সরি

তির্থক আহসান রুবেল ১১ মার্চ ২০২১, বৃহস্পতিবার, ০৩:০২:০২অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৬ মন্তব্য
আমার খুব ছোটবেলাটাও আমার কাছে স্পষ্ট। হাত ধরে কাঁচা বাজারে যাওয়া। বাজারের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া। একা একা দাঁড়িয়ে কান্নাকাটি। ৪/৫ মিনিট পর খুজেঁ পাওয়া। বাজার শেষে জয়দেবপুর বাজারের মিষ্টির দোকানে পরটা দিয়ে মিষ্টি খাওয়া।
আমার স্পষ্ট মনে আছে গাজীপুরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ডাকাতির কথা। আমার বয়স তখন ৭, ছোটভাই'র ৬। আমরা বিছানায় বসে দেখছি রডের পাইপ দিয়ে ১৫/২০ জন ডাকাত আমার বাবা এবং বড় মামার মাথায় টানা ১০/১৫ মিনিট ধরে মারছে। রক্তে দেয়াল-ফ্লোর থকথকে হয়ে যাওয়া। সেই রক্তে হেটে আমার মাকে খুজেঁ বেড়ানো। মায়ের রুমের সব তোষক জাজিম নিচে পড়ে আছে। সেসব উল্টে ভেতরে খুঁজছি। রান্না ঘরে-বাথরুম-টয়লেট কোথাও নেই। এক ডাকাতকে আমি রান্নাঘরের ভেতর রেখে দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে দেই। একটু পর এসে ছোট ভাই কে জানাই আম্মু নেই। নেই আমার বড়বোনও। একটু পর সেই দরজা আবার খুলে দেই। এদিকে আমার মা ছোটবোনকে কোলে নিয়ে দৌড় দেয় সাবস্টেশনের অফিস রুমে। মোট ৬ টা ককটেল মারা হয় তাকে। কিন্তু কিভাবে যেন উনি কোন আঘাত না পেয়েই আমার বড় বোনকে কোলে নিয়ে অফিসের ডিউটি রুমে ঢুকে যান। গিয়ে দেখেন সেখানে নাইট ডিউটিতে থাকা সবাইকে বেধে রাখা হয়েছে। সেখানে আরো ৪/৫ জন ডাকাত বসে। তারা আমার মায়ের কান ছিড়ে দুল নিয়ে যায়। খুলে দেয়ার সুযোগ হয় না। আমার বাবা এবং বড় মামা প্রায় ৬ মাস হাসপাতাল এবং বাসায় বিছানায় পড়ে ছিল। সময়টা বোধহয় ৮৭ সাল। নেই ফোন, নেই মোবাইল। (ঘটনা অনেক বড় এখানে ৫% বলা হলো মাত্র)। আমার কলেজ জীবন পর্যন্ত প্রায়ই রাতে স্বপ্নে এই দৃশ্যগুলো দেখে লাফ দিয়ে জেগে উঠতাম। শতশত রাত ঘুমাতে পারিনি।
 
আমার মনে আছে ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়ার পর টিএনও অফিস আমাকে সংবর্ধনা দেয়। সে অনুষ্ঠানে ডায়াসের সামনে আমার বাবার দাঁড়ানো এবং বলা কথাগুলোর অনেকটাই মনে আছে।
 
মনে আছে বাবা অফিস থেকে ফিরলে তবেই আমি উনার সাথে দুপুরের কাবার খেতাম। সে সময় সরকারী অফিস ছিল সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২ টা। আমার মনে আছে, উনি অফিস থেকে ফিরলেই আমি উনার সেন্ডু গ্যাঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার ধুয়ে শুকাতে দিতাম। এটা নিয়ে আমার বোন ওয়াক করে আমাকে খ্যাপাতো। বাবা যখন অসুস্থ হতেন রাত জেগে থাকতাম। নাভিতে সরিষার তেল দিয়ে পান পাতা দিয়ে পেটে ঘষে সেই পাতা আগুনে পুড়ালে পটপট শব্দ করতো। বিশ্বাস করতাম এই শব্দের সাথে সব শত্রু মারা যাচ্ছে।
মনে আছে গাজীপুর থেকে উনার সাথে ঢাকায় আসা এবং গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে মেরুন কালার জাম্বু কেডস আর জিন্স প্যান্ট কেন। টাকার সমস্যা না, উনার কেনাকাটাই এমন ছিল। যে স্বভাবটা আমার মাঝে প্রকট আজো। আমি অভাবী হলেও আমারটা অভাবের জন্য না। আমাকে কাচেঁ ঘেরা দোকান কখনো টানে নি।
 
তারপর একদিন উনার দেয়া আঘাত। জাস্ট আমি তলিয়ে গেলাম। তারপর ২২ বছর আমি কথা বলিনি। ২২ বছর পর যখন বাসা থেকে ছোটবোন (ছোটভাই'র স্ত্রী) সকালে বললো আব্বুর অবস্থা ভাল না। কালকে থেকে কিছু খাচ্ছেন না। ঘুমেই আছেন। ডাক্তার দেখছেন। আমি তখন নাইট ডিউটি শেষে ঘুমাচ্ছি। বললাম আসতে হবে! বললো জানাবো। দেখি ডাক্তার কি বলে। আরো গভীর ঘুমে ডুবে গেলাম। দুপুরের আগে আগে কল আসলো: বাড়িতে আসেন। গেলাম। দেখছি মানুষের ভিড়। ঘরে গিয়ে বসলাম। কোয়ার্টারের পুরাতন মানুষগুলো এসেছে। তাদের সাথে দেখা। তখনো আমি কফিনের সামনে যাই নি। দাফনের জন্য যখন ট্রাকে তোলা হচ্ছে তখন সন্ধ্যা। সবাইকে শেষবারের মতো দেখানো হচ্ছে। আমাকে টেনে নেয়া হলো। মুখের উপর থেকে কাপড় সরানো হলো। তাকালাম। তরতাজা মুখ। হাটু গেড়ে বসে গেলাম। ২২ বছর পর সেই মুখে হাত দিলাম। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোয় নি। মন থেকে বের হলো: সরি।
 
আজ উনার মৃত্যুর ৩ বছর।
 
৩ বছর আগে এই দিনে আমার বাবা মারা যান।
 
* ছবিতে আমার বাবা, ছোট ভাই, তার স্ত্রী এবং ছেলে। আমার সাথে বড় বেলার কোন ছবি নেই। ছোটবেলার আছে। যা আমার সাথে নেই বর্তমানে।
0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ