স্বার্থপরতা

সুপর্ণা ফাল্গুনী ৭ ডিসেম্বর ২০১৯, শনিবার, ০৩:৪৯:৫৯পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩৪ মন্তব্য
  1. যখন থেকে বুঝতে পেরেছি, বলতে শিখেছি অনেক বন্ধু পেয়েছি, খেলার সাথী পেয়েছি। সোজা কথায় খেলার জন্যেই বন্ধুত্ব করা। ছেলেবেলা টা আসলে এমন করেই বন্ধুত্ব হয়, তখন তো বন্ধু কি জিনিস সেটাই বোঝার কথা নয়। এভাবেই সময়ের স্রোতে ভেসে স্কুল জীবনে প্রবেশ করা। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছেলে মেয়ে একসাথে পড়া হলেও বন্ধুত্ব মেয়েদের সাথেই করা হতো। কার পেন্সিল কত সুন্দর,কার রাবার বা শার্পনার টা কালারফুল,কার স্কুল ব্যাগে কত পকেট আছে তাই নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ানো সেই দ্বন্দ্ব থেকেই অন্যরকম এক বন্ধুত্ব। তারপর টিফিন পিরিয়ডে কে কেমন টিফিন আনতো , শেয়ার করতো তাই নিয়ে আরেক দফা বন্ধুত্বের সম্পর্ক। খেলাধুলার সময় তো বন্ধুত্বের সংজ্ঞা আরেক দফা পাল্টে যেত। খেলাধূলায় যারা প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হতো তাদেরকে হারানোর নেশায় মরিয়া হয়ে উঠতো শৈশবের সরলতা, ভালোবাসা।
    বাসায় এসে প্রতিবেশীদের ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে হাঁড়ি পাতিল, খেলনা, বাসার ফেলে দেয়া টুকিটাকি জিনিস দিয়ে খেলার সামগ্রী বানিয়ে বড়দের কে নকল করে সংসার সংসার খেলা-সে এক অন্যরকম অনুভুতি, বন্ধুত্ব। সেখানেও ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতার বন্ধুত্ব-কার খেলনা কত দামী, কার খেলনার সংখ্যা বেশী, কে কত খেলনা জমাতে পারতো তাই নিয়েই চলতো কাড়াকাড়ি, বাড়াবাড়ি। দিনের বেশিরভাগ সময়টা যে তাদের সাথেই কাটানো হতো।
    বাবার চাকরির সূত্রে শহরে থাকার সুবাদে শহুরে বন্ধু, শহুরে খেলনা এই নিয়ে ছিল বন্ধুত্বের মাপকাঠি। গ্রামের বাড়িতে বাৎসরিক দীর্ঘ ছুটি বা রমজানের ছুটিতেই শুধু যাওয়া হতো। সেখানে ছিল আরো দু'দফা বন্ধুত্ব। মামাবাড়ি, দাদাবাড়ির দূরত্ব কিছুটা দীর্ঘ হওয়াতে সেখানেও দুই ক্যাটাগরির বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। মা বাড়ির বড় সন্তান হওয়াতে,মামা -মাসীদের বিয়ে না হওয়াতে আর শহরে থাকার কারণে মামাদের গ্রামের সবার চোখের মনি, আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতাম। কে আমাকে বন্ধু করবে, খেলতে নিবে, এটা ওটা এনে খাওয়াবে এই নিয়ে চলতো প্রতিযোগিতা। মাটির পুতুল বানানো, ছেঁড়াফাটা কাপড়ের অংশ দিয়ে তাদের জামাই বউ সাজানো এসবই ছিল খেলার প্রধান উপকরণ। শামুকের খোলস দিয়ে পয়সা বানানো, গাছের পাতা ছিঁড়ে টাকা বানানো,খেজুর ফুলের ছড়া দিয়ে ঝাড়ু বানানো ,বুনো লতাপাতা,ফল,ক্ষেতের ফসল এসবই ছিল খেলার সামগ্রী। ওরা যখন নদীতে সাঁতার কাটতো, ডুব দিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতো আমি তখন সাঁতার না জানাতে, পানিকে ভয় পাবার কারনে ওদের খেলার সঙ্গী না হতে পারার আফসোসে পুড়তাম। দাদা বাড়ির বন্ধুত্ব ছিল জ্যেঠাতো,পিসাতো ভাইবোনদের সাথে আর ঠাকুরমার সাথে। সেই ছিল প্রধান খেলার সাথী, চলার সাথী,আবদারের একমাত্র সাথী। তাকে নিয়ে ভাগাভাগি করতে গিয়ে কাজিন দের সাথে খুউব ঝগড়া, ফ্যাসাদ, খুনসুটি হতো। সবচেয়ে বেশি বাধতো রাতে কে তার পাশে ঘুমাবে এই নিয়ে। আমি দূরে থাকার কারণে আমাকেই প্রায়োরিটি বেশি দিতো। তবুও মন ভরতো না। যখন শহড়ে আসতো তখন আমাকে কে পায়? খুশীতে,অহংকারে স্বার্থপর হয়ে যেতাম। বাড়িতে তাকে যেতে দিতে চাইতাম না কিন্তু বেশি দিন রাখতে পারতাম না বাড়ির কাজিন দের টানে সে আমাদের ছেড়ে চলে যেতো।
    স্কুল, স্কুলের প্রিয় বান্ধবীদের ছেড়ে কলেজে পা বাড়ালাম। সেখানে তো স্বপ্নের মোহে পড়লাম , পরাধীনতার দেয়াল ভেঙে মুক্ত পাখি হলাম। ক্লাস ফাঁকি দেয়ার প্রতিযোগিতায় নাম লেখালাম । কলেজ ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন খানে গিয়ে আড্ডা দেয়া, ফুসকা, চটপটি, আইসক্রিম শেয়ার করে সবাইকে নিয়ে খাওয়া, বিভিন্ন শপিংমলে বিনা কেনাকাটায় ঘুরে বেড়ানো, এর ওর লাভারদের নিয়ে মজা করা, খাওয়াতে নেয়ার আবদারে সময়টা কিভাবে যেন পার হয়ে গেল। কলেজের দু'বছর চোখের নিমেষেই শেষ হয়ে গেল। স্কুলের প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে যাদের নিয়ে মুক্ত বিহঙ্গ হলাম তাদেরকে নিয়ে বেশীদিন কাটাতে পারলাম না।                                                                  শুরু হলো জীবনের সর্বোচ্চ ধাপে পা দেয়ার প্রতিযোগিতা। যতই ধাপ পার হচ্ছি ততই শৈশব কৈশোরের আনন্দ, ভালোলাগা, স্বাধীনতার স্বাদ হারালো আর দায়িত্ব বোধ, শৃঙ্খলা বোধ, ত্যাগের পরিধি বাড়তে লাগলো। বন্ধুত্বের সংজ্ঞা, ধরন ও পাল্টাতে লাগল। ভার্সিটির বন্ধুত্বের মাঝে আগের সেই দূরন্তপনা , ভালোলাগা খুঁজে পেলাম না। ভার্সিটিতে উঠার পর স্বাধীনতার পরিধি বাড়লো, স্বপ্ন বাড়লো, আকাঙ্ক্ষা বাড়লো কিন্তু বন্ধুত্বের আবেগ ভালোবাসা পেলাম না। যত দিন যাচ্ছে ততই বন্ধুত্বের পরিধি সীমিত হলো। বুঝলাম স্বার্থপর থেকে বড় স্বার্থপর হয়ে গেছি। বন্ধুত্বের মাঝেও স্বার্থ বাস করে মনের গহীনে। সময়, পরিস্থিতি সব মুখোশ খুলে দেয়। আজো দিন শেষে ঐ সেই স্কুল, কলেজের নির্মল বন্ধুত্ব, বন্ধুদের খুঁজে বেড়াই।
0 Shares

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ