
– এই আপুমনি দশটা টাকা দাও, খাবো।
– পাঁচ টাকার কয়েন দিলাম। খুচরো নেই, এটা রাখো।
– না নিবনা, হাজার টাকা, লক্ষ টাকা চাইনি; দশ টাকা চাইছি, দশ টাকাই নিব। আমাকে দাও আমি খুচরো দিচ্ছি।
– কি বিপদ! এত জেদী কেন,,,,? কিন্ত তাকে আপু বলব না ভাইয়া। লেগে গেল খটকা। মুখভর্তি দাড়ি তবে শেভ করা; পুরুষালী কন্ঠস্বর, লম্বায় পাঁচ ফুট সাত তো হবেই! আবার হাতে চুড়ি, পরনে স্কার্ট আর প্লাজো। ওড়নাও পড়েছে কিন্তু ঠিকঠাক নেই। আমার কেন যেন মনে হল সহানুভূতি পাবার জন্য কিংবা নিজেকে মেয়ে প্রমাণ করার জন্যই এমনটা করেছে। দশ টাকা করে নিয়ে বাস থেকে নেমে গেল! তারও অধিকার আছে বেঁচে থাকার, সেটা আদায় করেই ছাড়বে এমন একটা ভাব নিয়ে। নেমে যাওয়া সবাই দেখলো এবং অনেকেই হাসলো। আমার কাছে হাসিটাকে মনে হল; কিন্তু কেন? আমি তাকে হাত নাড়লাম।
*********
বাসে লাফিয়ে ছোটখাটো একটি মেয়ে উঠল। কন্ট্রাক্টটারের কাছে সিট চাইছে, সিটেই বসবে। ছোট লাগছে কারন মেয়েটি চারফুট লম্বা। আমার পাশে বসে গল্পে ভরিয়ে দিল। নাক বোচা, কালো বলে অনেক ছেলেই দেখলো কিন্তু কেউ পছন্দ করেনা। এ নিয়ে তার পরিবারে চরম অশান্তুি। কেন বিয়ে হচ্ছে না! এটা হতেই হবে।
– আচ্ছা সে যে দেখতে অসুন্দর, চারফুট লম্বা।সেটা দোষ কি তার? তবে তাকে কেন বকা খেতে হবে? কথা শুনতে হবে? বাড়ি ছাড়া হতে হবে?
আমি মাথা নাড়লাম। কথা তো যুক্তিযুক্ত। তবে তাকে দেখে মনে হল, এ ব্যাপারে সে মোটেও চিন্তিত না। কনফিডেন্ট লেভেল বেশ হাই। ছোটখাটো চাকরী করে সেখান থেকেই ফিরছে। বিয়ে হলে হোক না হলে নাই। এসবে তেমন মাথাব্যথা নেই। ঝটপট নেমে গেল। শুভ কামনা রইলো মেয়ে।
********
এত ভালো ছেলেটার তিন তিনটে বউ চলে গেল। যাবেই বা না কেন? মুখ দেখে কি সংসার হয়? তাছাড়া মেয়েরা লোভী স্বামীর ইনকাম ছাড়া থাকে না। ছেলেটি পড়াশুনায় মোটামুটি ছিল কিন্তু পরীক্ষার আগে আগে অজ্ঞান হয়ে যেত। তাই কোনভাবেই আর পরীক্ষা দেয়া হতনা। একসময় লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। ম্যাট্রিক পাশ ও করা হয়নি। দিনমজুর বাবা মারা গেলে পরল বিপদে। খাবে কি! এরপর এর ওর কাছ থেকে টাকা পয়সা ধার নিয়ে ছোট্ট একটা দোকান দিল। ভালোই চলছিল তাই বিয়ে করল। একদিন মোমবাতি জ্বালিয়ে নেভাতে ভুলে গিয়েছিল, হয়ে গেল সব পুড়ে ছাই। একেবারে নিঃস্ব অবস্থা, নিজেদের খাবার দাবার জোগাড় করা মুশকিল হয়ে গেল। তাই শুরু করল দিনমজুর এর কাজ। কিন্তু তাও পারে না। পয়সা দিয়ে লোকে কি অচল লোক পুশবে! আবার বউ চলে গেল।
এবার ঢাকা চলে গেল। কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাধারণ যোগ্যতাও তার নেই। সুই এ সুতা লাগাতেই দিন শেষ। এভাবে হয়, গেল চাকরী। এভাবে একের পর এক কাজ শুরু করে কিন্তু ঠিকঠাক করতে পারেনা। মানুষ এমন অপদার্থ হয় কাজ বোঝে না। কি আজব তাগরা জোয়ান ছেলে, অকর্মার ঢেকি কিচ্ছু করতে পারে না। সহজ কাজটিও আউলায় ফেলে। এমন মানুষ হয় নাকি? এভাবে তিন নম্বর বউও চলে গেল। অবশেষে সে একাই রয়ে গেল! লোকজনের কাছে চেয়ে চিন্তে খায়। কেউ কেউ বলে, কাজ করে খেতে পারো না মিয়া!
*********
মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, দাঁড়িতে মুখ ঢাকা। তিনি নাকি একজন পুলিশের দক্ষ শুটার ছিলেন। আজ রাস্তায় কেন? ফুটপাতে সংসার পেতেছেন? পরিবারের লোকজন তার খোঁজ আর নেয় না। হঠাৎ হঠাৎ মাথা গরম হয়ে উঠত ঠিকঠাক শুটিং না হলে। একদিন যাচ্ছে তাই অবস্থা হয়ে গেল। টেনশানে সারারাত ঘুম হলোনা। পরদিন আর কাউকে ভালো লাগলো না। অসহ্য হয়ে চলে গেলেন যেদিক-সেদিক। কোন একদিন এই ফুটপাতে হল জায়গা। এখানে থাকতেই ভালোলাগে। কারও জন্য প্রেম, ভালোবাসা, মোহ, মন খারাপ কিছু নেই। এমনকি শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা তাও নেই।
*****
কেউ ইচ্ছে করে অসহায় হয়না কিংবা হাত পেতে সাহায্য চায়না। আমরা তাদের জন্য কিছুই না করে, যুক্তি খুঁজতে থাকি। অথচ কারও একটু সহানুভূতি, অন্যকারও জীবন। তাই অতোশত খোঁড়া যুক্তি না খুঁজে নিজের সাধ্যমতো দূর্রল মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করব। হয়ত কোন একদিন আমারও খারাপ সময় আসতে পারে। সৃষ্টির ভুলের দোষ কারও উপর না চাপিয়ে, আমাদের সবার উচিত সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখা। তাহলেই সব সুন্দর হবে। সবার জন্য শুভ কামনা, শুভ রাত্রি🌹🌹
১৮টি মন্তব্য
রেজওয়ানা কবির
তোমার এই লেখা পড়ে বারবার এইসব অসহায় মানুষের মুখ মনে পরছে, যারা ইচ্ছে করে অসহায় নয়, যারা অসহায় আমাদের সমাজের অচলাব্যবস্থার জন্য । আসুন সবাই যার যেমন উপায়, সেভাবেই সহযোগীতা,সহমর্মীতার হাত বাড়িয়ে দেই সেইসব মানুষের জন্য। ভালো লিখেছ আপু। শুভকামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সবাই সবার মত চেষ্টা করলেই হবে। সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ও ভালোবাসা।🥰🥰
প্রদীপ চক্রবর্তী
কেউ ইচ্ছে করে অসহায় হয়না কিংবা হাত পেতে সাহায্য চায়না। আমরা তাদের জন্য কিছুই না করে, যুক্তি খুঁজতে থাকি। অথচ কারও একটু সহানুভূতি, অন্যকারও জীবন।
সত্যিই আমরা তো পারি আমাদের সাধ্যমত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে।
আমাদের সহানুভূতিতে অন্যকারও জীবন প্রস্ফুটিত হয়ে উঠতে পারে তা আমরা ভাবী না!
তাই সৃষ্টিতে যত ভুল!
.
এমন লেখার জন্য সাধুবাদ জানাই, দিদি।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ দাদা অসম্ভব সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
শুভ কামনা রইলো।🥰🥰
তৌহিদ
প্রতিটি গল্পের পিছনে লুকিয়ে আছে ব্যক্তিগত কষ্টগাথা। কেউ অনুভব করে কেউ আবার পাত্তাই দেয়না। কেউ ইচ্ছে করে হাত পাতেনা, আসলে লজ্জানতভাবে পাততে বাধ্য হয়। আমাদের সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত, তবেই আমরা মানুষ।
ভাবাবেগী লেখা পড়লাম। শুভকামনা আপু।
রোকসানা খন্দকার রুকু
একদম ঠিক বলেছেন ভাই। ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
শুভ কামনা রইলো॥
জিসান শা ইকরাম
বিভিন্ন চাক্ষুষ ঘটনার চমৎকার বর্ণনায় সৃষ্টির কিছু ভুলকে আমাদের মাঝে নিয়ে এলেন।
এমন অসহায় মানুষ আমাদের চারপাশে থাকে, অধিকাংশ মানুষ এদের তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য করে।
আপনার দেখার মানসিকতা ভিন্ন রকম, অন্যদের চেয়ে আলাদা। তাই এমন ভাবে ভাবতে পারেন।
এদের অবহেলা না করে অন্তত ভালো ব্যবহার করতে পারি আমরা এদের সাথে।
অনেক ভালো পোষ্ট।
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমাদের সবার দৃষ্টি বদলাতে হবে ভাই ।
ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।
পপি তালুকদার
জীবনের কঠিন বাস্তবতা শুধু তারাই সহ্য করে আমাদের অনেকের তা অনুভব করার ও শক্তি নেই।যুক্তি না খুঁজে পাশে থাকা একান্ত প্রয়োজন।ধন্যবাদ সুন্দর লেখার জন্য।শুভ কামনা রইল।
রোকসানা খন্দকার রুকু
পাশে থাকা একান্ত প্রয়োজন।
ধন্যবাদ প্রিয় আপু।🥰🥰
মনির হোসেন মমি
প্রথম ঘটনায় আশ্চর্য হলেও এ সমাজের বাস্তবতা।দ্বিতীয় ঘটনায় আত্মবিশ্বাসী মেয়ে নারীরা অনে নির্যাতীত হয়ে অবশেষে পাথর হয়ে যায়।অন্যান্য ঘটনাগুলোর যুবক এ দুনিয়ায় অভাব নেই। ভাগ্য যার বিমুখ তার সব কাজই হয় উল্টোমুখ।তাই আপনার শেষ প্যরার সাথে একমত তাদের তিরস্কার অবহেলা নয় সাধ্যমত পাশে থাকাটা এখন মুখ্য। চমৎকার উপস্থাপনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ভাগ্য বলে আসলেই কিছু আছে।
ধন্যবাদ ভাইয়া অসাধারণ মন্তব্যের জন্য॥
কৃতকৃতজ্ঞতা রইল॥
সুপর্ণা ফাল্গুনী
প্রতিটি ঘটনাই প্রতিনিয়ত ঘটছে ইদানিং। হিজরা সেজে এই ব্যবসা টা খুব রমরমা এখন। এমন ঘটনার আমিও চাক্ষুষ সাক্ষী। খাটো মানুষ দেখলে অনেকে মুখ টিপে হাসে যার জ্বলন্ত প্রমাণ আমি নিজেই। ভাগ্য সহায় না হলে শুধু কাজ করে জীবনে সফলতা খুব কমই আসে। শেষপর্যন্ত সংসার, সঙ্গী, আপনজন সবাই ছেড়ে চলে যায়। চমৎকার পোস্ট। অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।
ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অফুরন্ত
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ দিদিভাই।
মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা রইল।🥰🥰
স্বপ্ন গোধূলি
অসহায়তা মানুষের নিত্তসাথী। কেউ স্বেচ্ছায় অসহায়ত্ব বরণ করে না। ভাগ্য অথবা পরিস্থিতি মানুষকে অসহায় করে দেয়। তবে এটাকে আপন ভেবে দিনপার করার যুক্তি নেই। যারা নিজেদের উপেক্ষিত না ভেবে নিজেকে গড়ে নেয় দিনশেষে তারাই এর থেকে মুক্ত হতে পারে। সব গুলো গল্পই ভালো ছিলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
শুভ কামনা ও কৃতজ্ঞতা রইল।🥰🥰
আরজু মুক্তা
নিজের মতো করে ভাবলে সমাজে সমস্যা থাকতো না।
শুভকামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
শুভ কামনা রইলো।🥰🥰