
ক্লাশ টেনে এ পড়ার মাঝামাঝি একটা সময়ে হুট করে ছুটিতে এলেন ছেটকা। সিক্সে ওঠার বছরের প্রথম মাসেই একদিন ছোটকা সিলেট ক্যাডেট কলেজে চাকরিতে জয়েন করতে ঝালকাঠি ছেড়েছিলেন। বছরে দুটো ঈদে বাড়ি আসতেন। ছোটকা যাবার আগে জেনেছি একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করতেন। মেয়েটার পরিবার মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। আমি দেখেওছিলাম একবার সেই মেয়েকে। ছোটকা কি তখন খুব মন খারাপ করেছিলেন? খুব ডিপ্রেশনে ভুগেছিলেন? ওই অতটুকুন বয়সে এসব কি আর এত বুঝি! বেশিদিন না যেতেই ছোটকা চাকরি নিয়ে চলে গেলেন সিলেট। কোয়াটারে একাই থাকেন। তবুও বিয়ের ভাগ্য খুলতে আরো চার বছর পেরিয়ে গেছে। দাদুু মেয়ে পছন্দ করে রেখেছেন। কোরবানি ঈদে বাড়ি এলে ছোটকার বিয়ে। বিয়ের দিনই হুট করে জানলাম আজই মেয়ে দেখতে যাবে কয়েকজন মিলে। পছন্দ হয়ে গেলেই একবারে বিয়ে পড়িয়ে মেয়ে নিয়ে আসবে। সকাল থেকে এ বাড়ি( আমার বাবার বাসা) ও বাড়ি ( দাদুর বাসা) মিলিয়ে দৌঁড়ঝাঁপ আম্মা আর মেজো চাচির। বিয়ের কনে কে? কি নাম? কোথায় থাকে? বাপের বাড়ি কই? কিচ্ছু জানিনা। আমি তো স্কুলে ছিলাম! স্কুল থেকে ফিরে আসার পর কানাঘুসো শুনি। কারে কি জিজ্ঞেস করব! আম্মা বললেন- তোর ছোটকার বিয়া। ব্যস্…. ডাইনিং টেবিলের পাশে পানির গ্লাস ধরা হাত তেমন থমকে রইল কিছুক্ষণ। আব্বা নিয়ম মাফিক তাঁর লেখার টেবিলে মাথা গোঁজ করে লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত। আম্মা ব্যস্ত শশুড়ের হুকুমে দেবরের বিয়ের দায় দায়িত্ব পালনে! আমার কিছুই করার নাই। কিভাবে কি বিয়ে হবে? কোথায় বিয়ে হবে এসব বড়রা জানেন। আমাদের, মানে আমার সমবয়সী ফুপু মুক্তি, তার বড় পলি ফুপু, চাচাত বোন বিপু। আমরাই তখন পর্যন্ত মোটামুটি বড়। বাকিগুলা পিচ্চি পাচ্চা দলে। আমাদের এই চারজনের, মোটামুটি বিয়ে বা পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি নিয়ে মনের মধ্যে কিছুটা খই মুড়ি ফোটে। রাস্তার ওপাড়েই দাদুর বাসা,,,, গেলাম সেখানে। আজকে আর দাদুর সামনে সহজে পড়া যাবে না। নরমালি যদি দাদুর মেজাজের টেম্পার ৪৪০ ভোল্ট থেকে থাকে! তো আজ তা বেড়ে দাঁড়াবে দ্বিগুণ নির্ঘাৎ। দাদুর নিয়মানুবর্তিতার একচুল হেরফের হবার জোঁ নেই পরিবারের কারো পক্ষে। আব্বা ভিন্ন। আব্বা তো এই বাপেরই ছেলে! আব্বা যদি বলে দেন,,,আমি এসবের মধ্যে নেই,,, তো দাদুও দ্বিতীয়বার আর আব্বাকে সে ব্যাপারে কিছু বলবেন না। আব্বাকে জানানো হয়েছে ছোটকার বিয়ে সম্পর্কে! আব্বা বলেছেন তাঁর আব্বাকে- আপনি যা ভালে মনে করেন তাই করেন। ব্যস্… এটুকুই কথার শেষ।
দাদুর বাসায় ঢুকে দেখি মাঝখানের ঘরে শাড়ি, ব্লাউজ জুতো। আমি শাড়িটা ধরে জিজ্ঞেস করলাম – এই শাড়িটা কিসের? দাদি জবাব দেবার আগেই, পেছন থেকে এসে দাদু জবাব দিলেন- এইটা বিয়ার শাড়ি। আমি- এই শাড়ি কিনছে কেডা? এইডা একটা বিয়ার শাড়ি হইলো? বিয়ার শাড়ি এমন হয়? দাদু ঃ এই শাড়ি কিনছে তোর চাচার বাপে। আর তার এইডাই পছন্দ হইছে বিয়ার জন্য? আর কিছু কবি? কাঁচা পাকা দাড়ি, লম্বা পাঞ্জাবি, লুঙ্গি পায়ের গোড়ালির একটু উপরে তোলা…. আমি দাদুরে আপাদমস্তক একবার দেখে মুক্তি আর পলি ফুপুর রুমে চলে গেলাম। সন্ধ্যার পরপরই যাওয়া হবে মাসুমাদের বাসায়। কন্যার বাবা নেই। চাচাও নেই। দূরসম্পর্কের এক খালু আছেন! তার বাসাতেই এই বিয়ের আয়োজন। মোটামুটি রকম কনে দেখেই কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানো পর্ব সেড়ে ফেলা হবে। পরের পর্ব পরে দেখা যাবে। কোন আলোচনা কখন সম্পন্ন হইছে আমি কিচ্ছু জানিনা, মোট কথা আমরা ছোটরা কেউ কিছু জানিনা। আমরা এও জানিনা যে, এ বিয়েতে আমাদের নেয়া হবে কি হবে না। আমরা টান টান রুদ্ধশ্বাস আর বুক ধুকপুক নিয়ে এখানে সেখানে অযথাই ঘুরে বেড়াচ্ছি। আর কান সজাগ রাখছি,,,,কখন দাদু বলে ওঠেন- এই লিপি, মুক্তি,পলি, বিপু….তোরা রেডি হ, তোরাও যাবি। এক সর্দার পরিবারের হেড সর্দার অনুমোদন না দিলে আর কারো সাধ্য নাই কোনোরকম প্রোগ্রামের হেরফের করে। ক্রমশ সিদ্ধান্ত এবং ঘটকের দৌড়াদৌড়ি চলাচলি চলতে চলতে ( তখন যেমন হাতে মোবাইল ছিলনা! তেমনি প্রয়োজনে সব ঘরেও ল্যান্ড ফোন ছিলোনা। রিকসা ভাড়া গুণতে হত সংবাদ আদান প্রদানে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে সাতটার আগে দাদু আমাদের ডেকে রেডি হতে বললেন বরের সঙ্গে যাবার জন্য। রেডি হতে তখন আমাদের ৩০ মিনিটের বেশি সময় লাগে না। আহা…. যাস্ট সালোয়ার কামিজ! চোখে কাজল আর লিপস্টিক! এইতো আমাদের সাজুগুজুর সর্বোচ্চ সীমা! তবে…. আমার চুলের পেছনে সময় একটু বেশিই লাগত। কোন স্টাইলে চুল বাঁধব এই চিন্তার পেছনেই একটু বেশি ক্ষয়ে যেত সময়। দাদুর ধমক খাবার ইচ্ছে নেই মোটেও,,,, তড়িঘড়ি ই রেডি হয়ে হাজির। মাসুমা আগে থেকেই আমাদের বন্ধু। ও পড়ত গার্লস স্কুলে আর আমরা অন্য স্কুলে। হলে কি! আমরা যখন প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে খেয়েই মাঠে দৌড়োতাম খেলতে! সেই সময় থেকেই মাসুমাকে এবং ওদের পরিবারকে চিনি /জানি।এক পাড়ায় থাকার সুবাদে আমরা সবাই একসাথেই খেলাতাম। কে জানত! আজ ও আমাদের এমন করে আত্মীয় হয়ে যাবে?
বিয়ে অল্প সময়েই সম্পন্ন হয়ে গেলো। জল খাবারও শেষ। এরপর আলোচনা কনেকে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে। বড়দের মাঝখান থেকে ছোটরা উঠে ভেতর ঘরে প্রবেশ করলাম। কনে বউ খাটের এক কোনায় বসে আছে। আমরা গিয়ে তাঁকে ঘিরে বসলাম। সম্বোধন নিয়ে আমার মনে টানাপোড়েন। আমার এত্তগুলা চাচি! সব চাচিরেই যদি চাচি/কাকি বলে ডাক দেই হবে? আমার ইউনিক সম্বোধন চাই। কনেবউকেই জিজ্ঞেস করলাম,- তোমাকে কি বলে ডাকি বলতো? একটা কাকি আছে,একটা সেজকাকিও আছে,, ছোটকাকি আমার নিজের কানেই বিরক্ত লাগছে, তোমারে কি বলে ডাকি বলোতো? কনে বৌ ছোট্ট করে জবাব দিলো: আমাকে তুমি কাকিমা বলে ডেকো!……
ঃআগামী পর্বে সমাপ্য
৯টি মন্তব্য
খাদিজাতুল কুবরা
দারুণ স্মৃতিচারণ করলে আপু। আমার ও মধুর স্মৃতি আছে কাকার বিয়ে নিয়। কাকার সাথে পালকিতে যাওয়ার জন্য মরাকান্না জুড়ে দিয়েছিলাম আমি। আম্মা দিতে চাইছিলেন না মাথা ঘুরতে পারে ভেবে। শেষ পর্যন্ত বংশের প্রথম আহ্লাদীর কাছে সবাই হার মানল।কাকার পালকিতে গিয়েছি। এসেছি চাচীর মানে নতুন বৌয়ের পালকিতে। তোমার লেখা পড়ে স্মৃতিরা একছুটে বহুবছর পেছনে ঘুরিয়ে আনল। ধন্যবাদ আপু।
বন্যা লিপি
খুব সাবধানে স্মৃতিচারণ করতে হচ্ছে রে!!! শেষটায় গিয়ে জানতে পারবি,,,,এই স্মৃতিচারণ কোনদিকে যায়…..২৪ ঘন্টা বাদে পরের পর্ব আসছে,,,, থাকিস সাথে…..
খাদিজাতুল কুবরা
আছি আপু ইনশাআল্লাহ
সাবিনা ইয়াসমিন
এখনো ২৪ ঘন্টা শেষ হয়নি?
আমি ঘুমিয়ে গেলে তারপর পরের পর্ব দিবা?
বন্যা লিপি
২৪ ঘন্টা পার করেই দিয়েছি দেখো। তুমি ঘুমাও এখন। কিন্তু…. থাক বললাম না কিছু।
নিতাই বাবু
দারুণ লাগলো স্মৃতিচারণের লেখা বিয়ের গল্প। কিন্তু গল্পটা শেষ হয়নি। শেষ পর্বের আশায় থাকতে হচ্ছে। আশা করি অতি শীঘ্রই পড়তে পারবো।
বন্যা লিপি
শেষ অংশ দিয়েছি দাদা। পড়ে দেখবেন। মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা জানবেন।
জিসান শা ইকরাম
অনেক কথা স্মৃতি মনে করিয়ে দিলে।
তোমার দাদু, তোমার আব্বা, ছোটকা, ছোটো কাকিমা,
কি এক সংক্ষিপ্ত জীবন আমাদের।
লেখার বর্ননার গুনে সব কিছু যেন বাস্তবে দেখতে পেলাম।
আবারো,
শুভ কামনা
বন্যা লিপি
২৭ তারিখটা মনে ছিলনা একদম…. মেসেঞ্জারে একটা লেখা দিয়ে তনু* জানতে চেয়েছিল,লেখাটা সোনেলা গ্রুপে দেয়া যাবে কি যাবে না! আমি ওকে কল করতে বলেছিলাম,,,কল করার পরে লেখাটা নিয়ে কথা বলতেই তনু বলল,,, আজ ২৭ তারিখ,,, বড় আপু,,,এজন্যই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি তুমি কেমন আছ?
ওর লেখাটা পড়েই বুঝেছি অপষ্ট ভাবে বর্ননা করেছে সেদিনের (২৭ জুলাইয়ের) অবস্থা।
তারপরই মনে হলো এ নিয়ে কিছু লিখি।। অনেক সংক্ষিপ্ত করে লিখেছি। মানসিক অবস্থা আমার মোটেই ভালো না। তবুও লিখলাম।
মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা সহ ভালবাসা।