প্রতিদিনই ভাবি আজ কিছু লিখবোই। কিন্তু দিনশেষে রাত নেমে ফুরিয়ে গেলেও লেখারা আসে না আমার কাছে। ডেকে ডেকে কেবলই ক্লান্ত হওয়া, ক্লান্তি শুষে নিতে দু'চোখ উপচে ঘুম আসে কিন্তু শব্দেরা নীরব! আচ্ছা, শব্দদেরও কি লকডাউন আছে?

চলছে পবিত্র মাহে রমজান। একমাসের সিয়াম সাধনার কাঙ্ক্ষিত মাস! এমন কে আছে যিনি জীবনে একবার হলেও এইমাসের সবগুলো রোজা রেখে ইবাদতে সম্পূর্ণতা লাভ করতে চাইবে না!

গতবছর এইদিন গুলোতে আমরা অবরুদ্ধ ছিলাম, এই বছরেও ব্যতিক্রম হয়নি। কেউ আমাদের জোর করে অবরুদ্ধ করেছে বলা যাবে না, আমরা নিজেরা নিজেদের ভালো রাখতেই বদ্ধ জীবন মেনে নিয়েছি।

ছোটবেলায় রোজা কেবলই আনন্দের বিষয় ছিলো, বড়োবেলায় এসে শিখেছি সংযম। আত্মসংযম আর সৃষ্টিকর্তার নিকট একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণ।

সেহেরিতে না খেয়ে থাকলেও খেতে না পারার হাহুতাশ তখন ছোটোবেলায় কারো মুখে শুনতে পেতাম না, এখন মানুষ বেশি বেশি খেয়েও ইফতার পর্যন্ত হতাশায় ভোগে ঠিকঠাক সেহেরি না খেতে পারার বেদনায়।

বড়োবেলায় এসে দেখি ইফতারে খেজুর, মুড়ি,ছোলাবুট আর পাহাড়ি বরফের শরবতের পাশের জায়গাটুকুতে বার্গার পাস্তার দৌরাত্ম্য! আরও কতশত নামের খাবারের ভীড়ে হারিয়ে গেছে আমার ছোটবেলার ইফতার। শুধু কি তাই? কালের বিবর্তনে রমজান মাস হয়ে গেছে রামাদান, সেহেরিকে নাকি সাহরি বা সাহুর বলার নিয়ম হয়েছে! আবার যারা আরও আপডেট তারা বলে সেহেরি পার্টি, ইফতার পার্টি! এগুলো জানলাম এইক'দিনের ফেসবুক ফিড ঘেটে।

 

নিকট অতীতে দেখেছি, ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের বৃদ্ধ দাদু/নানুর হাত ধরে মসজিদে যাচ্ছে একটু ভালো ইফতার খাবারের জন্য। সবার বাসায় সেহরি ইফতারে রকমারি খাবার থাকবে এটা তো নয়, সেহেরি খেতে পাক বা না-পাক ইফতারের জন্য অনেক স্বল্প আয়ের লোকগুলো মসজিদের ভরসায় থাকতো। করোনার কারণে মসজিদ গুলোতে ইফতার বিতরণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কেমন আছে ঐসব মানুষ গুলো, কেউ কি জানার চেষ্টা করছি?

রোজার মাস এলেই কিছু মানুষের কি জানি কি হয়! তাদের মুখে মুখে একটা দারুণ প্রশ্ন ঘুরতে থাকে,

❝ আজকে রোজা রেখেছেন? সব গুলো রাখছেন?  ছিঃ ছিঃ রোজা রাখেন না কেন, রোজা না রাখা ভীষণ পাপ, একটা রোজা বাদ দেয়া মানে আপনার জীবনের........ ❞

বেশিরভাগই উত্তর দেয়, হ্যা রোজা রেখেছি, (মিথ্যাও বলে)

কেউ উত্তর দেয়, ইয়ে, সব রাখতে পারি না, এই প্রব্লেম সেই প্রব্লেম।

বলি, ভাই/আপু খালু-খালাম্মার দল, আপনাদের কি খেয়েদেয়ে কাজ থাকে না? আপনি রোজাদার, তারমানে এই নয় আপনি আরেকজনকে রোজার ব্যাপারে বিব্রত করবেন। মুসলিম মাত্রই জানেন রোজা রাখার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে। তারপরেও কেন তাকে প্রশ্ন করেন!  হতে পারে আপনার এই প্রশ্নের জন্যেই সে রোজা না রেখে লজ্জায় মিথ্যা বলতে বাধ্য হচ্ছেন। কেন তাকে মিথ্যে কথা বলিয়ে আপনার নেকি কমান!

আর, যারা রোজা না রেখে  বলেন রোজা রেখেছি/ রাখছি। কেন এমন বলেন!  যিনি আমাদের উপর রোজা রাখাকে ফরজ করে দিয়েছেন, সেই আল্লাহ তায়ালার ভয়/ভালোবাসা আপনাকে দিয়ে রোজা রাখাতে পারেনি, আর মানুষের কাছে লজ্জিত হবার ভয়ে এতবড় মিথ্যা বলে দিচ্ছেন!!

 

পাঁচজন শ্রমিক নিহত হলো , আমরা চুপচাপ দেখলাম,

৭১ টিভির রিফাত মরে গেলো সন্তান জন্ম দিয়ে, ভদ্র ভাষায় শোক করাও যে নিষেধ তাও এক শ্রেণীর মানুষ বুঝিয়ে দিলো!

সুইসাইড নোট লিখে মুগদা হাসপাতাল থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন এক পঞ্চাশোর্ধ ব্যাক্তি।  একাকীত্বে কাছে তার টাকা পয়সা মূল্যহীন হয়ে ছিলো।  আত্মীয়-সজন, বন্ধু, পরিবারের কেউ ছিলো না তার পাশে। সুইসাইড নোটে লিখে গেছেন আত্মীয়দের সবাই থাকেন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত সব দেশে। একাকীত্ব সহ্য করতে না পেরে তিনি আত্মহত্যা করেছেন!!

বাংলাদেশ চলচিত্রের স্বনামধন্য নায়িকা, সাবেক সদস্য কবরী করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ফেসবুকে তার জীবিতকালে দেয়া কিছু সাক্ষাৎকারের অংশ ঘুরে বেড়াচ্ছে, ❝ জীবনে ভালো একজন বন্ধু পেলাম না, ভালো একজন স্বামী পেলাম না, সন্তানরাও যে যার মতো! কারো সাথে বসে এক কাপ চা খাবো, মনের কথা খুলে বলব- তা পেলাম না❞

খ্যাতনামা কলামিস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রফেসর তারেক শামসুর রহমান এর লাশ  উদ্ধার করা হয়েছে তার বাসা থেকে। তিনি ঐ বাসায় একা থাকতেন। গৃহকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন গৃহকর্মী ছিলো, সেই প্রতিবেশী/ পুলিশকে খবর দিয়ে এনেছিলো। লোকটার স্ত্রী ও কন্যা সব আছে! কিন্তু দেশের বাইরে। তার টাকা, পয়সা, যশ, খ্যাতি, স্বজন, পরিজন, পরিচিতি সবই ছিল। কিন্তু যখন দরকার ছিল তখন কেউ ছিলো না সাথে।

কোমল-কঠিন এই লকডাউনের মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনা থেমে নেই।  কেউ প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে গিয়ে হেনস্তার শিকার হচ্ছে, কেউ ঘুরতে ঘুরতেই দোর্দন্ডপ্রতাপ নিয়ে বাড়ি ফিরছে! বাড়ছে নদীপথে দুর্ঘটনা।

হাসপাতালে সীট না পাওয়া মানুষের হাহাকারে ভারী হচ্ছে রাজপথের বাতাস, আর কেউ কেউ অ্যাম্বুলেন্সটাই ভাড়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছে!

সব দেখে শুনেও মুখে কুলুপ এঁটে ফেসবুক/ইউটিউব  ক্রল করতে করতে আটকে যাই রিসোর্টে! ৫০১ এর জান্নাতিদের দেখা বেশি জরুরী, দেশ-দেশের মানুষ সব গোল্লায় যাক!

কী থেকে কী লিখছি বুঝতে পারছি না। মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। প্রতিদিন কতকিছু ঘটে, ঘটে যায়, সবটা ভুলে ভালো থাকা যায় না। চুপ করে পড়ে থাকার সাধ্য নাই...থাকা যায় না।

 

 

*ছবি - আমার।

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ