১৯৭১ এর মার্চের প্রথম দিকে মিসেস লিলি ইসলাম তার পিতার বাড়িতে গেলেন। পঁচিশ মার্চ এর পরে তার স্বামী, শ্বশুর বাড়ি যাবার ইচ্ছে প্রবল হয়। তার শ্বশুর, স্বামী সহ দেবর গণ সবাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতা। শহরের তিনটি আওয়ামী লীগ পরিবার যারা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে আওয়ামী লীগের সাথে যুক্ত, লিলি ইসলাম এর শ্বশুর এর পরিবার তার মধ্যে একটি। ঢাকায় পাকিদের এমন আক্রমনের খবর শুনতে পেয়ে আতংক গ্রস্থ হয়ে পরেন লিলি ইসলাম। চার দেবর ৬৯ এর ছাত্র আন্দোলন এর পরে দু একবার গ্রেফতার হতেন প্রায়ই। ৭১ এ বঙ্গবন্ধুর সমস্ত আদেশ নির্দেশ পালনে এই চার দেবর মুখ্য ভুমিকা রাখেন। স্বামী স্কুলের শিক্ষক এবং ইত্তেফাক সংবাদদাতা। এমনি অবস্থায় তিনি পিতার বাড়ি থেকে স্বামীর কাছে থাকাই শ্রেয় মনে করলেন।

৭১ এ সড়ক যোগাযোগ তেমন ভালো না থাকায়। বরিশালের শিকারপুর বন্দর থেকে ছোট একটি লঞ্চে ওঠেন তিনি, সাথে নেন বড় বোনের ছেলেকে। তার ছয় মাসের ফুটফুটে কন্যা সন্তান সারাক্ষণই কোলে কোলে থাকে। শিকারপুর এর নদীটা বিশাল। নদী পথেই শিকারপুর হতে ঝালকাঠীর যোগাযোগটা ভালো। মার্চের ২৭ এর ঘটনা এটি।

লঞ্চ ষ্টেশন থেকে লঞ্চ ছাড়ল দশ মিনিটের মত হয়েছে। হঠাৎ বিকট শব্দ। লিলি ইসলাম চোখের সামনে দেখলেন তার সামনে বসা বোনের ছেলে দুই ভাগ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলো। আরো কয়েকজন কিছু বোঝার আগেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে মৃত্যুর ছোঁয়া পেলো। ডুবে যাচ্ছে লঞ্চ। মুহুর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ছয় মাস বয়েসি কন্যা সন্তান নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিলেন লিলি ইসলাম। পরনের কাপড়ে জড়িয়ে পরলেন তিনি। কাপড় সামলাতে গিয়ে হাত থেকে ফসকে গেলো কন্যা। পাগলিনীর মত পানির মধ্যে ডুব দিয়ে কন্যাকে খুঁজতে আরম্ভ করলেন। এক সময় আল্লাহার অসীম রহমতে কন্যার জামা হাতে লাগলো, যক্ষের ধনের চেয়েও মূল্যবান কন্যা সন্তানকে এক হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আর এক হাত দিয়ে সাতার কেটে কেটে অবশেষে বিশাল নদীর তীরে পৌছালেন তিনি। নদীর পাড়ে জড়ো হওয়া মানুষদের সহায়তায় উদ্ধার হলেন তিনি কন্যা সন্তানকে সহ। বেঁচে আছে মেয়ে, বেঁচে আছে চিৎকার করে আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করলেন তিনি।

পাক হানাদার বাহিনী কোনো তথ্যের ভিত্তিতে ঐ লঞ্চে বিমান হামলা করেছিল। লঞ্চের খুব অল্প সংখ্যক মানুষ সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন, বাকীরা মৃত। লিলি ইসলাম সাতার জানতো বলে, সর্বোপরি ভাগ্য সহায়তা করেছিল বলেই কন্যা সহ বেঁচে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার পরে কয়েকবছর যাবত লিলি ইসলাম তার বড় বোনের সামনে যা্ন নি। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি অভিযুক্ত করেছিলেন লিলি ইসলামকে যে তার ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিল বলেই ছেলে মারা গিয়েছে। এই ঘটনার পরে ছোট্ট মেয়েটির নাম হয়ে যায় স্মৃতি, ৭১ এর স্মৃতি।

ঘটনার পরদিন লিলি ইসলাম এর স্বামী ঝালকাঠী থেকে একটি স্পিড বোড এ চলে যান শিকারপুর। স্ত্রী এবং কন্যা সহ ফিরে আসেন নিজ বাড়িতে। এরপরে ইতিহাস অন্য অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ইতিহাসের মত। ২৭ এপ্রিল ঝালকাঠীতে পাক সেনারা আসে। কিছু প্রতিরোধ যুদ্ধের পরে তারা দখল করে নেয় ঝালকাঠী শহর। লিলি ইসলাম এর চার দেবর মুক্তিযুদ্ধে চলে যায়। স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি এবং কয়েকজন ছোট দেবর ননদ সহ লিলি ইসলাম এর পলাতক জীবন চলে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ যাবত। ৬ ডিসেম্বর ঝালকাঠী থেকে পাক হানাদার বাহিনী চলে যায়। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ঝালকাঠী পুন দখল করে, শত্রু মুক্ত হয় ঝালকাঠী।

৭১ এর পাকিদের বিমান হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া, মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে আসা ছয় মাসের শিশুটি এখন আমাদের সোনেলার অতি পরিচিত এবং প্রিয় একজন ব্লগার।

শুভ কামনা মৃত্যুঞ্জয়ী বন্যা ইসলাম।  আল্লাহ্‌ তোমাকে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে দূরে রেখে আরো অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখুক,
আমীন............

0 Shares

৫২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ