স্বচোখের বুড়িমা

ছাইরাছ হেলাল ২০ নভেম্বর ২০১৬, রবিবার, ১১:১০:৩৯অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩২ মন্তব্য

অমৃতের ধ্রুপদী ভক্ষণে গাপুস-গুপুস খাই আনন্দের উৎসব ও ভর্তিপ্লেট খাওয়ার পার্বণে
তৃপ্তিরঢেঁকুরতোলা একটি ছবি ঘরময় ভেসে বেড়াচ্ছে, খা বাবা খা চেটেপুটে খা,
হৃদয়ে খাদ্যের উষ্ণতা নিয়ে অনুসরণ অনুকরণ চালিয়াতি ঢঙ ও নানান ভাব-ভঙ্গিমা
দেখছি আর দেখছি।

চশমিশ আনন্দদম্পতিকে বিবাহোত্তর আমন্ত্রণ, হাল্কা কিন্তু চনমনে বিলাসী ভোজনের,
যদিও এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য ‘বেশ দেরি হয়ে গেছে’ এমন বাক্যাংশ জুড়ে দেয়াই সমীচীন!

এখানে পেট চুক্তিতে খাওয়ানো হয়, নিম্নতম মূল্য চার অংকের কাছাকাছি, দুপুরে পঞ্চাশ ও রাতে সত্তুর রকম খানার দরাজ ব্যবস্থা, আমরা দুপুরের যাত্রী। সাড়ে বারোটা থেকে চারটে পর্যন্ত সাবাড় করার টাইম লিমিট।
প্রায় একটার দিকে আমরা পৌঁছে গিয়ে ডাক্তার+ প্রকৌশলী দের জন্য অপেক্ষা করছি, জিসান এখানে হোস্ট, ঝরঝরে লিফটে যখন এসে পৌঁছাই তখন এটি এত বড় রেস্টুরেন্ট বুঝতে পারিনি, প্রমাদ গুনলাম, দু’আড়াইশো (তার বেশিও হতে পারে) খদ্দের এঁটে যাওয়া স্থানে আমারা দু’জন বাদে আর মাত্র একটি জুটিকে কুটকুট করতে দেখলাম, ‘ব্যাপারনা’ ভাব নিয়ে হেল দোল করে একটি মোক্ষম টেবিল পছন্দ করে অপেক্ষা চালু রাখলাম, দেখি না কী হয় সিস্টেমে।

ঢুকতেই খাবারের সুঘ্রাণে খিদেটা চনমন করে উঠল। সাজানো রাশি রাশি খাবার দেখে আর তর সইছিল না, উফ এখনই যদি ঝাঁপিয়ে পড়া যেতে তাহলে কত কী না হত (আসলে কিছু হতো না, অমন সবারই মনে হয়ে কাজের আগে)! ঐ যে সাগর আর পাহাড়ের সানু দেশে দাঁড়িয়ে ওদের সাথে যুদ্ধের আহ্বানের মত ওদের সাথে! সে যাকগে, যা বলছিলাম,

অতিথীদ্বয় গণক তা বলছি না, এটা এমন না যে পেটের খবর টের পেয়ে সুড়সুড় এসে পড়েছেন, তবে তাঁরা এলেন, হাসির ফুল ছড়িয়ে, গপশপ শুরু হয়ে গেল, চললও, তাদের বাসা বদলের কারণের নবতর সংযোজন হল (আমার বেলায়), কাজের তাগিদে তাদের দু’জনকেই ‘কেলি ফজরে’ না হলেও সকাল সকাল বের হওয়া মাস্ট, ফিরতে ফিরতে রাত, কিন্তু ঘটনা হলো রাতের বাসাটি তেলাপোকাদের পুরোপুরি দখলে থাকে, শুধু তেলাপোকা নয়, আরও কী কী সব পোকারা কিল বিল করে নির্ভয়ে, গুলির বন্দুক থেকে কামান দাগিয়েও এই অসম জংয়ে জয় লাভের সম্ভাবনা তৈরীর বিন্দু মাত্র আলোকবর্তিকার সুলুক সন্ধান না পেয়ে বীর বেশে পশ্চাদপসরণ (ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি) করে নতুন বাসায় টোনাটুনির ন্যায় থিতু হয়ে এ যাত্রা প্রাণ বাঁচিয়েছেন!

লক্ষ্য করলাম কিলবিল বিলবিল কিচিরমিচির গুটুসগুটুস করে সব চেয়ার পূর্ণ হয়ে গেল,
অনেকটা ভোজবাজির মত।

অসহ্য ক্ষুধাজ্বালা নিয়ে অতি দ্রুত সবাই খাবার নিতে গেলাম, কোনটা রেখে কোনটা খাই, কোনটা কী করি ভাবতে ভাবতে কিছুটা নিজে, কিছুটা অকুতোভয় চশমিশদের সাহায্যে এ যারা উৎরে গিয়ে সবাই মিলে খেতে শুরু করলাম, জিসানের অতিথিবৃন্দ খেলেন! খেলেন বটে মহা সমারোহে! কোনটি নখে তুলে, কোনটি এক চিমটি কোনটি আধা চামচ খেয়ে ফেললেন, মালিক পক্ষ নিশ্চিত ভাবে তাদের জন্য বিশেষ কোন দোয়া খায়ের করেছেন।
এহেন পুণ্য কর্মের ছোঁয়া আমাদেরও গ্রাস করে ফেলল, সব খেয়ে ফেলব থেকে কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না অবস্থা স্থিতি লাভ করল,

মানিকের ফকফকা বাতির মত কিছু বুঝে ওঠার আগেই জিসান সহ তদীয় এই অধম গেস্টে পরিণত করে প্রকৌশলী মহোদয় আগে থেকেই ঠিক করা কাজে ফিরে গেলেন।
যেহেতু চার’টা বাজতে বেশ দেরি তাই আমরা আর একটু থেকে গেলাম, আহারে কিছু খাবার যদি উদরে প্রবিষ্ট করাতে পারি, আর এখানে সবাই কী খাচ্ছে কী করছে দেখে নয়ন সার্থক করি,

সুশৃঙ্খল ভাবে সবাই খাচ্ছে এবং খাচ্ছে, কেউ কেউ পয়সা উসুল পণ করে এসেছে তাও মনে হচ্ছে, চিক চিকে চোখে হাসি-আনন্দে সাবড়ে যাচ্ছে বিশাল বপুর যুবক থেকে তিরতিরে যুবতী, কেউ ই বাদ যাচ্ছে না, প্রকৃত সুন্দরী থেকে কপট সুন্দরী সমানে সমান,
এক দঙ্গল খেলোয়াড় গলগুঞ্জন তুলে চালিয়ে যাচ্ছে। শিশু কিশোররাও কদমে কদমে এগুচ্ছে। অবশ্যই সবাই কিন্তু মালিককে লাটে উঠাবে এমন না, গুটি কয়েক কাষ্ঠং সুন্দরীদের দেখলাম ফোটা তিনেক সুপ সযত্ন সাবধানতায় মুখে ফেলে ফোটা খানেক আবার রঙ্গিন ঠোঁটের রং বাঁচিয়ে মুছেও ফেললেন। আহারে, খাদ্যসুন্দরীর প্রসাধন বাঁচানোর যুগপৎ প্রচেষ্টা।

সব থেকে কাছের টেবিলে বাচ্চাকাচ্চা বুড়ো বুড়ি যুবতী তরুণী মিলিয়ে ডজন খানেক মানুষ গল্পের ছলে হাল্কা খাওয়ায় মেতে আছে, আহা , শিশুদের যে কী আনন্দ তা না দেখলে বোঝানো যাচ্ছে না, ওদের জন্য উঁচু চেয়ার, আছড়ে পাছড়ে উঠছে নামছে খাচ্ছে ফেলছে দেখতে দেখতে হৃদয় জুড়িয়ে গেল।

হঠাৎ এক বেজায় বুড়িমার দিকে চোখ আঁটকে গেল, বার-দুয়েক উঁচু প্লেট হাতে দেখেছি, এবারে আবার! আড় চোখে তাকাতে গিয়েও ধরা পড়ে গেলাম, স্বচোখে ভাল করে একবার মাত্র আমাকে দেখে নিজ কাজে পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন শান্ত মনে, আরও বার দু’য়কে কাবাব সহ অন্য কিছু নিয়ে শেষে বিশাল ডেজার্ট বহর নিয়ে বসলেন, আল্লাহ অসীম রহমত আবারও দেখার সৌভাগ্য হলো।

এবারে শেষ চেষ্টা হিসাবে রুচিবর্ধক দোয়া-কালাম পড়লাম ঈশ্বরের কৃপা লাভের ন্যূনতম আশায়, কিছু যদি গলাধঃকরণ করতে পারি, হা হতোস্মি! আবারও নেয়া খাবারের সদ্গতি করতে পারলাম না, বিফল মনোরথ নিজে হলেও অন্যের সফলতায় মিষ্টিমুখে ঝরঝরে লিফটে চড়ে নেমে এলাম ইটজঙ্গলের চিৎকার চেঁচাচেচিময় জনারণ্যে!
এভাবেই শেষ হতে পারত, কিন্তু না, বিধাতার আড়াল হাসি অবশিষ্ট ছিল।

ফির এসে দুজনে রাতে সুউচ্চ ভবনে বনেদী ডিনারের আমন্ত্রণের কথা ভাবতে ভাবতে টিভিতে খেলা দেখছি, হঠাৎ করেই শুরু হল ঢাক ঢাক গুড় গুড়, বাথরুম সখ্যতা শুরু হতে বেশি টাইম লাগল না!

বুড়ি মার স্বচোখ বার্তা এই আধকানা চোখেও জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠল, “বাছা এবার কেমন লাগতেছে? বুড়ি মার প্লেটে আর চোখ দিও না সোনা”

এই ছিল কপালে? বাথরুম থেকে উকি দিয়ে জিসানকে জানালাম অবস্থা বেগতিক। তার অবস্থা জানতে চাইলাম, সে জানাল “আমালোতো”। দ্রুত ফোন করে রাতের ডিনার বাতিল করতে বললাম,
অল্পতেই রেহাই পেলাম, অবশেষে অল কোয়াইট অন দি বাথরুম ফ্রন্ট।

হে পরোয়ারদিগার, বুড়িমার দিলে রহমতের বান বইয়ে দাও,
আমিন, আমিন,

0 Shares

৩২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ