
যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, আব্বা কিনে দিতেন শরৎচন্দ্রের উপন্যাস গুলো। এর পরে দিলেন সমরেশ মজুমদারের 'কালবেলা',কালপুরুষ, সাতকাহন" এইসব উপন্যাস পড়ে বুঝলাম এই বিখ্যাত লেখকরা নারীকে অনেক উঁচু আসনে বসিয়েছেন।দেখিয়েছেন কীভাবে তারা সকল প্রতিকুলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারে।
আজ থাকছে, সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত উপন্যাস "সাতকাহনের" বুক রিভিউ! নায়িকা বলবোনা, সংগ্রামী নারীর প্রতিক বলবো দীপাবলি কে। যার চাঞ্চল্যতা আর আত্ম সম্মানবোধ আমাদেরকে বুঝতে শিখিয়েছে বাস্তবতাকে কীভাবে রঙিন সুতোয় বাঁধতে হয়! দীপাবলীর মা অন্জলি, ঠাকুরমা মনোরমা, বাবা অমরনাথ, ছোট বেলার বন্ধু খোকন, বিশু তারা আর কেউ নয়----শত বছর পরেও মনে হবে এই সমাজেরি আমরা কেউ। দীপাবলির প্রতিটা কথা, কর্মউদ্দীপনা, সকল প্রতিকুলতাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে, কীভাবে নিজের স্বপ্নগুলোকে ছুঁয়ে দেখা যায়,,,তা আমাদের জীবনের গল্প মনে হবে।
শৈশব সবসময় আনন্দের আর স্মৃতিতে পরিপূর্ণ। উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে আপনারও মনে হবে শৈশবেই আছি, সাথে থাকবে মায়ের বকুনি, শাসন আর বন্ধুদের চপলতা।
তখন বাল্যবিবাহ এর প্রথা চালু ছিলো। দীপার সুন্দর শৈশব কেড়ে নিয়ে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। সেখান থেকে ফুলশয্যার পরদিনেই চলে আসা। পাঠকের মনকে নাড়া দিবে কালবৈশাখীর মতো।
জীবন তো থেমে থাকেনা। বহতা নদীর মতো চলে। সকল বাধা পিছনে ফেলে ঘুরে দাঁড়াতে হয়! তখন কেউ না কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়। বোঝাতে সাহায্য করে, জীবনকে দ্রুতগামী ট্রেনের মতো চালাতে হয়।দীপা পেয়েছিলো তার শিক্ষক কে। যিনি দীপাকে বুঝিয়েছিলেন মেয়েরাও পারে!"। শুরু হলো জীবন যুদ্ধের এক মহা কাব্য। তিক্ত অভিজ্ঞতাকে মনের ভিতরে রেখে সে ম্যাট্রিক পাশ করলো ফাস্ট ডিভিশনে। এরপর জলপাইগুড়ি কলেজ, তারপর কলকাতা।
সেই কিশোরী হয়ে উঠলো স্বতন্ত্র, বিদ্রোহি নারী। সমাজকে তুড়ি মেরে দেখিয়ে দিলো, নারী কোন অংশে কম নয়!
তার বিধবা মা,ঠাকুরমা আর শিক্ষক রমলা সেনের অনুপ্রেরণায় হয়ে উঠলো দায়িত্ববান। আকাশকে নিতে চাইলো হাতের মুঠোয়। দুর্গম পাহাড়কে অতিক্রম করা তার নেশা হয়ে গেলো।
মনোরমা বলেছিলেন,মাগো, জীবন হিমালয়ের চেয়ে বড়। সেখান থেকে যেটা খুঁজে নিতে চাইবে, সেটা খুঁজবে আন্তরিকভাবে।। কারও সাথে আপোষ করবিনা। আমার বয়সে কিছু খোঁজা যায়না, কিন্তু তোর বয়সটা ঠিকঠাক।"বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাতনীকে জড়িয়ে ধরিয়েছিলেন। এই কথাগুলোর মাধ্যমে নাতনীকে দেখতে চেয়েছিলেন আপোষহীন ও সংগ্রামী নারী হিসেবে।
ভাইবা বোর্ডে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো," আপনি কি বিয়ের আগ থেকে চাকুরী করেন?
হ্যাঁ! সেইজন্যই তো বিয়েটা হলো; আজীবন যৌতুক পাবে।"
এতো জানেন, বোঝেন প্রতিবাদ করেননা?
প্রতিবাদ করলেই, আমি সংসার হারাবো। সবাই সন্দেহ করবে।
দীপাবলি কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, বৈধব্যে তুমি ছিলে রাশভারী!
দীপা জবাব দিয়েছিলো, নিজেকে আড়াল করতে একটা কিছু নিয়ে থাকতে হয়।আমার পক্ষে এটা ছাড়া আর কিছুই করার মতো ছিলোনা।
লেখক বাস্তবচিত্র আর নারীর শিকল ভাঙার গান দুটোকেই সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন!
দুপুর পেরিয়ে গেলে অন্জলীর আলমারির হাতলে হাত দিলো দীপা! ওই দূর্ঘটনার পর থেকে রঙিন শাড়ি এড়িয়ে চলে। রঙিন শাড়ির গায়ে হাত দিতেই অদ্ভুত একটা শিরশিরানি এলো শরীরে।ব্যাপারটা এমন যে,, সে নিজেই অবাক হলো।
তার চেহারা এইরকম? নিজেকে চিনতে পারছেনা এখন। বাহিরের ঘর পেরিয়ে আসতে সময় লাগলো। পা দুটো যেনো খুব ভারি হয়ে গেছে।
এই যে বৈধব্য হলেই যে সাদা শাড়ি পরতে হয় তার প্রতিকী প্রতিবাদ করলো দীপাবলি।
দীপাবলি তৎকালীন সমাজ নয়। আজকের অনেক সাহসী নারীর প্রতিচ্ছবি সে। তৎকালীন সমাজের অনিয়ম, ধর্মীয় গোড়ামির বিরুদ্ধে আপোষহীন এক চরিত্র।
"সাতকাহন " এক নারীর দুর্দান্ত জীবনের খুঁটিনাটির গল্প এই বইটা পড়ে চলেন, জীবনকে জানি। প্রতি পাতায় হেঁটে হেঁটে পড়ি, জীবনের আঙ্গিকতা।
আসুন, আমরা নারীরা দীপাবলি হয়ে উঠি।
Thumbnails managed by ThumbPress
৩৬টি মন্তব্য
বন্যা লিপি
প্রথম হলাম। আগে পড়ে নেই, পরে মন্তব্য।
আরজু মুক্তা
জি আপু, অপেক্ষায় থাকলাম।
নাজমুল আহসান
চমৎকার উপন্যাস। মানুষকে যে ভেতর থেকে আধুনিক হতে হয়, সেটা সমরেশ বাবু নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
ইতোমধ্যে না পড়ে থাকলে, “গর্ভধারিণী” পড়তে পারেন। কাছাকাছি একটা ঝাঁঝালো স্বাদ পাবেন।
আরজু মুক্তা
জি পড়ে নিবো।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
সাবিনা ইয়াসমিন
বইটির দুটো পার্টই পড়েছি। মনে রাখার মতো। দারুন ছিলো।
বুক রিভিউ বেশ ভালো হয়েছে আরজু। আপনার বই পাঠ নিয়ে আরো বুক রিভিউ দিলে আমরাও জানতে পারবো। শুভ কামনা 🌹🌹
আরজু মুক্তা
তেমন সময় হয় না! তারপরও চেষ্টা করবো।
ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম।
শামীম চৌধুরী
শরৎ চন্দ্রের উপন্যাস আমার খুব প্রিয়
আরজু মুক্তা
নিশ্চয় পরবর্তী তে পাবেন ওনার কোন উপন্যাসের রিভিউ।
শুভকামনা!
মনির হোসেন মমি
সমরেশ মজুমদার একজন এদেশে গুণী লেখক।তাদের গল্প পড়েন আমিও বড় হয়েছি।দীপাবলীকে দিয়ে সে দেখিয়েছেন যা সে সময় ছিলো বাস্তবতা।নারী জাগরনী সুফিয়া কামাল সহ আরো যারা আছেন তাদের গল্প কমই পড়ে এ যুগের ছেলে মেয়েরা। রিভিউ ভাল লাগল।বই পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল।
আরজু মুক্তা
মমি ভাই, ধন্যবাদ।
আসলেই এখনকার ছেলেমেয়েরা পড়েই না।
মাসুদ চয়ন
খুব পরিচ্ছন্ন রিভিউ।ওনার উপন্যাসের একনিষ্ঠ পাঠক আমিও।ধন্যবাদ সুন্দর পর্যালোচনার জন্য
আরজু মুক্তা
শুভকামনা থাকলো আপনার জন্য।
আমিও ওনার একনিষ্ঠ পাঠক।
প্রদীপ চক্রবর্তী
পরিচ্ছন্ন লেখনী দিদি।
বেশ ভালো লাগলো।
আরজু মুক্তা
শুভেচ্ছার ফুলঝুড়ি থাকলো।
শুভকামনা
ইঞ্জা
আহ সমরেশ মজুমদার, এক সময় প্রচুর পড়েছি উনার লেখা, আপনি আবার সব মনে করিয়ে দিলেন, অশেষ ধন্যবাদ আপু। 😊
আরজু মুক্তা
আপনাদের ভালোলাগাই লিখার অনুপ্রেরণা জাগাবে।
শুভকামনা
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা বোনের জন্য।
নিতাই বাবু
রিভিউ দারুণ হয়েছে। “সাতকাহন” আমার সংগ্রহে আছে। অর্ধেকের মতো পড়েছি। আপনার লেখা পড়ে আবার পড়ার ইচ্ছে জাগলো।
আরজু মুক্তা
নিশ্চয় পড়ে ফেলবেন।
শুভকামনা জানবেন।
শফিক নহোর
অসাধারণ বেশ ভাল লাগলো ।
আরজু মুক্তা
শুভকামনা জানবেন।
জাহিদ হাসান শিশির
আফসোস হচ্ছে, সমরেশ মজুমদারের একটা বইও পড়া হয়নি।
শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তে ডুবে গেছিলাম কৌশরে। যৌবনে কোন রাজলক্ষী আসেনি এখনো।
একজন নিজেকে রাজলক্ষী দাবি করেছিল। যাচাই করে দেখি সে পিয়ারী বাইজি।
আরজু মুক্তা
এখন ওনার বইগুলো পড়ুন। নারী কি বুঝুন!!!
শুভকামনা
তৌহিদ
উপন্যাসটি আমি তিনবার পড়েছি। আবারো পড়ার ইচ্ছে আছে। সাবিনা আপুর পরে অনেকদিন কেউ বই রিভিউ লেখননি।সাতকাহন বইয়ের রিভিউ ভালো লেগেছে আপু।
ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য।
আরজু মুক্তা
তৌহিদ ভাই ভালো লাগলো।আপনাদের কমেন্টস আমাকে অনুপ্রেরণা যোগাবে।
শুভকামনা।
বন্যা লিপি
আমার খুব আফসোস! আমি কেন এভাবে রিভিউ লিখতে পারছিনা। সাতকাহনের দুটো পর্বই পড়েছি। সাতকাহন যতটা ভালো লেগেছিলো দ্বিতীয় “দিপান্বিতা ততোটা টানেনি আমাকে। সমরেশ বসুর লেখার একজন অন্ধ পাঠক আমি। সুনিল গঙ্গোপাধ্যায় এর লেখাতেও আমি মোহাবিষ্ট হই।
সুনিলের সোনালি দুঃখ পড়েছেন? পারলে পড়বেন। গর্ভধারিণী এখনো পড়েননি? জয়িতার চরিত্র এখানে যাস্ট ইন্সেপ্রেশন!
আরেকটা বইএর কথা বলি, যদি সম্ভব হয় সংগ্রহ করে পড়বেন। তারপর সেটার ওপর রিভিউ দেখতে চাইবো আপনার। আমি বইটা পেলে আবার পড়তে চাইবো। “অগ্নিরথ ” আমার কাছে এ যাবত পড়া সব বইএর মধ্যে বেস্ট লাগছে। এই দেখুন…. বইএর কথা উঠতেই কেমন বকবক শুরু করে দিলাম!
বেশ লিখেছেন। শুভ কামনা থাকলো।
আরজু মুক্তা
অগ্নিরথ কার লিখা? জানালে খুশি হবো।
এখন হুমায়ুন আহমেদের বাদশাহ হুমায়ুনের উপর লিখছি।এ ছাড়াও ইফতেখার ভাইয়ের সে আগুন পড়ছি
বাকিগুলো পড়ে নিবো।
আপনিও পারবেন বুক রিভিউ দিতে। আসলে চাকুরী করে সংসার সামলিয়ে, এটা কঠিন হয়ে যায়। আমার তো ঐটা তৈরি করতে একমাস লাগছে।
শুভকামনা আপনার জন্য 💜
বন্যা লিপি
অগ্নিরথ সমরেশ মজুমদারের লেখা।
আকবর হোসেন রবিন
সুনীলের ‘সোনালী দুঃখ’ বইটা মাত্র ৮৮ পৃষ্ঠার । কিন্তু ,এটা পড়ে শেষ করতে আমার বেশ কয়দিন লেগেছিলো। আসলে প্রথম তিন পৃষ্ঠার পর আর এগোতে পারছিলাম না , এই তিন পৃষ্ঠা যত পড়ি তত আরাম লাগে ।
ছাইরাছ হেলাল
ঠিক মনে নেই,
এটি কি দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছি?
এটি যদি সেটি হয় তাহলে আনন্দের বিষয়।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ।
সেইসাথে শুভকামনা।
মোহাম্মদ দিদার
সাত কাহন উপন্যাস টি কয়েক পৃষ্টা পরতেই
এক প্রিয় নিয়ে গেলো। পুরোটা পরতেই পারলাম না।
তবে যতটুকু পরেছি
তাতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আছি।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ও শুভকামনা
আকবর হোসেন রবিন
সাতকাহন পড়ার পর থেকে দীপাবলীর একটা অবয়ব তৈরি হয়েছে আমার মনের মধ্যে। আমি খুঁজি তারে, কিন্তু পাই না।
আরজু মুক্তা
এ যুগেও আছে। তবে ধীরে ধীরে খুঁজে বের করতে হবে।
শুভকামনা, বুক রিভিউটা পড়েছেন সেজন্য।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
রিভিউ পড়ে ভাল লাগলোু।
বইটি পড়ার আগ্রহ জাগলো মনে।