যমুনার তীরবর্তী নদীবিধৌত অঞ্চল সারিয়াকান্দি থানা। বগুড়া জেলা শহরের সারিয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে রিফাত, রিদয় কিংবা দেওয়ান নামের ছোট্ট মিনিবাসে চড়ে শুরু হবে যাত্রা। টং টং টং টং টং টং- রেলের পাতে হাতুড়ির ঘন্টা বাজলেই কালো ধোঁয়া আর পড়ন্তযৌবনা টাটা ইঞ্জিনের বিকট শব্দে বেপরোয়া ছুটে চলবে  দেওয়ান ট্রান্সপোর্ট নামের রঙচটা, ঘষা খাওয়া মিনিবাস, বগুড়া-ট ১১১২, গেইট লক সিটিং। সিটিং লেখা থাকলেও তা আসলে চিটিং। যাত্রা শুরুর আগে বাসের ভেতরে, ছাদে এবং দরজায় তিল ধারণের জায়গা থাকবে না। সাবগ্রাম পেরিয়ে দেওয়ান ট্রান্সপোর্ট ছুটতে থাকবে ঢিমা তালে লক্করঙক্কর। আর থামবে সড়কঘেঁষা প্রতিটি বাড়ি বাড়ি। সাধারণ কৃষকশ্রেণীর নির্বিকার যাত্রীরা ফুঁকবে উৎকট গন্ধযুক্ত শরীফ বিড়ি। সামনের দিকের সিটে বসা কেরাণী শ্রেণীর চাকুরীজীবী যাত্রীদের কেউ কেউ অনুচ্চস্বরে করবে গজগজ। এভাবে ঢিমা তালে দেওয়ান ট্রান্সপোর্ট রাস্তার দু’পাশের সুবিস্তৃত দিগন্ত প্রসারিত সবুজ ফসলের ক্ষেতের হু হু হাওয়া পেরিয়ে, গোটা চারেক ব্রিজ-কালভার্ট ডিঙিয়ে এসে থামবে গাবতলী হাটে, বিরতি পাক্কা দশ মিনিট। অভ্যাসবশত কিংবা ডায়াবেটিকজনিত কারণে তীব্র জ্বলীয় চাপে কোনো কোনো যাত্রী দ্রুত দোকানের পেছনের পালানে গিয়ে প্রায় কাপড় নষ্ট করতে করতেই র্ছছ্র করে মুত্র স্খলনে নিজেকে প্রশান্ত করবে। এবার দেওয়ান ট্রান্সপোর্ট গাবতলী থেকে ছেড়ে যাবে। পাইলট সরকারি উচ্চবিদ্যালয় পেরিয়ে, একটি রেল ক্রসিং অতিক্রম করে আরো বহুদূর গিয়ে মিনিবাস প্রবেশ করবে সারিবদ্ধ সুপারি বাগানের শোভায় ঘেরা নেপালতলী।
সময় কভার করার জন্য নেপালতলী থেকে দেওয়ান ট্রান্সপোর্ট যেনো চলবে তুফান মেইল। নেপালতলী থেকে আরো বহুদূর, বহু জনপদ পেরিয়ে দেওয়ান ট্রান্সপোর্ট এসে ভীড়বে বাঙালি নদীর ঘাটে। বাঙালি নদী খুবই স্রোতস্বী, পানিতে প্রচুর ধার। যমুনার সাথে বাঙালির কোনো যোগাযোগ নেই। লোকমুখে কথিত আছে বাঙালি নদী যমুনার ভগ্নী। কোনো এক সময় যমুনা-বাঙালি একে অপরের সাথে দেখা করবে, মিলেমিশে হবে একাকার। বাঙালি নদীর ঘাঁটে এসে মাথাপীছু আটআনা করে খেয়া পারাপার। খেয়ায় পার হলেই সারিয়াকান্দি। সারিয়াকান্দি থেকে জলিল ল্যাংড়ার টমটমে  কিংবা ভ্যানে করে অথবা পদব্রজে সাড়ে সাত মাইল উত্তুরে গেলে যমুনার কোলঘেঁষে দেবডাঙ্গা গ্রাম। দেবডাঙা গ্রামের সব ফসলী জমি যমুনার বালি পড়ে গেছে বহু আগে। পেলব উর্বরা জমি হয়ে গেছে ধূধূ বালুচর। কাউন , চীনা বাদাম, কলোসবুজ কচুপাতা বর্ণের পুরু চামড়ার তরমুজ আর টিয়াসবুজ অধিক রসালো রক্তবালির খরমুজ ছাড়া তেমন কিছুই জন্মে না এই বালুচরে। সেই দেবডাঙার বিচ্ছিন্ন দূরবর্তী স্থানে ডোম পাড়া।

দেবডাঙায় মৃত সূর্যাইর আত্মা নিয়ে নিয়ে প্রচলিত ভীতিকর গল্প 
দেবডাঙ্গা গ্রামের ডোমপাড়ায় বহুকাল পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে লোকমুখে লোমহর্ষক এক আশ্চর্য ভীতিকর গল্প প্রচলিত আছে। ডোমপাড়ায় সূর্যাই নামের এক লোক ছিলো খুবই দরিদ্র। সে ডোমদের মধ্যে প্রভাবশালী শ্রীপদের বাড়িতে শুয়োর পালের রাখোয়ালের কাজ করতো। শ্রীপদের বোন রাম্বাকে ভালোবাসার অপরাধে কৌশলে শ্রীপদ সূর্যাইকে বাজিতে হারিয়ে দেয় এবং যমুনার ডাকাতমারী চরে নিয়ে গিয়ে তার দুই চোখ নির্মমভাবে তুলে নেয়।  অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণে সূর্যাই মারা যায়। রাম্বাকে জোর করে বিয়ে দিলে তার বিয়ের দিনই সে বিধবা হয়ে যায়। রাম্বাকে শ্রীপদ ধর্মের দোহাই দিয়ে সতীদাহে রাজী করায় এবং চিতায় জ্বালিয়ে দেয়।
সূর্যাই মারা যাবার পর শ্রীপদ এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ রামু এবং কৃষ্ণা যমুনার তীরের দেবডাঙার ফসলী জমিতে সূর্যাই-এর দু’চোখ পুঁতে দেয়। চোখ পুঁতে দেয়া স্থানে একটা বেল গাছ জন্মে। তখন থেকেই দেবডাঙা গ্রামের ফসলী জমি নিষ্ফলা হতে থাকে, জমিতে বালু পড়ে বালুচর হয়ে যায়-এমন কথা প্রচলিত সে গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। সেই গাছ একবার সেই গ্রামের আফাজ খাঁ কাঁটতে চাইলে সে স্বপ্নে দেখেছিলো যে, কেউ তাকে গাছটি না কাটার জন্য নিষেধ করছে। তাতে তার অমঙ্গল হবে। সে কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে বেল গাছের কাণ্ডে কুঠার চালাতেই তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়েছিলো। আফাজ ভয় পেয়ে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে আত্মহত্যা করে। একসময় বাজ পড়ে বেল গাছটি মৃত্যুবরণ করে কিন্তু আফাজের এই পরিণতির কথা মনে করে কেউ আর ওই মরা বেল গাছটি কাটার সাহস করতে পারে না। একদিন ভরদুপুরে জমশেদ পাঠান নামে গ্রামের এক বলি চরের মধ্যে ওই মরা গাছটার সামনে দিয়ে আসার সময় হঠাৎ দেখতে পায় বেল গাছটার নীচে একজন অন্ধ লোক কি এক করুণ সুরে গান গাইছে। জমশেদ ভয়ে ভয়ে একটু নিকটবর্তী হলে সে দেখতে পায় লোকটি গান গাইতে গাইতে কাঁদছে। ভয় এবং আত্মবিশ্বাসে আরো নিকটবর্তী হলে সে দেখতে পায় লোকটির অন্ধ দু’চোখ দিয়ে অশ্রুর বদলে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। জমশেদ ভয়ে চিৎকার করে ওঠে তখন অন্ধ লোকটি একটা বালির ঘূর্ণি হয়ে মিলিয়ে যায়। জমশেদ চিৎকার করে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়ির উঠানে এসে ধপাস করে পড়ে যায়। বাড়ির লোকজন বের হয়ে জমশেদকে ধরে, মাথায় পানি ঢালে, কি ঘটেছে জিজ্ঞাসা করে। জমশেদ কিছুই বলে না শুধু চিৎকার করে কাঁদে আর চরের ওই শুকনো বেল গাছটির কথা বলে, ‘মাগো! বাজানগো! ওই চরের শুকনা বেল গাছ...!’ রাতে জমশেদের জ্বর হয় সাথে শুরু হয় রক্তবমি। সেদিন ভোরে ফজরের আযানের পর জমশেদ মারা যায়। এমন ঘটনা দেবডাঙা গ্রামের এমনকি পার্শ্ববর্তী দুই-তিন গ্রামের মানুষদের মনেও ভীতি সঞ্চার করে। ভর দুপুরে ওই বেল গাছের আশেপাশে এমনকি চরেও মানুষের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়।

(.......................চলবে)

 

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ