বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ, দেশের শতকরা ৮৮.২ ভাগ মানুষই মুসলমান। আমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারীগন নিজেদের ধর্মকে মুখে মুখে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করলেও কার্যক্রমে তার ভিন্নতা লক্ষ্য করছি সবাই। জ্বালাও পোড়াও আন্দোলনে ধর্মকে খুঁটি বানিয়ে কিছু মানুষের ফায়দা লোটার অপচেষ্টায় বলি হচ্ছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কেন এই সহিংসতা? কারা ছড়াচ্ছে? আদতে কি এটিও অসাম্প্রদায়িকতা নয়?

ইসলাম শান্তির ধর্ম, যেখানে ৮০ ভাগের বেশি মুসলমানের বসবাস সেখানে সেই মুসলমান কর্তৃক এমন সহিংসতার পেছনে কে বা কারা রয়েছে সেটা ভাবা দরকার বৈকি! তাহলে কি বলা যায় যে বা যারা এসব করছে সেসব প্রত্যেক মানুষের ভিতরে অসাম্প্রদায়িকতা বিরাজ করছে না? পূজামন্ডপে মূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে, কে করেছে? একদল মুসলমান। পবিত্র গ্রন্থ কোরআন পোড়ানো হচ্ছে, কে করেছে? একদল মুসলমান। হিন্দুদের উপর হামলা করছে একদল মুসলমান। দেশে এসব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কেন? কেন আমরা একে অন্যকে তাদের নিজেদের ধর্ম যার যার মতো পালন করতে দেইনা? একজন মুসলমান হয়ে এসব খবরে আমি নিজেই আজ লজ্জিত। ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলামে এমন সহিংসতা করার কথা কোথায় বলা আছে?

গত শুক্রবার বিকেলে ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় বিপ্লব চন্দ্র নামক একজনের ফেসবুক আইডি থেকে আল্লাহ্‌তায়ালা এবং হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ গালাগাল করে একটি স্ট্যাটাস প্রকাশ পায়। এটির স্ক্রিনশট তার কয়েকজন বন্ধুর কাছে ম্যাসেজ হিসেবেও যায়। একপর্যায়ে কয়েকটি আইডি থেকে ম্যাসেজগুলোর স্ক্রিনশট নিয়ে কয়েকজন ফেসবুকে প্রতিবাদ জানালে বিষয়টি সকলের নজরে আসে। এ অবস্থায় বিপ্লব চন্দ্র স্থানীয় থানায় নিয়ে নিজে গিয়ে তার আইডি হ্যাক হয়েছে মর্মে অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ তাকে নিজেদের নিরাপত্তা হেফাজতে নেন এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ দু'জনকে গ্রেফতার করেন।

বিপ্লব চন্দ্র

আল্লাহ্‌ ও রাসুলকে নিয়ে কটুক্তির বিষয়টি ফেসবুকে ভাইরাল হলে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে নিন্দার ঝড় বইতে থাকে। ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বোরহানউদ্দিন উপজেলার হাজার হাজার মানুষ। তারা স্থানীয় ঈদগাহ মাঠে জড়ো হতে থাকে। সর্বস্তরের তৌহিদি জনতার ব্যানারে সেখানে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়। সহিংসতা যাতে না ছড়ায় এজন্য ভোলা পুলিশ সুপার নিজেই সেখানে যান। ঈদগাহ মসজিদের ইমাম মাওলানা মিজাকে পুলিশ অনুরোধ জানান বিক্ষোভ মিছিল না করার জন্য। ইমাম শুধুমাত্র দোয়া মোনাজাতের মাধ্যমে বিক্ষোভ মিছিল সমাপ্ত করেন।

বিপ্লব চন্দ্রের আইডি থেকে আল্লাহ্‌ ও রাসুলকে গালি দিয়ে পোষ্ট করা সেই ফেসবুক স্ট্যাটাস

কিন্তু এরই মধ্যে কিছু মানুষের ইমামের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে আবারো জড়ো হতে থাকে। সেখানে থাকা পুলিশের ওপর চড়াও হয় তারা। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ওই মসজিদের ইমামের ঘরে আশ্রয় নেয়। উত্তেজিত জনতা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ফাঁকা গুলি ছোড়ে। হঠাৎ গুজব ছড়ায় পুলিশ মাওলানা মুহিবুল্লাহ নামক একজনকে আটক করেছে যাকে পীর হিসেবে মানেন সবাই। এ খবরে উত্তেজনা সহিংসতায় রূপ নেয়। ঈদগাহ মাঠ ও এর আশেপাশের এলাকা রনক্ষেত্রে পরিনত হয় এবং পুলিশের ছোঁড়া গুলিতে অকালেই প্রাণ হারান চারজন। এ নিয়ে ভোলা জেলায় এখন থমথমে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

সর্বস্তরের তৌহিদী জনতা নামে জনসাধারণেরর বিক্ষোভ মিছিল

পুলিশ বলছে সভা-সমাবেশের অনুমতি না নিয়ে তৌহিদী জনতার ব্যানারে এরূপ বিক্ষোভ সমাবেশ করতে পারেননা কেউ। আর যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর তাই পুলিশ অনুমতি দেয়নি সমাবেশ করার এবং পুলিশ আত্মরক্ষার্থেই গুলি করেছে। ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটুক্তির প্রতিবাদে এবং হত্যা-সহিংসতার খবরে দেশের সকল টিভি চ্যানেল অনলাইন, প্রিন্ট মিডিয়া এখন সরগরম। এই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেশে।

সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমাদের দেশে বহু আলোচনা হচ্ছে, তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, সহিংসতা হচ্ছে। আমরা বুঝতে চাইনা নাকি পারিনা- আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি, মেধা, সততা সবকিছুই প্রগতিশীল হওয়া সত্ত্বেও কেন শুধুমাত্র এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণেই আমরা পিছিয়ে পড়ছি? লক্ষ্য করলে দেখবেন, দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে সাম্প্রদায়িকতা নেই বরং সব ধর্মের কিছু নেতৃবৃন্দ ধর্মীয় উস্কানি দিয়ে অসম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করছে বারবার।

সহিংসতায় রক্তাক্ত ভোলার ধর্মপ্রাণ মুসলমান

সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, ভোলায় যে হিন্দু ছেলেটির ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে সেটা নাকি একজন মুসলমানই করেছে। পুলিশ বিবৃতিতে তাই বলেছে। বিষয়টি তদন্তনাধীন থাকায় এ নিয়ে মন্তব্য করছিনা তবে যেহেতু মুসলমানদের মূল জায়গায় আঘাত করা হয়েছে, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে আঘাত লাগবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা যেহেতু একজন হিন্দুর আইডি থেকে ছড়ানো হয়েছে তাই এই সহিংসতায় গায়ে সাম্প্রদায়িকতার তকমা লেগেছে যা আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও আমার কাছে মনে হয়েছে- ধর্মান্ধতার সুযোগ সন্ধানী কিছু মানুষের এমন কর্মকাণ্ডে উন্নত বিশ্বের কাছে বারবার লজ্জিত হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে এবং এটাই অন্যতম কারন।

ভোলা সহিংসতার পেছনেও কিন্তু সেই ফেসবুক স্ট্যাটাস। স্ট্যাটাসটি সত্য কিন্তু কে দিয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিপ্লব যদি সেটি নিজে দিয়ে থাকে বা যেটা শোনা যাচ্ছে যে আইডি হ্যাক করেছে সে যদি মুসলমানও হয় তদন্ত করে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। লক্ষ্য করুন, ফেসবুক স্ট্যাটাসকে ঘিরে এখানেও গুজব ছড়িয়েছে, দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কু-বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে যা পুরো দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন- সঠিক খবর যাচাই করুন, গুজবে বিশ্বাস করে কোন হঠকারী সিদ্বান্ত নেবেন না। তার এমন বক্তব্যকে স্বাগত জানাই।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কালের কিছু ঘটনা- ক্যাসিনো কান্ড, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রলীগের দুর্নীতি, বেগম জিয়ার মুক্তি আন্দোলন, পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি, দুর্নীতিবাজদের পাকড়াও এসব খবরে এমনিতেই দেশের জনমনে নানান উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর রাসূলের নামে কটুক্তি ছড়িয়ে সহিংসতা ছড়ানো- এটি অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়তো? প্রশ্ন থেকেই যায়। যার সমাধান একটি আইনী প্রকৃয়ার মধ্য দিয়ে যাবার কথা, তৌহিদী জনতার ব্যানারে সাধারণ জনগণকে উস্কিয়ে দিয়ে কারা এই সহিংসতার সৃষ্টি করেছে? দেশের সরকারের বদনাম করার জন্য হতে পারে কি? অসম্ভব কিছু নয় কিন্তু!

দেশে সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব এখন একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই নয়, অন্য সকল ক্ষেত্রেই এই ব্যাধি আমাদের আক্রমণ করে চলেছে। আমরা সামাজিক জীব হিসেবে প্রত্যেকেই কোন না কোন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। কেউ ছাত্র, শিক্ষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক, কেউ রাজনৈতিক নেতা এরা সবাই এক একটি সম্প্রদায়। এবার ভাবুন এই সাম্প্রদায়িকতার উৎপত্তি কোথায় আর এর বিনাশে অসাম্প্রদায়িক এসব কর্মকাণ্ড কারা করছে? ছাত্র নিয়ে রাজনীতি ফলাফল- হত্যা, শিক্ষক নিয়ে রাজনীতি ফলাফল- শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস, নেতাদের নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক দলাদলি ফলাফল- দুর্নীতি, ধর্মীয় মানুষের মধ্যে হানাহানি ফলাফল- নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ। মানবিকতা, মনুষ্যত্ব, নীতিবোধ, নৈতিকতা শব্দগুলি আমাদের ধারণ করার কথা ছিলো মানব জীবনে অথচ এসব শোভা পাচ্ছে বইয়ের পাতায়।

যখনই কোন সম্প্রদায় আমাদের ভাবনার কারণ হয় তখন সাম্প্রদায়িক শব্দটি অসম্প্রদায়িকতার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে বারবার। সম্প্রদায় হতে হবে নিরপেক্ষ, কোন ধর্মের বা বর্ণের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে আক্রমণ করে এসব অসম্প্রদায়িক কর্মকান্ড আমাদের পুরো সমাজকে নষ্ট করে দিচ্ছে। তাই সকল ধর্মের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বন্ধ এবং অসাম্প্রদায়িকতা রোধ করার দ্বিতীয় কোন উপায় অবশ্যই আর কিছু হতে পারে না।

অনেকদিন আগে শান্তির বার্তায় এ কেমন অশান্তি! শিরোনামে একটি লেখায় একবার বলেছিলাম - গেঁয়ো সামাজিক রোশানল আর ধর্মের গ্যাঁড়াকলে, “মানবতা” নামক শব্দটিকে এখন আমি লিপিবদ্ধ করছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাতায় পাতায়….

ভোলার সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এই ঘটনায় আমার কথাই সত্যি বলে প্রমাণিত হলো।

(ছবিঃ সংগৃহীত)

0 Shares

৩৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ