সিঙ্গারা

ফজলে রাব্বী সোয়েব ১০ মে ২০২০, রবিবার, ০৫:০০:৩২পূর্বাহ্ন গল্প ১০ মন্তব্য

সকাল দশটা। বাসা থেকে বাজার করার জন্য বের হয়ে গেলেন রফিক সাহেব। বাজারে ঢোকার ঠিক আগ মুহূর্তে থমকে গেলেন। জীর্ণকায় চেহারার দশ-বার বছরের একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আনমনা হয়ে কিছু একটা দেখছিলো।মিষ্টি চেহারা, হাসছে না, কিন্তু তারপরও গালে টোল পড়ে।মুখটা মায়ায় ভরা।

“কিরে, নাম কি তোর?”

“রফিক। আইন্নের কি নাম?” ছেলেটা পাল্টা প্রশ্ন করে।

হেসে ওঠেন রফিক সাহেব। “কিরে, তোর নাম আর আমার নাম তো দেখি একই।”

কি বুঝলো বোঝা গেলো না, কিন্তু ছেলেটিও হেসে ফেললো।

“খেয়েছিস কিছু?”

ছেলেটি না-সূচক মাথা নাড়ালো।

“চল। তোকে খাওয়াবো।” এই বলে রফিক সাহেব ছেলেটিকে তাকে অনুসরণ করতে বলেন।

একটা কম দামী হোটেল আছে বাজারের পাশে, ওটাতেই তারা বসলো। সিঙ্গারা ছাড়া আর কিছু ছিলো না সেখানে, যদিও রফিক সাহেবের ইচ্ছে ছিল পেট পুরে ছেলেটিকে খাওয়াবে। উপায়ন্তর না দেখে চারটে সিঙ্গারা অর্ডার দিলেন।খাওয়া শুরু করলো ছেলেটা।

“কি করিস? কোথায় থাকিস?”রফিক সাহেব জিগ্যেস করলেন।

“লগের বস্তিত থাকি স্যার।”

“তোর বাবা মা কি করে?”

“মা আছে। মাইনসের বাইত কাম করে। বাপে আরেকটা বিয়া করসে।ব্যাডাডা অনেক বজ্জাত। মারে খালি মারতো।”

“কেন মারতো তোর মাকে?”

“আর কইয়েন না। হারাদিন গাইঞ্জা খায়া টেস হয়া পইরা থাকত। কুন কাম করত না। সহাল বিহাল মার কাছ থাইকা ট্যাহা চাইত। মা ট্যাহা না দিলেই ধুম মাইর চলত। একদিন হইসে কি, মারে মারতাসিল ব্যাডাডা, আমি একটা ইটকা লইয়া দিসিলাম মাতা ফাডায়া। ব্যাডা কাইকুই করতে করে হেই যে গেলো, আর আইল না। আইন্নেই কন স্যার, কামডা ঠিক করসি না?”বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো রফিক ছেলেটা।

রফিক সাহেব কি জবাব দিবেন বুঝতে পারছেন না। সমাজের নিম্ন নিম্নবিত্ত শ্রেণীতে এইসব ঘটনা হর হামেশাই হচ্ছে। তাঁর বাসার কাজের মহিলাটারও একই অবস্থা।তাঁর জামাইও তাকে টাকা না দিলে পিটাতো। কিছুদিন আগে নাকি তাঁর জামাই আরেকটি বিয়ে করেছে।

“কিরে, পড়াশোনা কিছু করিস?”

“না স্যার, বানরামী কইরাই কুল পাই না, আবার লেহাপরা।” ছেলেটা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো।

আহারে, কী মায়াভরা মুখখানা তার। দেখলেই কাছে টেনে আদর করতে ইচ্ছে করে। একদম তার নাতির বয়েসী।

“জানেন স্যার, আমারে ইস্কুলে ভর্তি করসিলো, কয়েকদিন গেসিলামও। কিন্তু বদমাইশ বাপটার লাইগ্যা লেহাপরা করতে পারি নাই। এক থাইকা বিশের নামতা আমি শিখসি দুই দিনে। স্যার আমারে চকলেট আর দশটা টেহা দিসিলো কিসু খাওয়ার লাইগ্যা। বদমাইশ বাপটা হেইডাও নিসিলগা।আমার মায়ে জিগাইতেই কি মাইরটাই না মারল আমগো দুই জনরে।আমি পড়তে চাইসিলাম,তয় আমরা তো গরিব। অত টেহা পামু কই?” এই বলেই ছেলেটি কেমন যেন আনমনা হয়ে গেলো। রফিক সাহেব ছেলেটির দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন যে তার চোখের কোণ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

মনটাই খারাপ হয়ে গেলো রফিক সাহেবের। ছেলেটার কথাবার্তায় বোঝা যায় সে খুব ট্যালেন্টেড।কিন্তু দরিদ্রতা তাকে সে সুযোগ দেয় নি। নাতির মুখখানা আবার মনে পড়ে গেলো তাঁর।আজ তাঁর নাতি ঢাকার একটা স্বনামধন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ছে। অর্থ বিত্ত যে বাংলাদেশে পড়াশোনার একটা বড় প্রভাবক সেটা আবারো চোখের সামনে এলো।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন রফিক সাহেব,এই ছেলের পড়াশোনার দায়িত্ব তিনি নেবেন।

“তোর বাসার ঠিকানাটা দে তো।কাল তোদের বাসায় যাব।”

“ক্যান স্যার, আমার নামে কি মায়ের কাছে বিচার দিবেন?আমি তো কুনো শয়তানি করি নাই?” ভীত সন্ত্রস্ত দেখালো বাচ্চা ছেলেটাকে।

“আরে না না, বিচার দেবো কেন? তোর মায়ের সাথে কথা আছে জরুরি”।

“ওই বস্তিতে গিয়া আমার নাম কইবেন, তাইলেই লুকজন দেহায়া দিব।” বলেই আবার হেসে ভেঙ্গে পড়লো।কখন যে তার খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে টা টের পাননি রফিক সাহেব। তার প্লেট শূন্য দেখে আবার শুধোলেন আরও কিছু লাগবে কিনা?

“আর তিনডা খামু। কাইল রাইত থাইকা খাইনাই কিছুই। খুদা লাগসে স্যার।”

রফিক সাহেব নিজেকে সামলাতে পারলেন না কথাটা শুনে। তাঁর দুচোখ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু ঝড়ে পড়লো। ছেলেটার আরালে চোখ মুছলেন জামার কোণার অংশ দিয়ে।

“জানেন স্যার”-ছেলেটা আবার বলা শুরু করলো। “কাইল এত্ত খুদা পাইসিলো যে আমি চুরি করতে গেসিলাম। মায়ের অনেক অসুখ, বাইত রান্না অয় নাই সকাল থাইকা।খিদায় আমার জান বাইর অইয়া যাইতাসিল। মায়েরও সারাদিন কুনো খাওন নাই। দিসা না পাইয়া কয়েক বাইত গিয়া খাওন চাইলাম, কেউ দিল না।বাসায় চইলা আইতাসিলাম, এমুন সময় রাস্তার লগে দেহি এক বেডা সিঙ্গারা ভাজতাসে।লগে ট্যাহা নাই, কি করমু?পরে মনডায় কইলো চুরি করি। জীবনে কুনো দিন চুরি করি নাই স্যার। কিন্তু কাইল মনডা মানলো না। মায়ে আমার না খাওয়া, কি করমু কন। ব্যাডার দুকান থাইকা তিনডা সিঙ্গারা লইয়া দৌর দিসিলাম। কিন্তু কফালডা খারাপ স্যার, ধরা পইরা গেলাম। আমারে কি মাইরডাই না দিল! এই দেহেন স্যার, আমার ফিডো দেহেন। মাইরা আমারে কি করসে দেহেন।”

শিউরে উঠলেন রফিক সাহেব। বাচ্চা ছেলেটার পিঠে নির্মমতার এ কোন ছাপ এঁকে দিলো তারা! দেখে মনে হচ্ছে বাচ্চাটার পিঠ থেকে একদলা মাংশ খুবলে নিয়েছে এক দল মানুষরূপী হায়েনা। ভেতরটা যেন ছিঁড়ে যেতে লাগলো রফিক সাহেবের।

“চল, ডাক্তারের কাছে চল এখুনি।”

“না স্যার। লাগব না। এমনিতেই বালা অয়া যামু। আইন্নে বাইত যান।” বলা শেষ হতে না হতেই মিলিয়ে চোখের নিমিষেই রফিক কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো।রফিক সাহেবের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। সামান্য কটা সিঙ্গারার জন্য এতবড় শাস্তি পেল ওই বাচ্চা ছেলেটা! অথচ এই সোনার বাংলায় এর চেয়ে বড় বড় চুরি করে একদল শিক্ষিত চোর দিব্যি আছে। না আজ আর বাজারী ভেতর যেতে মন চাইছে না তার। বউকে মানানোর জন্য তার প্রিয় সিঙ্গারা দোকানিকে দিতে বললো। একটা প্যাকেটে করে চারটা সিঙ্গারা দোকানি রফিক সাহেবের হাতে দিলো। প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বাজারের ব্যাগে পুড়তে পুড়তে একটা ইলেকট্রিক শক খেলেন রীতিমত। এ কী দেখছেন তিনি? নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে তার বুকের মাঝে কেউ যেন পুরো একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি ঢেলে দিলো। কাগজের প্যাকেটটা পুরনো একটা পত্রিকার অংশ।একটা বাচ্চা ছেলের লাশের ছবি, আর শিরোনাম হচ্ছে “সিঙ্গারা চুরির অপরাধে নয় বছরের এক নিষ্পাপ শিশুকে নৃশংসভাবে হত্যা করলো একদল মানুষরুপী হায়েনা।চশমাটা খুলে নিয়ে জামার কোণা দিয়ে মুছে আবার চোখে পড়লেন রফিক সাহেব।নাহ, চিনতে তার কোন ভুল হচ্ছে না।এ তো একটু আগেই দেখা হওয়া সেই রফিক।কিভাবে সম্ভব এটা! অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।ভাবনায় আর কিছুই আসছে না তার। শুধু এটুকু বুঝতে পারলেন যে, তার দু চোখ বেয়ে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে। এও সম্ভব আমার সোনার বাংলায়!!!

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ