
বছর ঘুরে বিবাহ বার্ষিকির দিনটি এলে মিশ্রানুভূতির দ্বন্ধে আমর সব তালগোল পাকিয়ে যায়। সহস্র প্রাপ্তির ভীড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার সুখের মত ব্যাথায় চিনচিনে অনুভূতিটা ঠিক সুস্পষ্ট নয়! ঘরময় দুটো ফুটফুটে অলকানন্দার ছোটাছুটি মনে করিয়ে দেয়, এমন দিন আমারো ছিল। আমি ও খেলেছি গোল্লাছুট, বৌছি, কানামাছি! আরো কতকি? আট দশ বছর বয়স পর্যন্ত আশেপাশের মাঠে ফুটবল ম্যাচ হচ্ছে আর আমি মাঠ ফেলে ঘরে বসে আছি এমনটা কখনো হয়নি।ফিরে এলে বেধড়ক পিটুনি খেয়েছি বহুবার। তারপর এল ক্রিকেট, ঘন্টার পর ঘন্টা টেলিভিশনে ক্রিকেট দেখে আমি ক্লান্ত হতামনা কখনো।তখন নোবেল বই পড়ার নেশা ও পেয়ে বসেছিল । আব্বার বই পড়তাম লুকিয়ে। একাডেমিক পড়াশোনার পাঠ প্রায় লাটে উঠেছিল। আব্বা খুব রাগ করতেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সেসময় হাতের কাজের খুব প্রচলন ছিল। আমি ও নাওয়া খাওয়া ছেড়ে নিত্যনতুন কাজ শিখতাম। জীবনের অত্যন্ত খারাপ সময়ে এ কাজগুলো খুব কাজে দিয়েছিল। আমার আব্বার অবাধ্য হয়ে করা এ কাজটি একসময় আমাকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাহায্য করেছিল।
যা-ই হোক আজকের এই দিনে আমার দুরন্তপনার সব পাঠ চুকিয়ে বিবাহ বন্ধনে (শেকলে) আবদ্ধ হয়েছিলাম। শেকল বলেছি এ কারণে জীবনের নতুন অধ্যায়ে এসে পেয়েছি শতশত মানা। মানা গুলো আমার ডানা ছেঁটে দিয়েছিল। আমার উড়বার সাধকে অপরাধ বলে রায় দিয়েছিল। আমাদের জনপদে এগুলো হয়ত স্বাভাবিক বিষয় বিবাহিতার জন্য। কিন্তু আমিতো সৃষ্টিছাড়া মেয়ে তাই আমার কষ্ট হত। আমার অদেখা লেখক বন্ধুরা কানে কানে বলত তুই এখানে কেন খাঁচার ভেতর? আশ্চর্যজনকভাবে আমি প্রতিবাদ করতাম। মৌন জবাবে বলতাম আমার ঘর আমার স্বর্গ! সাধারণত বিবাহ বার্ষিকি সম্বন্ধে লিখতে গেলে দাম্পত্য অনুভূতির অংশ /সারাংশ লিখতে হয়। আমি সেদিকে যাবোনা। আমি আমার একান্ত অনুভূতি লিখবো।
সব দাম্পত্য যেমন হয় আমার ও ঠিক তেমনই। আলাদা করে বলার কিছু নেই। কিছুটা মেনে নিয়ে কিছুটা মানিয়ে নিয়ে কিছুটা ছেড়ে দিয়ে, সুখ দুঃখের সরল অঙ্ক কষতে কষতে কেটে গেছে সতেরো বছর।
প্রতি বছর এই দিনটিতে আমি যে বিষয়টি অনুভব করি তা হলো – আমার জীবনের সোনালী দিনগুলো পেছনে ফেলে আসার আরো একটি বছর শেষ হল।
এই তো সেদিন (বিয়ের পরদিন) রুটি সেঁকতে গিয়ে সব রুটি পুড়িয়ে ফেলেছি, সেই তেতো রুটি চোখের জলে ভিজিয়ে খেয়েছি। মুরগী কাটতে গিয়ে সাথে হাতের আঙুলকেও পিস করেছি।আবার কাটা হাতেই রান্না করে খেয়েছি। উল্লেখ্য যে আমি শ্বশুর -শ্বাশুড়ি পাইনি।উনারা আগেই চলে গিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। অতএব আদর শাসন কোনোটাই আমার ভাগ্যে জোটেনি।
বাবার বাড়িতে আমি বংশের প্রথম মেয়ে। সেই সুবাদে সবার কাছে একটু বাড়তি আহ্লাদ আমার ন্যায্য পাওনা ছিল। রান্নাঘরকে আমি বরাবরই সুকৌশলে এড়িয়ে যেতাম। দাদা – দাদী,কাকা-ফুফু এবং আমার আব্বার অতিশয় আদর- যত্ন আমাকে কতোটা অথর্ব করে তৈরি করেছিল তা আমি বিয়ের পর হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।মা কাজের ফরমায়েশ দিলে আব্বা বলতেন ” আমার মেয়ের ভাগের কাজগুলো আমি করে দিব “। হা হা হা ভুতের মুখে রাম নাম আর কি! আব্বাতো নিজেই জল ঢেলে খায়না। মা আর কথা বাড়াতেন না। আমি ও পার পেয়ে যেতাম বিরক্তিকর গেহস্থালী কাজ থেকে। এভাবেই আদরের ফাঁক গলে আমি বড় হলাম অকর্মার ঢেঁকি হয়ে।
সব কাজিনদের আমি বড় আপা। কিন্তু আমি মনে মনে আজও সত্যিকার অর্থে বড় হয়ে উঠতে পারিনি। এখনও আমার ইচ্ছে করে একছুটে পেছনে ফিরে যাই। কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে ওঠার দিনগুলি আমায় বড্ড টানে। সংসার ঘরকন্না আজও আমার আপন হয় উঠতে পারেনি।
দাদা, আব্বা আর বড় ফুফু মারা গেছেন। মা ও চলে গেছেন। যতদিন ছিলেন আমি মায়ের ‘মা’ হয়ে ছিলাম। মেয়ের জায়গাটা হারিয়ে গেছে। কাকার সাথে ওয়ারিশ সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে দূরত্ব আকাশ ছুঁয়েছে। দাদু এখনো আছেন। কয়েকমাস পর দেখা হয়। বুড়ো মানুষটা আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকেন, সারারাত আমার সাথে গল্প করেন। আমি ও সমস্ত বাঁধ ভেঙে বলি সবকথা যা কাউকে বলতে পারিনা। তিনি শোনেন আর আমার গায়ে মাথায় হাত বুলান। আমি ক্ষনিকের জন্য ফিরে যাই শৈশবে যখন সব ছিল রঙধনর মত রঙিন। ছোট ফুফু বিদেশে থাকেন দেখা হয় খুব কম। কিন্তু প্রায়ই গল্প হয় ভিডিও কলে। তাঁর সাথে জ্যাঠামিটা আমার এখন ও রয়ে গেছে। ওঁর সাথে আমার বয়সের ব্যবধান ১০/১১ বছর।ফুফু আর আমি খেলার সাথী ও।
দায়িত্বের শেকলে বেঁধে ছোট ভাই বোনেরা আমাকে বড়র আসনে বসিয়ে দেয়। মুখে কিছু না বললেও আমার অন্তরাত্মা ঠিকই বলে, আমি বড় হতে চাই না। কেউ কি আছে?
আমাকে আমার বালিকা বেলা ফিরিয়ে দেবে!
১৮টি মন্তব্য
নার্গিস রশিদ
আহারে এত সুন্দর করে এই অনুভূতি গুলো লেখা হলো । যা মোটামুটি সব মেয়েদের কমন অনুভূতি । এক কথায় চমৎকার। যে বালিকা বেলাতে আর কখনো ফেরা যাবেনা। সময় যে আমরাকে ভাগ করে করে বড় করে তোলে। অনেক শুভ কামনা ।
খাদিজাতুল কুবরা
অসংখ্য ধন্যবাদ আপা। পড়ে একাত্মতা প্রকাশ করার জন্য। আসলেই এগুলো আমার কথা নয় শুধু আমাদের কথা।
ভালোবাসা রইল আপা
রেজওয়ানা কবির
যদি আলাদীনের দৈত্যের সেই চেরাগ থাকত তবে ফিরিয়ে দিতাম সেই বালিকা বেলা!!! আদৌ বালিকা বেলা ফেরানো সম্ভব শুধু কল্পনায় নয়ত বা স্বপ্নে। এটাই কম কিসে!!! তবে আমিও চাই না কখনোই বড় হতে। ভালো লাগল লেখাটি। শুভ বিবাহ বার্ষিকী।
খাদিজাতুল কুবরা
ছোটু সহজাত শিশুপ্রকৃতি কিছু মানুষের মধ্যে থেকেই যায় আজন্মকাল। আর দুনিয়া তাদের জন্য কঠিন।
অনেক ধন্যবাদ সবকিছুর জন্য।
ভালো থেকো। শুভেচ্ছা সবসময়।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধ্যানে বসে চেষ্টা করে দেখতে পারেন, ফিরতেও পারে ছেলেবেলা। না ফিরলেও কিছুক্ষন তো তাকে নিয়ে চর্চা করা হবে? সেটাই বা কম কিসে! শুভ বিবাহ বার্ষিকী 🌹🌹
খাদিজাতুল কুবরা
আইডিয়া মন্দ না। চেষ্টা করা যেতেই পারে।
ভালোবাসা নিও।
আলমগীর সরকার লিটন
সত্যই এক আবেগময় অনুভূতির প্রকাশ কুবরা আপু ভাল থাকবেন
খাদিজাতুল কুবরা
অসংখ্য ধন্যবাদ লিটন দা। আপনি ও ভালো থাকবেন।
হালিমা আক্তার
তোমার চমৎকার লেখা পড়লাম। আমিও বাবা এবং মায়ের দুদিকের থেকে বংশের বড় মেয়ে। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই সবার বড় আপা হয়ে উঠতে যেয়ে ভেবে চিন্তে পথ চলতে হয়েছে। খেলা ছিল আমার প্রাণ তবে সেটা স্কুলে। বাসায় মায়ের আদেশের হের ফের করা যেতো না। তবে এখন বন্ধু দের সাথে মাঝে মাঝে খুব ভালো সময় কাটে। সেই দিন গুলো আর কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু যতদিন বাঁচি আগল ভেঙ্গে চলতে হবে। শুভ কামনা রইলো।
খাদিজাতুল কুবরা
আপু আপনাকে দেখে খুব শান্ত ধীর স্থীর মানুষ মনে হয়। কিন্তু মন্তব্য পড়ে বুঝলাম ভেতরে ভেতরে আপনি ও শিশুদের মত চঞ্চলা। আমাকে ও দেখে সবাই শান্ত বলে। কিন্তু আমি মোটেই তা নই। ভালো লাগলো আপু অন্ত্যমিল পেয়ে। ভালোবাসা জানবেন।
হালিম নজরুল
জীবনের অভিব্যক্তিগুলো চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন সুন্দর বর্ণনায়।
খাদিজাতুল কুবরা
আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাকে প্রিয় ব্লগার। ভালো থাকবেন শুভেচ্ছা রইল।
প্রদীপ চক্রবর্তী
আমার বালিকাবেলা ফিরিয়ে দেবে!
এখানে আর সশরীরে ফেরা যায় না।
অথচ মানুষের সেসময়ের সমস্ত স্মৃতি যখন মনে করিয়ে দেয় তখন সে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।
আর সোনালী দিনের কথা বারবার মনে করে এবং ফিরে যেতে চায়।
কিন্তু তার পক্ষে সেখানে ফেরা সম্ভব হয় না।
অনবদ্য লিখেছেন, আপু।
খাদিজাতুল কুবরা
অশেষ ধন্যবাদ প্রদীপ উৎসাহ দিয়ে মন্তব্য করার জন্য। ভালো থাকবেন অনেক শুভেচ্ছা রইল।
ছাইরাছ হেলাল
“সাধারণত বিবাহ বার্ষিকী সম্বন্ধে লিখতে গেলে দাম্পত্য অনুভূতির অংশ /সারাংশ লিখতে হয়। আমি সেদিকে যাবোনা। ”
এই বার্ষিকীতে শুভেচ্ছা জানাবো কী জানাবো না সে দিকে যাচ্ছি না।
জ্বলজ্বলে জীবন্ত স্মৃতির প্রতি তা হোক মিষ্টি বা তিতকুটে আমার পক্ষপাত, তাই এ লেখাটিকে সাধুবাদ।
ধুর! আপনি মোটেই ভাববেন না, সে সব বালক/বালিকা বেলা ফিরিয়ে আনা কোন ব্যাপার না!!!!
খাদিজাতুল কুবরা
হা হা হা। আমায় বালিকা থেকে সাবালিকা বানানোর সব চেষ্টাই ব্যার্থ হয়েছে পরিবারের লোকেদের। এখন তারা ক্ষান্ত দিয়েছে।
সুন্দর মন্তব্য পেয়ে মন ভরে গেছে আনন্দে।
ভালো থাকবেন ভাইয়া। অনেক ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
সাবিনা ইয়াসমিন
বালিকা বেলায় ফিরে কী লাভ! আবারও যদি সেই-ই পিড়িতেই বসতে হয়! তারচেয়ে এই ভালো, ভালো থাকি আগামীর পথে।
লেখাটা দারুণ হয়েছে।
শুভ কামনা 🌹🌹
খাদিজাতুল কুবরা
খুব চাইছিলাম লেখাটা সাবিনা ও পড়ুক! কেননা আমরা যে একই সুরে গাঁথা গিতী।
মন্তব্য পেয়ে ভালো লেগেছে খুব।
অনেক ধন্যবাদ