
ভোর হলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিদ্যা-বুদ্ধির দেবী মা সরস্বতী বা বাগদেবী তার বিদ্যা-বুদ্ধির বর নিয়ে হাজির হবেন। বিদ্যার দেবী বলার একটাই কারণ এই পূজোটা মূলত শিক্ষার্থীদের মনোষ্কামনা পূরণের জন্য করা হয়। তবে যে যে বিষয়ে আরাধনা করে , চর্চা করে তারা সবাই মা সরস্বতীর কাছে বর চাইতে পারে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান সেরে শুদ্ধ, পরিষ্কার পোশাক পড়ে নিতে হয়। তবে সাদা পোশাক টাকেই প্রাধান্য দেয়া হয় শুভ্রতার প্রতিক হিসেবে। মন ও শরীর পবিত্র করার জন্য নিম ও কাঁচা হলুদ বাটা মাখার নিয়ম আছে। অবশ্যই খালি পেটে থাকতে হয় অঞ্জলি দেবার আগ পর্যন্ত।
পূজো দেবার জায়গাটি পরিষ্কার করে কাঠের পিড়ি বসিয়ে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে হয়। তার উপর মূর্তিটি স্থাপন করতে হয়। একটি ঘটে বিশুদ্ধ জল দ্বারা পূর্ণ করে তাতে আম্রপল্লব দিয়ে তার উপর একটি পানপাতা রেখে মূর্তির সামনে রাখতে হয়। হলুদ, কুমকুম, চাল রাখতে হবে সাথে সাদা, বাসন্তী রঙের ফুল, মালা ও রাখা চাই। ফলমূল, পঞ্চ মিষ্টি লাগে পূজোতে। ফলের মধ্যে অবশ্যই বরই বা কুল রাখতে হয়। এই পূজোর প্রধান ফল হচ্ছে কুল বা বরই।
কথিত আছে সরস্বতী দেবীকে তুষ্ট করার জন্য মহামুনি ব্যাসদেব বদ্রিকাশ্রমে তপস্যা করেছিলেন। তপস্যা শুরুর আগে তাঁর তপস্যাস্থলের কাছে একটি কুল বীজ রেখে দেবী একটি শর্ত দেন। এই কুলবীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, বড় গাছে ফুল থেকে নতুন কুল হবে। দেবী বলেন, যে দিন সেই কুল পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হবে, সেই দিন তার তপস্যা পূর্ণ হবে বা সরস্বতী দেবী তুষ্ট হবেন। ব্যাসদেবও সেই শর্ত মেনে নিয়ে তপস্যা শুরু করলেন।
ধীরে ধীরে বেশ কয়েক বছরে এই কুল বীজ অঙ্কুরিত হয়ে চারা, চারা থেকে বড় গাছ, বড় গাছে ফুল থেকে নতুন কুল হয় এবং একদিন তা পেকে ব্যাসদেবের মাথায় পতিত হয়। তখন ব্যাসদেব বুঝতে পারেন যে, সরস্বতী দেবী তাঁর প্রতি তুষ্ট হয়েছেন।
সে দিনটি ছিল পঞ্চমী। সে দিন বেদমাতা সরস্বতীকে বদ্রী/কুল ফল নিবেদন করে অর্চনা করে তিনি ব্রহ্মসূত্র রচনা আরম্ভ করেন। শ্রীপঞ্চমীর দিন সরস্বতী দেবী তুষ্ট হয়েছিলেন। তাই সেই দিনের আগে আমরা কুল খাই না। শ্রীপঞ্চমীর দিন সরস্বতী দেবীকে কুল নিবেদন করার পরেই কুল খাওয়া হয়।
স্বাস্থ্যগত কারণেও সরস্বতী পূজার আগে কুল খাওয়া ঠিক নয়। কারণ মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগে কুল কাঁচা বা কষযুক্ত থাকে। কাঁচা বা কষযুক্ত কুল খেলে শরীরের ক্ষতি হতে পারে।
শাস্ত্রে খাওয়ার বিষয়ে বহু বচনের মধ্যে একটি এই যে- ‘বার্তাকু কার্তিকে বর্জ্যং মূলং বা বদরং মাঘে। চৈত্রে শিম্বী পুনস্তুম্বী ভাদ্রে বর্জ্যং দ্বিজাতিভিঃ’। অর্থাৎ দ্বিজাতিগণ কার্তিকে বেগুন, মাঘে মুলো বা কুল, চৈত্রে শিম এবং ভাদ্রে গোলাকার লাউ খাবেন না। অতএব দ্বিজাতি ছাড়া কারও এ সব খেতে নিষেধ নেই। দ্বিজাতিরও মাঘে মুলো অথবা কুল নিষিদ্ধ, সরস্বতী পূজোর আগে এ রকম কোনও কথা নেই। কারণ সরস্বতী পূজো ফাল্গুনেও হতে পারে। তবে লোকাচারে কেউ সরস্বতী পূজোর আগে কুল খান না।
মূর্তির একপাশে দোয়াত, কলম ও বই রাখতে হয় সাথে আম্র মুকুল ও পলাশ ফুল দিয়ে অর্পণ করতে হবে। যে যে বিষয়ে চর্চা করেন সেই চর্চার সাথে যুক্ত সামগ্রী গুলোও রাখতে পারেন।
এরপর শুরু হয় পূজোর মন্ত্রপাঠ। সরস্বতী পূজোর মন্ত্র:
স্তব: শ্বেতপদ্মাসনাদেবী শ্বেতপুষ্পোজশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।
বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈরচ্চৈর্তা দেবদানবৈঃ।
পূজিতা মুনিভিঃ সর্ব্বৈঋষিভিঃ সদা।
স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম।
যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়াং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।
পুষ্পাঞ্জলি:
ঔঁ ভদ্রকালৈ নমো নিত্যং সরস্বতৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদান্ত বেদাঙ্গ-বিদ্যাস্থানেভ্যঃ এব চ।
এষ স-চন্দন বিল্বপত্র পুষ্পাঞ্জলি ঔঁ ঐং শ্রী শ্রী সরস্বতৈ নমঃ।
প্রার্থনা:
ওম যা কুন্দেন্দু তুষারহারধবলা যা শ্বেতপদ্মাসনা, যা বীণাধর-দণ্ড মণ্ডিতভূজা যা শুভ্রাবস্ত্রাবৃতা। যা ব্রহ্মচ্যুত-শঙ্কর-প্রভৃতিভিদেবৈঃ সদা বন্দিতা। সা মাং পাতু সরস্বতী ভগবতী নিঃশেষ জাড্যাপহা। যথা ন দেবো ভগবান ব্রহ্মা তোল পিতামহঃ ত্বাং পরিত্যাজ্য সন্তিষ্ঠেৎ তথা ভব বরপ্রদা। বেদা শাস্ত্রানি সর্ব্বাণি নৃত্যগীতাদিকঞ্চ যৎ। ন বিহীনং ত্বয়া দেবি তথা মে সন্তু সিদ্ধয়ঃ। লক্ষ্মীর্মেধা ধারা পুষ্টিঃ গৌরী তুষ্টিঃ প্রভা ধৃতি। এতাভিঃ পাহি তনুভিরষ্টাভির্ম্মাং সরস্বতী।
প্রণাম :
ওম জয় জয় দেবী চরাচর সারে।
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে ভগবতী ভারতী দেবী নমোস্তুতে।
ওম সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমলোলোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাং দেবী নমোস্তুতে।
মন্ত্রপাঠ পূর্ণ করে দেবীকে ভোগ নিবেদন করতে হয়।
এছাড়াও জলশুদ্ধি, করশুদ্ধি, আসনশুদ্ধি, পুষ্পশুদ্ধি, দ্বারদেবতা পূজো, সঙ্কল্প ইত্যাদি পূজোর নানা নিয়মের মধ্যে অন্যতম।
ছবি ও তথ্য-গুগল
১৬টি মন্তব্য
বোরহানুল ইসলাম লিটন
কুল এর সুন্দর তথ্য জানলাম।
অনন্য শ্রদ্ধার্ঘ্য প্রিয় কবি।
মুগ্ধতায় শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রেখে গেলাম অন্তহীণ।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনাকে প্রথম মন্তব্য কারী হিসেবে নিয়মিত পাওয়াতে খুব ভালো লাগে। অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও অভিনন্দন আপনাকে। ভালো থাকবেন সবসময়
প্রদীপ চক্রবর্তী
গঠনমূলক লেখনী, দিদি।
ধন্যবাদ সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় সরস্বতীপূজার বিষয়বস্তু তুলে ধরার জন্য।
.
শুভ বসন্ত পঞ্চমীর শুভেচ্ছা রইলো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ ও শুভকামনা। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম। ঈশ্বর সহায় হোন
আরজু মুক্তা
পূজো ভালো কাটুক।
অনোক কিছু জানলাম। শুভকামনা
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ আপু 💓🌹। অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো।
মনির হোসেন মমি
সরস্বতী পুজোঁর বিভিন্ন তথ্যমুলক লেখা দিয়ে উপকৃত করলেন।অনেক হিনদুবাড়ী বা মন্দিরে কুল বা বরই গাছ দেখি তার রহস্য অজানা ছিলো আজ জানলান।আরো জানা হল বিদ্যার বিষয়টি। পুজোয় শুভেচ্ছা শুভ কামনা সহ ভাল থাকবেন সুস্থ থাকবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভাইয়া পড়ার জন্য কৃতজ্ঞ ও ধন্যবাদ। আপনি ও সবাইকে নিয়ে ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও শুভকামনা
পপি তালুকদার
আমার অনেক বন্ধু কুল খেতো না সরস্বতী পূজা আগে এখনো দেখি অনেকে খায়না। বুঝতামনা কেন খায় না। আজ কারন জেনে ভালো লাগছে।দিদি শুভ কামনা রইল।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। নিয়মিত অনুপ্রেরণায় রাখার জন্য কৃতজ্ঞ। ঈশ্বরের কৃপায় ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
রোকসানা খন্দকার রুকু
জানলাম দিদি।
শুভ কামনা।❤️🥰
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য ধন্যবাদ আপু। আপনার জন্য ও শুভকামনা রইলো। ভালো থাকুন সবসময়
সাবিনা ইয়াসমিন
সরস্বতী পূজার বিস্তারিত জানলাম। এমন করে জানা গেলে ভালো লাগে। পূজার শুভেচ্ছা আপনাকে। ভালো থাকুন অবিরাম ভালোবাসায় ❤️❤️
* দ্বিজাতি কাদের বলা হয়?
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। দ্বিজাতি বলতে দুই জাতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন তথ্য বুঝায়। সাম্প্রদায়িক বিষয়টি থেকেই দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভব। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন
ছাইরাছ হেলাল
সে আপনি যাই বলুন না কেন এবারে দেবী কাজ-কাম তো অন লাইনেই সেরে ফেলেছেন,
নো হ্যাপা সিস্টেমে। আনুষ্ঠানিকতাটুকু অভাবে সেরে ফেললেই ভাল হোত।
অবশ্য ভোগটুকু জলাঞ্জলি দিতে হতো।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
তা ঠিক এবার স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় সবকিছু ঘরোয়া ভাবেই হয়েছে। সেই উৎসব, আনন্দ এবার কোথাও ছিলো না। ভালো থাকুন নিরাপদে থাকুন