায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। সওজ প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কেউ দায়িত্ব নিতে চাইছে না”।  মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে ১১ জনের মৃত্যুর পর রেল ক্রসিংয়ে মৃত্যু রোধে যথাযথ এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সময় এসেছে কেননা রেলক্রসিংয়ের কারণে জোর দিয়ে বলা যায় না রেলপথ এখন আর পুরোপুরি নিরাপদ।  বিশেষজ্ঞদের মতে, “রেলক্রসিং নিরাপদ করার দুটি উপায় আছে। ১. রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া সড়কে উড়ালপথ নির্মাণ করা। ২. ট্রেন আসার সময় যানবাহন আটকে দেওয়ার জন্য পথরোধক (ব্যারিকেড) বসানো এবং ট্রেন এলে তা সময়মতো নামিয়ে যানবাহনের চলাচল বন্ধ রাখার জন্য পাহারাদার নিয়োগ”। বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “রেলে বিপুল বিনিয়োগের ফলে ট্রেনের গতি বাড়বে—এটাই ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু রেলক্রসিং অরক্ষিত রেখে গতি বাড়ানো যাবে না। তিনি আরও বলেন, সব রেলক্রসিং পর্যায়ক্রমে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় আনতে হবে” {সূত্রঃ প্র/ আলো, ৩০ জুলাই’২২}। তিনি আরও বলেন, “এর আগে তাৎক্ষণিকভাবে সব ক্রসিংয়ের দুই পাশে তিনটি করে ছয়টি গতিরোধক বসাতে হবে। প্রতিটি ক্রসিংয়ে ফ্লাশিং লাইট বসাতে হবে, যাতে ট্রেন এলে জ্বলে ওঠে। ক্রসিংয়ে ঘণ্টা বসাতে হবে, যা ১০০ ডেসিবেল শব্দ সৃষ্টি করে”। যেখানে পাহারাদার আছে, সেখানে দুর্ঘটনা এড়াতে পাহারাদারসহ সবার সচেতনতা দরকার। পাহারাদারের ভুলে দুর্ঘটনা হলে অবশ্যই শাস্তির বিধান রাখা জরুরি। পাশাপাশি পাহারাদারদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধি করা, তাঁদের প্রশিক্ষিত করে তোলার কোনো বিকল্প নেই। মিরসরাই দুর্ঘটনার পরে চট্টগ্রামের কদমতলি ক্রসিংসহ দেশের বিভিন্ন রেলক্রসিংয়ের যে চিত্রগুলো দেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় এসেছে তা খুবই দুঃখজনক, হতাশাজনক এবং মর্মপীড়াদায়ক। রেল ক্রসিংয়ের গেইট বন্ধ করা সত্ত্বেও মানুষের চলাচল এবং বিভিন্ন যানবাহনের উল্টোপথে চলাচল এমনকি একটি বাইকে স্বামী স্ত্রী সন্তানসহ চার জনের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে আগত ট্রেনের আগে পারাপার, চলন্ত ট্রেনের গা ঘেঁসে মানুষ ও যানবাহনের দাঁড়িয়ে থাকা খুবই ভয়ংকর এবং বিপদজনক। এখনো মানুষের, চালকদের, বাইকারদের মধ্যে কোনো সচেতনতাই যেন আসেনি। ডর ভয় আতঙ্ক শঙ্কাও যেন কাজ কারছে না। বিবেক বুদ্ধি বিবেচনা আবেগ অনুভূতি যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। সবাই অধৈর্য বেপরোয়া লেভেল ক্রসিং পার হওয়ার জন্য। তবে একথা অনস্বীকার্য যে বেশিরভাগ চালক বেপরোয়া মনোভাব দেখিয়ে পার হতে গিয়েও দুর্ঘটনায় পড়ছেন। একদিকে সড়কে নৈরাজ্য বিশৃঙ্খলা দুর্ঘটনা নিরাপদ সড়ক দিবস আন্দোলনের চার বছর পরেও থামেনি। সরকার দেশ জাতি এবং সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতা সদিচ্ছা সচেতনতা ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা থেকে মুক্তি নেই। পাশাপাশি রেলপথকেও নিরাপদ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।  জীবন মানুষের অমূল্য সম্পদ। অবহেলায় মৃত্যু মানুষকে ক্ষুব্ধ এবং হতাশ করে। যে পরিবার স্বজন হারায় সেইই বুঝে স্বজন হারানোর ব্যাথা। অবহেলায় মানুষের মৃত্যু মোটেই কাম্য নয়।

 

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ