রসকসহীন ভার্সিটি বন্ধু রায়হানকে বই কিনতে সাধলেই বলে-‘লেখো কেন? তুমি লিখো বলেই তো কিনতে হয়!’ কি অদ্ভূত কথা! তুই না কিনলে না কিনবি তাই বলে এমন নিরুৎসাহী করা কি ঠিক? কেন লিখি আবার? ভালো লাগে তাই! ছবি আঁকাআঁকি, ফটোগ্রাফি, গান শুনা, ঘুরে বেড়ানো সবই তো ভালো লাগার জন্যই। এই ভালো লাগার ক্ষেত্রটা খুব ছোট বেলা থেকেই তৈরী হয়ে গেছে।
সেগুনাবাগিচা বারো তলা বিল্ডিঙের পেছনে বড় চাচার বাসাটায় উত্তর বাংলা থেকে বছরে এক-দু’বার ঈদ করার জন্য ঢাকা এসে যে ক’দিন থাকতাম তার প্রধান আকর্ষণ থাকতো বই পড়ার আকর্ষণ। চাচার দুই ছেলেমেয়ের বুক শেলফ ভরা গাদা গাদা বইয়ের স্তুপ থেকে ঐ দশ পনেরো দিন অনেকগুলো পড়ে শেষ করতাম।
এছাড়াও কারো বাসায় বেড়াতে গেলেও আমার মতো মুখচোরা লাজুক মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যেতো সেই বাসার গল্পের বইয়ের স্তুপের কাছে। হয়তো সেই বাসার বুকশেলফে ধুলো জমে রয়েছে মোছার কেউ নেই বা সময় পায় না। আমার এক বেলার সামান্য ঐ একটু বেড়ানোর ফাঁকে হাতের রুমালটা দিয়েই ঝাড়ামুছা চলতো। তারপরে কোন একটা বই বেছে নিয়ে তাতে নাক ডুবিয়ে দেয়া। এমনটি প্রায়ই হতো বেড়াতে গিয়ে কিছু বই বগলদাবা করে বাড়ি ফেরার ইচ্ছা। কিন্তু যে বাসায় একেবারেই প্রথম বেড়াতে গিয়েছি এবং কম পরিচিত, তাদের সংগ্রহশালা থেকে একটা বই হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা বই সাথে করে দিয়ে দিতে রাজী হতো না। মায়ের বকা খেয়ে মুখ তখন বেজার করে কান্নাভেজা চোখে বাসায় ফিরতে হতো। নিজের বাসার বই জমানোর ব্যাপারটা তখনো এতটা গুরুত্ব পায়নি। বাবা তো পড়াশুনা নষ্টের ভয়ে গল্পের বই পড়তে দেবার ঘোর বিপক্ষে ছিলেন; স্কুলের বই পড়াই যেন জীবনের মূল লক্ষ্য, অন্য গুণগুলো না থাকলেও চলবে। এখন অবশ্য এইসব ভাবনাগুলো তার কিছুটা হলেও পালটে গেছে। তবে বই প্রয়োজনীয় হলে বাবা কিনে দিতেন। সিদ্দিকা কবির’স রেসেপি বইটা বাবা আমাকে প্রাথমিক শ্রেণিতে পড়াকালীনই উপহার দিয়েছিলেন, সেটা এখনো আছে। আর একবার রচনা প্রতিযোগিতার জন্য নবী করিম (সা) এর জীবনী বইটা কিনে দিয়েছিলেন। সেটা হারিয়ে ফেলেছি।
জীবনে প্রথম গল্পের বইটা পেয়েছিলাম মায়ের হাত থেকে। তখন নাটোরে আমরা। কোন শ্রেণিতে পড়ি মনে নেই তবে ছোটই ছিলাম। টাউন হল মার্কেটে গিয়ে যতদূর মনে পরে একটা স্টেশনারী দোকানে এক গাঁদা ছোটদের গল্পের বইয়ের মাঝ থেকে আম্মু আমাকে কিনে দিলেন ‘রাজকন্যা ও সাত বামন’ নামের একটা ছোট সুদৃশ্য প্রচ্ছদের শক্ত মলাটের বই। বইয়ের কভার কাকে বলে তখনো কিছুই জানি না। এতকিছু ভাবতামও না তখন। মলাট সুন্দর হোক বা না হোক কোন গল্প মজা দিতে পারলেই প্রিয় হয়ে যেত। আর ঢাকায় নানুর বাড়িতে বেড়াতে এলেই খালামনিরা রাজকন্যা রাজপুত্রের গল্প শুনাতো। নিজের বই না থাকলেও মোটামুটি একটা গল্পের আবহ ছোট বেলা থেকেই ঘিরে রেখেছিলো সবসময়।
বাবার তুলনায় মেজ চাচা ছিলেন বেশ সৌখিন। ওনারা থাকতেন বগুড়ায়। সেখানেও বছরে ঈদের সময়গুলোতে শুধু যাওয়া পরতো সপ্তাহখানেকের জন্য। আমার এনজিও অফিসার বাবার চাকরীসূত্রে বেশিরভাগ সময়ে প্রত্যন্ত গ্রাম অথবা মফস্বলেই কেটেছে বলে শহরের দোকানে ঘুরাফিরার মতন অত সাহস বা সুযোগ কোনটাই তেমন ছিলো না। একমাত্র আদরের মেয়ে হওয়ার কারণেও বাসা থেকে একলা বেরোবার সুযোগও কম মিলতো। মেজ চাচার বাসায় বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ পেলে আমারই মতন দুটি বইপোকা তার দুই মেয়ে জ্যোতি-সেতুর সাথে কিছু বই কেনা হতো। নিজের হাতে প্রথম বই কিনি কলেজ ফার্স্ট ইয়ারে পড়াকালীন শেখ আব্দুল হাকিম এর ‘প্রথম প্রেম’!
বগুড়া থেকে ঈদ করে রংপুরে ফিরে আসার অনেক দিন পরের একদিনের ঘটনা- একদিন ‘প্রথম প্রেম’ বইটা হাতে নিয়ে আম্মা আমার দিকে তেড়ে এসেছেন-
এই বইটা কে দিয়েছে তোমাকে?
কে আবার? আমি কিনেছি।
তাইলে ভেতরে এই কথা কে লিখলো?
দেখি কি কথা কে লিখছে?
হাতে নিয়ে দেখি -আমারই হাতের লেখা। ভেতরে লেখা ছিলো, "যূথী তোমার জন্যেই যত প্রেম আমার!" লেখাটা পড়েই মায়ের মাথা গরম হয়ে গেছে, হাতের লেখাটা যে তার নিজের মেয়েরই সেটা খেয়াল করেনি। আমি ঘটনা খুলে বলতেই বলেন- ওরে বান্দরে!
কলেজের উঠতি বয়সে যা দেখি তাতেই মুগ্ধতা জড়াতো। হিহি হাহা বেশি হতো। মনের ভেতরে রঙিন স্বপ্নরা বাসা বাধতো। এরকম অনেক মজার কান্ডই ছেলেবেলায় করতাম। আর নিজেই খুব মজা পেতাম। দুষ্টুমীর রকমগুলো এখনো আছে। ছাড়েনি। ছাড়বেও না বোধহয় কোনদিন। কিছু বই যেগুলো একান্তই নিজের কাছে রাখতে ইচ্ছে করে, কাউকে গিফট করিনা সেসব কেনার পরে কভার পেজ এর ভেতরের পাতায় সাদা খালি জায়গাটিতে কালো বল পেনে ‘যূথী, তোমার জন্য আমার এই উপহার/ ইতি তোমার জান’ লিখে রাখি। এরকম অভ্যাস এখনো ছাড়েনি। নিজেকেই নিজে উপহার দেওয়া অনেক বই আছে। বইতে লিখে রাখার উদ্দেশ্য যাতে কেউ বই ধার নিতে না পারে বা নিজের মনে করে নিয়ে না যায়।
বই পোকা আমি সেই ছোট বেলা থেকেই। ঠিক কোন বয়সে প্রথম বইটি হাতে নিয়েছিলাম পড়ার জন্য তা এই মুহুর্তে সত্যিই মনে নেই। তবে, একটা সময় রাক্ষস খোক্কশ ভূত প্রেতের বইই বেশি পড়া হতো। ‘সাত সমুদ্দুর তেরো নদী’ আর ‘বারো হাত কাকড়ের তেরো হাত বিচি’ ভালোলাগার কমন গল্প ছিলো। এই সেদিনও সুয়োরাণী দুয়োরাণীর গল্প পড়েছি। রাজপুত্র ডালিমকুমার, গোপালভাঁড় আরও কত কি! ডিজনি ওয়াল্টের গল্প আমি এখনো পড়ি। পড়ার কোন নির্দিষ্ট বাধাধরা নিয়ম থাকতো না। অন্তত ক্লাস এইট পর্যন্ত বই পড়ায় কোনদিন বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়নি যে এটা কি বই পড়ো? বাবা এমনকি মাও কখনো বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রাচীর তুলে দিতে আসেনি! ‘এটা বড়দের বই-এতে হাত ছুয়ানো দূরে থাক ধরেও দেখা যাবে না’ এ জাতীয় কড়া শাসন অথবা সামান্য হুমকির ধারেকাছেও আমাকে কখনো পড়তে হয়নি। দেদারসে সেবা প্রকাশনীর রোম্যান্টিক, ওয়েস্টার্ন আর অনুবাদ বই পড়তাম। আম্মু কখনো আমাকে এরকম শাসনের বেড়া জালে আবদ্ধ করেনি। পড়তাম শুধু গল্পের বইই। কবিতা শুধু সুন্দর আবেগী চিঠি সাজাতে ব্যবহার করতাম। অথচ, আমার লেখার জগতে কলম ধরেছিলাম আমি প্রথমে কবিতা ও ছড়ার মাধ্যমেই।
কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রী আমি। ক্লাসে একটা ঢ্যাঙা জাপানী ফেস কাটিং ভারী স্মার্ট মেয়ে পড়তো। ঢাকা থেকে রংপুরের মতন মফস্বল শহরে পড়তে কেন এসেছে লিপসি ভেবে খুব অবাক হোতাম। খুব চিকন রসি রসি টানে দারুন সুন্দর স্টাইলে সে লিখতো। আমার ডায়রীতে সে অনেকগুলো কবিতা লিখে দিয়েছিলো। তার কবিতা লেখা দেখেই আমরা তিন ঘনিষ্ট বান্ধবীরও কবিতা লেখার নেশায় পেয়েছিলো। বাবলী, আমি আর শাপলা। তিনজনের ছদ্মনামও রেখেছিলাম; শাপলা-নীলাঞ্জনা, আমি-আকাশনীলা আর বাবলী-সুরঞ্জনা। আমাদের প্রতিদিন দেখা হতো কবিতার চিরকুট দিয়ে। কখনো সংগৃহীত কবিতা কখনো নিজের ভাবনা জড়িয়ে কবিতার মতো কিছু তৈরী করেই শিরোনামের নিচে নিজের সেই ছদ্ম নামটিও জুড়ে দিতাম। সেই থেকে শুরু-
প্রথম কবিতাটিকে কবিতা শিরোনামে লিখেছিলাম ঠিকই সেটি প্রকৃতপক্ষে কবিতাই ছিলো কিনা তা আজও জানা নেই-
‘তোমাকে’
তোমাকে কেন এত
ভালো লাগলো
সে প্রশ্নের জবাব আমার
জানা নেই।
শুধু জানি;-
তুমি আছো, মোর হৃদয়ে
প্রস্ফুটিত লাল টকটকে গোলাপ হয়ে
যে গোলাপ কখনও যাবেনা ঝরে।

এরকম প্রায় অর্ধ শতাধিক কবিতা লেখার পরে তখন ঢাকায় বেড়াতে এসেছি ফাইনাল পরীক্ষার আগে দিয়ে। বড় চাচার ছেলে লুতফুল আরেফীন সুজন তখন একটা দুটো পত্রিকায় গল্প প্রকাশের লাইনে রয়েছে। এখন অবশ্য ভাইয়া সচলায়তনে লিখে খুব পরিচিত হয়ে গেছে। তার দেখাদেখি তাদের বাসা থেকেই সাহিত্য বিষয়ক ম্যাগাজিন চলতিপত্রে দেখলাম ‘প্রথম প্রেম’ বিষয়ক ২০০ শব্দে লেখা চেয়েছে। তখন তো বুঝতাম না কিন্তু এখন বুঝি সেগুলো ছিলো অনুগল্প। আমি ভাবিনি যে আমার ‘থমকে থাকা সেদিনের পৃথিবী’ নামের গল্পটাও সেখানে ছাপানোর যোগ্যতা পাবে। পরের সংখ্যায় আবার ভাইয়াদের বাসায় গিয়ে দেখি ভাইয়ার গল্পও আছে। এক পাতা পরেই রয়েছে আমার গল্পটাও। কি যে ভালো লেগেছিলো। সেই পত্রিকাটা এখন আমার সংগ্রহে নেই। এখন কি আর সেই আটানব্বই নিরানব্বই সালের একটা পত্রিকা খুঁজে পাওয়া সম্ভব? গল্প লেখার শুরু হয়তো সেটাই। চলতিপত্রই হয়তো আমাকে পথ দেখিয়ে থাকবে।

চলবে...
জাকিয়া জেসমিন যূথী

[সংযুক্ত ছবিটি নিজেরই পেইন্ট ওয়ার্ক]

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ