গভীর রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ করে দু’একটা পেঁচার ডাকে পরিবেশটা আরো ভয়ঙ্কর রূপ ধারন করে। মাঝে মাঝে দূর হতে শিয়ালের হাঁক বিদ্ধস্ত পৃথিবীতে তাদের অস্বিত্বের উপস্থিতি জানান দেয়। আকাশে চাঁদ নেই কিংবা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে। নাকি আজ আমাবশ্যা তাও জানা নাই। চাঁদের সাথে তারাগুলোর অজনা সখ্যতা। যে রাত্রে আকাশে চাঁদ থাকেনা সেই রাত্রে তারকারাজিরও দেখা মেলে না। কি অদ্ভুত মেলবন্ধন তাদের মাঝে। খস করে একটা শুকনো পাতা ঝরে মাটিতে পড়ার শব্দ হল। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের এমন একটি শুকনো পাতা ঝরে পরার শব্দও মহান আল্লাহর আজানা নয়। অতি ক্ষুদ্র পিপিলিকা হতে অনেক বড় সামুদ্রিক তিমির আহারও যোগাড় করেন মহান আল্লাহ।

রাত যাই হোক, ঘুটঘুটে কিংবা জোস্নাস্নাত- কোন কোন নরনারী এই মুহুর্তটুকুর অপেক্ষায়  থাকে। দিনভর রুটি-রুজির যোগাড় আর রুটিন মাফিক ইবাদত বন্দেগিতে অভ্যস্ত কিছু নারীপুরুষ দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। সাজিদও তাদের মতো একজন। জেনেছে, ওযু করলে অনেক ফজিলত, ছোট ছোট গুণাহগুলো মহান আল্লাহ ক্ষমা করে দেন ওযুর উছিলায়। তাছাড়া নিদ্রার প্রস্তুতি ওযুর মাধ্যমে নেওয়াটা ভাল। এতে অজানা বালামুসিবত হতে রক্ষা পাওয়া যায়। এরপর মিটিমিটি আলোয় বারান্দায় জায়নামায বিছিয়ে অন্তত দুই রাকাত সালাত আদায়। খোদার বান্দাদের দিনের সকল ক্লান্তি দূর করে নতুনরূপে উজ্জিবিত করে তুলে এই সালাত। কোন কষ্ট নেই, ক্লান্তি নেই অথচ উপকারিতা বেশ।

সাজিদ নিদ্রা যাওয়ার পূর্বে আনমনা হয়ে পড়ে। ভাবনার সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে। চোখের পাতার পাপড়িগুলো ভিজে উঠে অনুশোচনার তাপে। সারাদিন কত খাটাখাটুনি। এর মধ্যে অফিস, বস, ক্লায়েন্ট সামলানো সহজ হয়ে উঠেনা। মিথ্যার আশ্বাস এখানো খই-মুড়ির মতো মুখ দিয়ে বের হয়। সাজিদ ভাবে আল্লাহর দুনিয়া বড় বিচিত্র কিন্তু আরো বিচিত্র সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ।

ভাবনার সাগরে ঢেউ বন্ধ হয় ঘুমের আগমনে। সারা দুনীয়ার সকল মানুষ একটি মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। যেন কোন প্রতিদানের পাওয়ার অপেক্ষা। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। সাজিদ দুই এক জনকে প্রশ্ন করেও কোন উত্তর পেল না। তারা সাজিদের দিকে তাকালও না। আশ্চর্য যে সাজিদ হামেশা মানুষের উপকারে যেচে কথা বলতো আজ সে এতো অসহায়। দু,একটি মুখ তার কাছে পরিচিতও মনে হল।

হঠাৎ দুজন ফেরেশতা সাজিদের দুবাহু ধরে অনেক অনেক দূরে উড়িয়ে নিয়ে গেল। সম্ভবত হাজার বছরের রাস্তা পেরিয়েছে সাজিদ কয়েক সেকেন্ডে। কিভাবে সম্ভব? দুনীয়ার জীবনে নেটওয়ার্কের বদলৌতে সহস্র মাইল দূরে প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগ করা যেত এক সেকেন্ডে, এখানেও তাই। সাজিদ বুঝতে পারছে আজ প্রতিশ্রত দিবস, কেয়ামতের দিন, প্রতিদান পাবার দিন। ভেবে সাজিদের ভয় নয় বরং ভালই লাগছে। কেননা দুনীয়ার জীবনে সে অনেক ভাল কাজ করেছে। আজ তার পুরস্কার পাবার দিন। জান্নাত তার জন্য অবধারিত।

ওদিকে রোনাজারি, কান্না ময়দানকে বিভৎস রুপ দিয়েছে। এই পরিস্থিতিও সাজিদের মধ্যে কোন পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছে না। দুনীয়ার জীবনে যে এতো ভাল মানুষ ছিলেন সে কি আজ কষ্টে থাকতে পারে।

হঠাৎ সাজিদের ডাক পড়লো। মহাখুশী সাজিদ ফেরেশতাদের মুখোমুখি। একজন ফেরেশতা বললেন- তুমি কি মনে করো দুনীয়ার জীবনে মহান আল্লাহর হুকুম যথাযথভাবে পালন করেছো এবং মহান আল্লাহ তোমার উপর সন্তুষ্ট।

কেন নয়? আমি হামেশা দান-খয়রাত করেছি।

হ্যা, করেছ। তোমার কোন বন্ধু-পরিজন যখন উপস্থিত থাকতো তখন তুমি অসহায়দের দান করতে। তোমার বন্ধুরা তোমাকে দানশীল বলতো। তুমি তোমার দানের প্রতিদান পেয়েছ। সুতরাং তোমার দানের সাওয়াবের একাউন্ট ফাঁকা।

নো টেনশন। আরো ইবাদত আছে। আমি সবচেয়ে বড় ইবাদত সালাত যথাযথ সময়ে যথাযথভাবে আদায় করেছি।

হ্যা, তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করেছ বটে। তবে তুমি নামাযি বলে বেনামাযিদের হেয় করে কথা বলতে। তাদেরকে নামাযের পথে ডাকতে না। তারা তোমাকে শ্রদ্ধা সম্মান করুক সেটা তুমি চাইতে। তারা তোমাকে শ্রদ্ধা সম্মান করতো। তুমি নামাযের প্রতিদান পেয়েছ। সুতরাং নামাযের সাওয়াবের একাউন্ট তোমার ফাঁকা।

তুমি তোমার কর্মজীবনে অনেক মানুষের উপকার করেছ।

হ্যা করেছি।

কিন্তু তুমি তাদের কাজ করতে না যারা তোমাকে প্রতিদান বা বিনিময় দিতো না। ভাল কাজের প্রতিদান তুমি পেয়েছ। সুতরাং ভাল কাজ করার সাওয়াবের একাউন্ট তোমার ফাঁকা।

দরদর করে ঘামছে সাজিদ, হাউমাউ করে কাঁদছে, কোন উপায় দেখছে না। কিভাবে পারহবে এই ময়দান।

হঠাৎ গায়েব হতে আওয়াজ আসল। শোন হে সাজিদ, শোন, আমার দরবারে এক রেনু পরিমাণ সাওয়াব যে নিয়ে আসবে আমি তার প্রতিদান উত্তমরুপে দিব আর যে এক রেনু পরিমাণ গুণাহ নিয়ে আসবে তাকেও তার প্রতিদান দিব। ওমা ইয়াওমাল মিসক্বালা জাররাতিন খাইরাই ইয়্যারা, ওমা ইয়াওমাল মিসক্বালা জাররাতিন সাররাই ইয়্যারা” আমার এই আদালত নৈরাশ্যের আদালত নয়, আশা আর আকাঙ্খার আদালত। লা তাকনাতু মির রাহমাতিল্লা ইন্নাল্লাহা ইয়াগুফিরুজ জুনুবা জামিয়া

সাজিদ আজ তোমার কোন চিন্তা নাই। তুমি দুনীয়াতে অনেক ভাল কাজ করেছ। অহংকার, লোভ, হিংসা, তাকাব্বুরি, হাছাদ, অর্থের চিন্তা তোমার আমলের স্বচ্ছতা নষ্ট করেছে, তোমার প্রতি আমার ক্রোধ জন্মিয়েছে। কিন্তু দেখ, আমি কিভাবে তোমাকে ক্ষমা করে দিই। তোমার কি মনে আছে সড়ক পার হওয়া অন্ধের কথা?

সেই অন্ধ যাকে আমি রাস্তা পার করে দিয়েছিলাম?

হ্যা, দুই হাত তুলে আমার কাছে সেই অন্ধ তোমার কল্যানের জন্য দু’য়া করেছিল। আমি তার দু’য়া কবুল করেছি। তোমাকে ক্ষমা করেছি তার দু’য়ার উছিলায়। যেহেতু সেই অন্ধ তোমার কল্যানের জন্য দু’য়া করেছে সেহেতু আমি সেই অন্ধকেও ক্ষমা করে দিয়েছি। তোমরা উভয়ে আমার জান্নাতে প্রবেশ করতে পার। যে দরজা দিয়ে মন চায় সেই দরজা দিয়ে তোমরা প্রবেশ কর। আজ থেকে তোমরা এখানে অবস্থান করবে আর আমার নেয়ামত ভোগ করবে।

দরদর করে ঘামতে থাকা সাজিদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ছটফট করে উঠে বসল খাটের উপর। তৃষ্ণায় গলা কাঠ হয়ে গেল, তার কপাল থেকে ঘাম ঝরছে খুব। এক গ্লাস পানি পান করে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাল আর যাবতীয় অপরাধ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করল মনে মনে- আসতাগফিরুল্লাহ রাব্বি মিনকুল্লো জাম্বীও ওয়াতুবু ইলাইহে

চতুর্দিকে ফজরের আজান হচ্ছে। সাজিদ ওযু করে মসজিদের পানে চলছে ।

শিক্ষা : আমাদের নেক আমলসমূহ যেন হয় অহংকার মুক্ত, রিয়া মুক্ত, লোক দেখানো মুক্ত, সুন্নত তরিকায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত থাকতে হবে সর্বদা

 

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ