স্বাধীনতা সংগ্রামী মণীষা-৩ : মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

(ডিসেম্বর ১২, ১৮৮০-নভেম্বর ১৭, ১৯৭৬)

[মণিষীরা বলেছেন “যে জাতি তার বীর সন্তানদের মূল্য দিতে পারে না সে জাতির কোনোদিন বীর সন্তান জন্ম নিতে পারে না।”আমরা আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাধীনতা সংগ্রামী আত্মদানকারী মণিষাদের সম্মন্ধে কত টুকুই বা জানি। যারা প্রবীণ তারা হয়তো কিছু কিছু জানে, কিন্তু আমাদের নবীন প্রজন্ম সেসব মণিষাদের সম্মন্ধে তেমন কিছুই জানে না।তাই সব শ্রেণির পাঠকদের জন্য উল্লেখযোগ্য কয়েকজন মণিষার জীবনী নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনার আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।]

-মাহবুবুল আলম //

আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন বিংশশতকে ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও আন্দোলন সংগ্রামের অকুতোভয় সৈনিক।মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম হয়েছিল এক সাধারণ পরিবারে ১৮৮০ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি। সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে। জন্মের পর বাবা হাজী শরাফত আলী খান আদর করে ছেলের নাম রেখেছিলেন ‘চেগা মিয়া’। বাবা-মায়ের স্নেহ বেশিদিন পাননি মওলানা ভাসানী। তাঁর বয়স যখন মাত্র ৬ বছর তখনই পিতার মৃত্যু হয়। তারপর এগারো বছর বয়সে মায়েরও মৃত্যু হয়।

শৈশবেই সকলকে হারিয়ে আব্দুল হামিদ এসে আশ্রয় নিলেন চাচা ইব্রাহিম খানের বাড়িতে। চাচা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিলেন সিরাজগঞ্জ শহরের এক মাদ্রাসায়। কিন্তু পড়াশোনায় মন বসল না আব্দুল হামিদের। একদিন চাচার সাথে অভিমান করে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেলেন শাহজাদপুরে এক দুঃসম্পর্কের ভগ্নিপতির বাড়িতে। সেখানে গিয়ে পড়াশুনা ছেড়ে শুরু করলেন ক্ষেতমজুরের কাজ। ভাসানী যখন শাহজাদপুরে ক্ষেতমজুরের কাজ করেছিলেন তখন সেখানেই পরিচয় হয় পীর নাসিরউদ্দিন শাহ বোগদাদী’র সাথে। পীর সাহেবের এই অনাথ বালকটিকে পিতৃস্নেহে কাছে টেনে নেন। পরে পীরসাহেবের সাথেই তিনি চলে যান ময়মনসিংহ জেলার বল্লাগ্রামে। সেখানে গিয়ে পীর সাহেবে ভাসানীকে আবার মাদ্রাসা ভর্তি করিয়ে দেন।

মক্তবের পড়া শেষ করে শুরু করলেন শিক্ষকতা। মাদ্রাসার শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে চলে যান টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। এখানে বছরখানেক থাকার পর তিনি পীরসাহেবের সাথেই চলে যান আসামে। পীরসাহেবের আস্তানায়। তখন সারাভারতে চলছিল ব্রিটিশবিরোধী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। ভাসানীও জড়িত হলেন দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে। তখন ভারতের বর্তমান উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার। ভাসানী পীর সাহেবের অনুমতি নিয়ে চলে যান  দেওবন্দে। ভর্তি হলেন দেওবন্দ ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি চলল তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড। দেওবন্দ থেকেই শুরু হলো ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন।

দেওবন্দের শিক্ষা শেষ করে ভাসানী আবার ফিরে এলেন আসামে। মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষা দানের জন্য পীরসাহেব তখন আসামের জঙ্গলে স্থাপন করেন ইসলাম প্রচার মিশন। ভাসানীও তখন মিশনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মিশনের কাজ নিয়ে তিনি চলে এলেন বগুড়ার পাঁচবিবিতে। এখানে পরিচয় হয় জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মদ চৌধুরীর সাথে। ভাসানী জমিদার সাহেবের ছেলে-মেয়েদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হলেন। পরে শুধু গৃহশিক্ষকতা নয়, জমিদারী দেখাশোনা করারও দায়িত্ব পেয়ে যান ভাসানী। জমিদারি সংক্রান্ত ব্যাপারে ভাসানীকে প্রায়ই কলকাতায় যাতায়াত করতে হত। কলকাতায় বিপ্লবী দলের কিছু কর্মীর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন উপলক্ষেই ভাসানী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ পান। ভাসানী তখন থেকেই দেশবন্ধুর অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালেই ভাসানী অনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং অসহযোগী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনে নেমে গ্রেফতার হন। তাঁর নয় মাসের জেল হয়। এটাই ভাসানীর প্রথম কারাবরণ। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯২১ সালে তিনি আলিভ্রাতৃদ্বয় অর্থাৎ মওলানা মোহাম্মদ আলি এবং শওকত আলির ডাকে খেলাফত আন্দোলন এবং একই সাথে দেশবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করলেন। আবারও গ্রেফতার হলেন তিনি। ১৯২২ সালে উত্তর বঙ্গ ও আসামে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। বিপন্ন মানুষের সেবায় এগিয়ে আসেন ভাসানী। কলকাতা থেকে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষ বসুসহ আরও অনেকে। ভাসানী এইসব জাতীয় নেতার সাথে দুঃস্থ মানুষের সেবায় দিনরাত কাজ করতে লাগলেন।

১৯২৫ সালে তিনি বগুড়ার জমিদার শামসুদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরীর কন্যা আলেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। বিয়ের একবছর পর তিনি স্ত্রীকে নিয়ে ফিরে যান আসামের ভাসানচরে। ১৯২৬ সালে তিনি আসামে শুরু করেন ‘কৃষক আন্দোলন’। তখন সব জমিদার মিলে ইংরেজ গভর্নরকে দিয়ে মওলানা ভাসানীকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করলেন। ভাসানীকে বাংলা থেকে বহিষ্কার আদেশ জারি করা হল। অবশেষে ভাসানী স্ব-পরিবারে গিয়ে ঠাঁই নিলেন আসামের গহীন জঙ্গলে-ঘাগমাড়া নামক এক জায়গায়। সাংগঠনিক কাজের জন্য মাঝে মাঝে কলকাতা বা অন্যান্য জায়গায় যেতে হলেও ভাসানী ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত লাগাতারভাবে আসামেই

তিনি জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের মানুষের কাছে 'মজলুম জননেতা' হিসাবে সমধিক পরিচিত। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনি রাজনৈতিক জীবনের বেশীরভাগ সময় তিনি মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারা রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের কাগমারী সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকদের 'ওয়ালাইকুমুসসালাম' বলে সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার ঐতিহাসিক ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন।

সাম্যবাদের আদর্শ, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের কন্ঠস্বর, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অন্যতম পুরোধা। মানুষের কল্যাণের জন্য যিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তার নাম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি ছিলেন নির্যাতিতদের অধিকার বঞ্চিক শোষিত নেতা, বাঙালির প্রতীক্ষিত একজন জন ও জাতীয় কর্ণধার, যা স্বাধীনতার এত বছর পরেও একটি স্বাধীন দেশে খুঁজে পাইনি। তিনি আমরণ সংগ্রাম করেছেন বাঙালির অধিকার আদায়ে, ইসলামী সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার। মানুষের জন্য স্বার্থহীন ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বিলিয়ে দিয়েছেন তার রাজনৈতিক জীবন।  তাঁর সারাজীবন পর্যালোচনা করলে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তার সম্পর্কে বলা ‘ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার নির্যাতিত মানুষের নেতা মাওলানা ভাসানী’ কথাটির সত্যতা ফুটে উঠে। অন্যায় আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার ছিল আপসহীন সংগ্রাম। এই সংগ্রাম ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে। ছিল পাকিস্তানের স্বৈরচারী শাসকদের বিরুদ্ধে। এই চিরকালীন বিল্পবী পুরুষ কখনো আপোষ করেননি ক্ষমতা আর অর্থের সাথে এবং ক্ষমা করেননি কোন স্বৈরশাসককে। ভাসানী জীবনের সমস্ত সময়ই ব্যয় করেছেন গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে।

১৯৬৪ সালে চীন থেকে ফিরে এসে মাওলানা সাহেব ইসলামী সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়েছিলেন। এ নিয়ে তাঁর দল ন্যাপের কমিউনিস্ট সদস্যরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। ওই সময়েই বাম রাজনীতিরধারা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। রাশিয়া মাওলানা সাহেবের চীন সফরকে ভাল চোখে দেখেনি। ফলে বাম রাজনৈতিক দলগুলো চীনপন্থী ও রুশপন্থী হিসাবে পরিচিত হতে থাকে। ৬২ সালে মাওলানা সাহেব চীন গিয়েছিলেন সরকারের অনুরোধে। জেনারেল আইউব মাওলানা সাহেবের কাছে ওয়াদা করেছিলেন চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হলে সকল রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়া হবে। ওই সময়েই পূর্ব পাকিস্তানের সকল বামপন্থি নেতা মুক্তি লাভ করেন। যারা আন্ডারগ্রাউন্ডে বা পলাতক ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে জারি করা হুলিয়া তুলে নেয়া হয়। মাওলানা সাহেবের উদ্যোগেই চীনের সাথে পাকিস্তানের সু-সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। যা বাংলাদেশ হওয়ার পরেও অব্যাহত থাকে।

১৯৪৯ সালে মাওলানা সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলে শেখ সাহেব নতুন দলের যুগ্ম সম্পাদক মনোনীত হন। ৫৪ সালের নির্বাচনের জন্যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে আওয়ামী মুসলীম লীগ ছিল প্রধান দল। তার সাথে শেরে বাংলার কৃষক প্রজা পার্টিসহ আরও বহু ইসলামিক ছোটখাট দল ছিল। তাঁর কাছে লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল শুধুই জনগণের খেদমত করা এবং জনগণকে অধিকার সচেতন করে তোলা। আসামে থাকতেও তিনি আসাম মুসলীম লীগের সভাপতি ছিলেন। স্যার সাদুল্লাহ ছিলেন তাঁরই দলের প্রধানমন্ত্রী।

মওলানা ভাসানী লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিলেন ১৯২৫ সালে। ১৯৩৭ সালে ভাসানী আসামের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে আসামের বারোটি জেলায় মুসলিম লীগের সংগঠন আরও জোরদার হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনেই আসামের ৩৪ আসনের মধ্যে ৩১ টি আসন লাভ করে। ভাসানী নিজেও আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। মুসলিম লীগের মন্ত্রীপরিষদ গঠিত হওয়ার পরও ভাসানী তাঁর লাইনপ্রথা ও বাঙাল খেদা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগলেন। ফলে সরকারের সাথে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটে। কেন্দ্রীয় লীগ নেতৃবৃন্দ তাঁকে নিজদলীয় সরকারের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু ভাসানী তার আর্দশের প্রতি অবিচল রইলেন। ১৯৩৮ সালে তিনি রংপুরে গাইবান্ধায় কৃষক প্রজা সম্মেলনের আয়োজন করলেন।

১৯৪০ সালে তিনি জননেতা এ কে ফজলুল হকের সাথে মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। আসামের লাইন প্রথাবিরোধী আন্দোলন থেকে সরে থাকার জন্য স্বয়ং মুহম্মদ আলি জিন্নাহ পর্যন্ত তাঁকে অনুরোধ করেন। কিন্তু জিন্নাহর প্রস্তাবও ভাসানী প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে ভাসানীর আন্দোলনের মুখে ১৯৪৬ সালে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই আসামের মুসলিম লীগ সরকারের পতন ঘটে। তবে পুলিশ বাঙালীদের ওপর গুলি চালায় এবং একজন নিহত হয়। ভাসানী  গ্রেফতার হন।

১৯৪৭ সালের ২৯ জুন ভাসানী গৌহাটি কারাগার থেকে ছাড়া পান। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি ছুটে এলেন সিলেটে। পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব মুহুর্তে সিলেট পাকিস্তানের অংশ হবে কি না এই নিয়ে গণভোট হয়। ভাসানী সিলেটকে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্তকরণের পক্ষে সমর্থন করেন। এই আন্দোলন সফল হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগষ্ট ভারতবর্ষ দ্বিখন্ডিত  হয়ে জন্ম নিল দু’টি পৃথক রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আসাম সরকার মওলানা ভাসানীকে অবিলম্বে আসাম ত্যাগের নির্দেশ দেয়। তিনি ফিরে এলেন টাঙ্গাইলের কাগমারিতে। ১৯৪৮ সালে প্রথম পূর্ববঙ্গ পরিষদের টাঙ্গাইল আসন শূন্য হলে ভাসানী উপনির্বাচনে অংশে নেন এবং খাজা নাজিম উদ্দিন মনোনিত প্রার্থী জমিদার খুররম খান পন্নীকে পরাজিত করে পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু খাজা নাজিম উদ্দিন ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই উপনির্বাচন বাতিল ঘোষণা করেন। ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় ফিরে এলে মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ভাসানী একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়। গঠিত হয় হক-ভাসানী-সোহারওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। প্রণয়ন করা হয় ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচী, যার অন্যতম ঘোষণা ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন। দেশবাসী আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন সহ ২১ দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন করে যুক্তফ্রন্ট জয়যুক্ত করে। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসনীর সাথে সাধারন সম্পাদক হলেন শেখ মুজিবুর রহমান।শুধু তাই নয় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত যাতে ভাসানী কোন নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে এই মর্মেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর ২ এপ্রিল মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে যুক্তফ্রন্টের সভায় শেরে বাংলা এ কে এম ফজলুল হক সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে বার্লিনে শান্তি সম্মেলনে যোগদানের জন্য ভাসানী লন্ডন সফরে যান। কিন্তু তিনি পাকিস্তান সরকারের চক্রান্তের ফলে জার্মানি যাবার ভিসা পেলেন না। তিনি বিদেশে থাকাকালীন শুনতে পান পূর্ববঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করা হয়েছে এবং যুক্তফ্রন্ট নেতাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাই সেই মুহূর্তে তিনি দেশে ফিরতে পারেননি।

পরে ১৯৫৫ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ভাসানীকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল কাগমারি সম্মেলন। ভাসানীর উদ্যোগে এই কাগমারি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালে। ভাসানীর সেই কাগমারি সম্মেলনের ফল বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন শেখ মজিবুর রহমান। সেই বছরই তিনি আওয়ামী লীগের সাথে সর্ম্পক ছিন্ন করে নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। ১৯৬৭ সালে ন্যাপ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ভাসানী হলেন চিনপন্থি ন্যাপের সভাপতি অপর দিকে মস্কোপন্থি ন্যাপের সভাপতি হলেন অধ্যাপক মুজাফর আহমদ। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হলে সারা দেশে গড়ে ওঠে আন্দোলন। ভাসানীও এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলার বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরীক হন। আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু বের হয়ে আসার পর আইয়ুবিরোধী তথা পূর্ব পাকিস্তানের আন্দোলন আরও জোরদার হয়।

ষাটেরদশক জুড়ে মাওলানা ভাসনী স্বাধীনতার চেতনা সমগ্র দেশময় ছড়িয়ে দেন। কখনো পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন, কখনো লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের কথা বলে দেশ উত্তাল করে তুলেছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর একনায়ক আইয়ুব খান ঢাকায় এলে পল্টন ময়দানের জনসভায় দাবি করেন লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারী বামপন্থী ছাত্র ও কৃষক নেতা আসাদুজ্জামানের জীবনদানের মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের রূপ নেয় গণ-অভ্যূত্থানে। মাওলানা ভাসানীর স্বাধীনতার দাবিটি সুস্পষ্টভাবে সামনে আসে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী ঘুর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর। সব দল তখন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত। ভাসানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি সকল নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে চলে যান উপদ্রুত এলাকায়। ঢাকায় ফিরে এসে পল্টনের জনসভায় তিনি বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি বলেন, ‘ওরা কেউ আসেনি। ওরা আমাদের কেউ না। ওরা আমাদের মানুষ মনে করে না। দেন দরবার হয়েছে। দাবী পেশ করা হয়েছে, আর নয়।

১৯৭০ সালে ৭ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে মাওলানা ভাসানী অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া খান যখন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করতে লাগলে মাওলানা ভাসানী বজ্র কন্ঠে বললেন ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, বলি অনেক হইয়াছে কিন্তু আর নয়’। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। মাওলানা ভাসানীর জীবনের আরেকটি বড় কাজ হল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন মুক্তিযুদ্ধেও আগেই ১৯৭০ সালের ৮ ডিসেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় তা বাস্তবরূপ লাভ করে।

১৯৭১ এর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলন এর প্রতি সমর্থন প্রদান করেন এবং ১৮ জানুয়ারী ১৯৭১ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদানের জন্য তার প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত যান এবং মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন। ২৫ মার্চ রাতে মওলানা ভাসানী সন্তোষে তার গৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনি পাকিস্তান বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে টাঙ্গাইল ছেড়ে তার পিতৃভূমি সিরাজগঞ্জে চলে যান। পাকিস্তানবাহিনী তার সন্তোষের বাড়িটি পুড়িয়ে দেয়। মওলানা ভাসানী মোজাফ্ফর ন্যাপ নেতা সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমানা অভিমুখে রওনা হন। অবশেষে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মইনুল হক চৌধুরীর সাহায্যে মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলাম ১৫/১৬ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ অতিক্রম করে আসামের ফুলবাড়ী নামক স্থানে উপস্থিত হন। পরে তাদের হলদীগঞ্জ বিএসএফ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। এরপর মওলানা ভাসানী ও সাইফুল ইসলামকে প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর প্যালেসের ৫তলার একটি ফ্ল্যাটে তাদের অবস্থানের জন্য দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর্বে মওলানা ভাসানী একটি বিবৃতি প্রদান করেন যা ভারতীয় বাংলা ও ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া মওলানা ভাসানী চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছে তার বার্তা পাঠিয়ে তাদের অবহিত করেন যেন পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকহারে গণহত্যা চালাচ্ছে। সেজন্য তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অনুরোধ করেন এই মর্মে যে, তিনি যেন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ না করেন। উপরন্তু মওলানা ভাসানী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কাছে পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের ওপর যে বর্বরোচিত অত্যাচার চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেন। ৩১ মে মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জীবনমরণ সংগ্রামে লিপ্ত। তারা মাতৃভূমি রক্ষার জন্য বদ্ধপরিকর। তারা এই সংগ্রামে জয় লাভ করবেই। ৭ জুন মওলানা ভাসানী এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের সব অঞ্চল আজ দশ লাখ বাঙালির রক্তে স্নাত এবং এই রক্তস্নানের মধ্য দিয়েই বাংলার স্বাধীনতা আসবে।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দু’বার কোহিনুর প্যালেসে এসে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং তার পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বদলীয় চরিত্র দেয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয় যার সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। ওই উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন ১. তাজউদ্দীন আহমদ, ২. মণি সিং, ৩. অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, ৪. মনোঞ্জন ধর প্রমুখ। মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ওই উপদেষ্টা কমিটির সভায় এই মর্মে অভিমত ব্যক্ত করা হয় যে, পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেক অন্য কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান গ্রহণযোগ্য হবে না।”

ভারত সরকারের গঙ্গানদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ তৈরির প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালে তিনি মিছিল বা লং মার্চ করেন। এটা ছিল তাঁর সংগ্রামী জীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা।১৯৭৬ সালে ৫ এপ্রিল তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রথমে ২৮ মে তাঁকে ঢাকার পিজি হাসপাতালে পরে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখানেই ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মাওলানা ভাসানী পরলোক গমন করেন। তাঁকে টাঙ্গাইলের সন্তোষের ইসলামীয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সমাহিত করা হয়। [সিরিজের শেষে তথ্যসূত্র দেয়া আছে]

 

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ