আমি তখন জাতিসংঘের শান্তি মিশনে কর্মরত ছিলাম!
রহমান মিয়া ভোর হতে না হতেই মসজিদের মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে আযান দিতে লাগলেন।
মসজিদের ঠিক পূর্ব পাশে রাজরাজেশ্বরী মন্দির। মন্দিরের পুরোহিত নিধুভূষণ কাঁসর ঘণ্টা আর শঙ্খধ্বনি বাজিয়ে পূজো দিচ্ছেন।
বেশ কয়েকদিন আগে ছুটি পেয়ে বাড়ি এসেছি।
রহমান চাচা ও নিধুভূষণ দুজনি ছিলেন একে অপরের
বাল্যবন্ধু। একসাথে খেলাধূলা, স্কুলে যাওয়া, অবসরে একে অপরের ধর্ম সম্পর্কে জানা ইত্যাদি।
আর ও কতকিছু।
বাড়িতে আসলেই যাঁরা আমায় দেখতে আসতেন তাঁদের মধ্যে অগ্রভাগে থাকতেন রহমান চাচা ও নিধুভূষন জেঠু। দুজনি আমায় খুবি ভালোবাসতেন।
আজ অন্যরকম লাগছে।
একদিকে শীতের শিউলি ঝরা ভোরের সকাল। অন্যদিকে কুয়াশায় ডাকা আমার বেড়ে উঠা শৈশবের গাঁ। ভোরের উদিয়মান সূূর্যের আলোয় দূর্বাদলের শিশিরবিন্দু খিলখিলে প্রাণখুলে হাসছে।
ভরে উঠেছে প্রকৃতির কোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে পাখির কঞ্জন।
বাড়ির চারপাশ জুড়ে রংবেরঙের সুগন্ধি ফুলের সমাহার। তার মাঝে নানান রঙের প্রজাপতি,মৌমাছি আর ভ্রমরের মধু আহরণের ছুটাছুটি। একদিকে মন্দিরের কাঁসরঘণ্টা,শঙ্খধ্বনি আর মসজিদের আযানের ধ্বনি।
এ দুই আমার কাছে পবিত্র ধ্বনি।
অন্যদিকে পাখির কুঞ্জন, ফুলের গায়ে রংবেরঙের প্রজাপতির ছুটাছুটিতে সেই কবে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে। সে সাথে অসংখ্য শৈশবের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।
রহমান চাচার বউ হাসিনা বিবি ও নিধু জেঠুর স্ত্রী  বিন্দুদেবী দুজনি পুকুরপাড়ে বসে সংসারের কাজকর্মের গল্প করছেন। দুজনের পরিবার দিনে আনে দিন খায়। এ নিয়ে চিন্তা নেই। বলা যায় তাঁদের সুখের সংসার।
সকাল অনেকটা,
তাই আমি বিছানা থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করে পুকুরের দিকে যাচ্ছি। আমায় দেখে দুজনি বলে উঠেছেন কবে এসেছ বাপু?
আমি বলে উঠলাম গতকালকে এসেছি।
তারপর বললাম আপনার ছেলেমেয়ে সবাই ভালো আছেন তো ?
হ্যা রে,বাপু আল্লাহ রহমতে আমার ছেলেমেয়েসহ সবাই ভালো আছি।
রহমান চাচা ও নিধু জেঠুর সাথে দেখা না হলেও বিন্দুদেবীর সাথে গতকাল বাড়িতে দেখা হয়েছিলো।
দুজনি আমায় বললেন উনাদের বাড়িতে যেতে।
আমি সাথে সাথে সম্মতি প্রকাশ করলাম।
এদিক হতে রহমান চাচা ও নিধু জেঠু মসজিদ ও মন্দিরে যারযার কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছেন।
হঠাৎ আমায় দেখে দুজনি জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিলেন। আর বলছেন এতদিন পর তোমায় দেখলাম বাপু। তোমার জন্য আমাগো মনটা কাঁদে।
তবে খুঁজ খবর তোমার বাবা মায়ের কাছ হতে নিয়ে থাকি। তুমি তো জাতিসংঘের শান্তি মিশনে কাজ করো তাই না বাপু?
আমি বললাম হ্যাঁ চাচা।
তোমায় নিয়ে আমাদের অহংকার বাপু।
বললাম চাচা আশীর্বাদ করবেন আমার জন্য। আশীর্বাদ সবসময় আছেরে বাপু।
আল্লাহতালা তোমার মঙ্গল করুক।
রহমান চাচা ও নিধুভূষণ জেঠুকে বললাম আপনাদের কী আগের মতো একসাথে গান গাওয়া, একসাথে মন্দির ও মসজিদে যাওয়া এবং ধর্মচর্চা কী হয়?
একটু গভীর কণ্ঠে, দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রহমান চাচা বললেন সবি হয়রে বাপু।
তবে আগের মতো না!
আমি বলে উঠলাম কেন চাচা?
আপনারা ধর্মচর্চা না করলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা কি শিখবে?
ঠিক বলেছ বাপু।
কিন্তু লোকজন আমাগো নানান কথা কয়রে বাপু।
কেউ কেউ বলে তোমার নিধু জেঠুর সাথে চলাফেরা করব না। একে অপরের ধর্ম সম্পর্কে জানলে বুঝি ধর্ম  চলে যাবে!
রহমান চাচার কথার উপর নিধু জেঠু বলছেন হ্যাঁ রে বাপু, লোকজন যা তা বলে আমাগো দুজনকে।
তাই আর আজকাল একসাথে বেশ বসা হয় নারে। রহমান চাচা ও নিধু জেঠু এ কথা বলে কাঁদছেন আর চোখেরজলে ভাসছেন।
আমি নির্বাক হয়ে পড়লাম।
আর মনেমনে ভাবছি....
আমার শৈশবের বেড়ে উঠা প্রকৃতি আজও সৌন্দর্যে ভরপুর থাকলেও মানুষে মানুষে ধর্মের দোহাই দিয়ে আজ সৌন্দর্যের দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
এজন্মে হাজারের মধ্যে রহমান মিয়া ও নিধুভূষণের আর জন্ম হবে না। কেননা আমরা ধর্মের অন্ধে বিশ্বাসী।
মানুষ মুখে নিজেকে অসাম্প্রদায়িক জাহির করে কিন্তু ভিতরে তার অন্ধত্ব আর কুসংস্কারের বসবাস।
মানবসমাজ বিবর্তন হয়েছে কিন্তু একে অপরের ধর্মের নৈতিকতা সম্পর্কে জানার পরিবর্তন আজও হয়নি!
বছর খানেক পর দেশে ফিরে জানলাম রহমান চাচা আর নিধু জেঠু নেই।
মন্দির মসজিদ আধুনিক হয়েছে কিন্তু আগের মতো কেউ আর ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠে না।
নেই রহমান চাচা আর নিধু জেঠুদের মতো কেউ পাড়ার ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে শুনায় না ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার গল্প।
ছুটি শেষে পুনরায় আমি চলে গেলাম জাতিসংঘের শান্তি মিশনে। আর ভাবি ফিরে কী আসবে আমার শৈশবকাল? আর কী দেখতে পাবো রহমান চাচা আর নিধু জেঠুর একসাথে চলা।
মনের গভীরে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি আজ একে একে ভেসে উঠছে।
অপারে ভালো থেকো দুজন।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ