
থার্ডইয়ারের মেয়েদের পরিসংখ্যান পড়ান সামায়রা ম্যাম।তার কাছে পয়সা মূখ্য নয়, তিনি পয়সা নেন না, পড়ান সময় কাটাতে। তাছাড়া কাউকে শেখাতে পারার মধ্যে ভীষন আনন্দ কাজ করে। পডানোতে শিক্ষকদের এমন আনন্দই থাকা দরকার। আর একটি থাকা দরকার তা হলো শিক্ষার্থীর প্রতি আন্তরিকতা, কাছে টেনে নিয়ে সমস্যার সহজ সমাধান করতে চাওয়ার মনোভাব।
সামায়রা ম্যামের সবচেয়ে প্রিয় মেয়েটি আজ পড়তে আসেনি। দুএকজনকে তার কথা বললেন তারাও জানেনা। কি অদ্ভুত একটা বিষয় একই ক্লাসে, একই শিক্ষকের কাছে তারা পড়ে অথচ একে অপরের খোঁজ জানেনা। সামান্য দুশ্চিন্তাই হলো! তাই আজ অন্যদেরও তারাতারী বিদায় দিলেন।
এর দুদিন পরেই মেয়েটি এলো, মন খুউব খারাপ বলেই মনে হলো। তিনি কফি বানিয়ে বসলেন তার সাথে। জানতে চাওয়া উচিত হবে কিনা ভাবতে ভাবতে বলেই ফেললেন- কি হয়েছে? কদিন আসোনি?
বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ মেয়েটি, শুধু চোখ দিয়ে টুপটাপ পানির শব্দ। একটু সহজ হয়ে মেয়েটি জানালো তার বহুদিনের বন্ধু তাকে ভুল বুঝেছে। সকল সম্পর্ক শেষ করেছে। অনেক করে বোঝানোর পরেও সে তাকে ফেরাতে পারেনি।
আজকাল সম্পর্কগুলোই এমন হয়েছে, বিচ্ছেদ শব্দটা খুব বেশি যোগ হয়েছে তাতে। স্বামী- স্ত্রী, প্রেমিক- প্রেমিকা, বন্ধু- বান্ধব, আত্নীয়- পরিজন সবার বেলাতেই এমন হচ্ছে। হুটহাট আমরা সম্পর্কগুলোর বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফেলছি। অনেক কষ্টে তৈরি করা সম্পর্কটার মুহূর্তেই মাটি দিয়ে ফেলছি। এতে স্বস্তি বা শান্তি কতটুকু মেলে তার দিকে যাই না। বরং জিদ বেশি কাজ করে। আবার ফিরে আসবার কথা কখনোই ভাবি না। এরপর কোনএকদিন স্মৃতি চারণ করে ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।
এই ঘন ঘন বদলানো বদলে যাওয়া, নতুন নতুন সম্পর্কে জডানো যেন ফ্যাশান হয়ে গিয়েছে। পুরোনোতে আর জমে না, মজা নেই, স্বাদ নেই নতুন পেলে। খুব করে দুদিন ঘুমিয়ে একটা সম্পর্ক খুব সহজেই চাপা দিয়ে, বিচ্ছেদ ঘটিয়ে আমরা অন্যটার দিকে এগোই। আজকাল সম্পর্কের টাইমলাইন, ট্যাগলাইন কোনকিছুই স্থায়ীত্ব পায় না।
হঠাৎ করে দুয়ারে আসা ঢেউ এর মতো কাউকে ভালো লেগে গেলো। সেটাতে মজে বেশ নিশ্চিন্তে চললাম কিছুদিন, ফেসবুক, ছবি এসবও চললো। একসাথে ঘুরে বেডিয়ে লোককে জানানো হলো আমরা অনেক ভালো একটা সম্পর্কে অবস্খান করছি। এরপর দুম করে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে লোককে দেখিয়ে বেড়ানো আমার লাইফে কোন সমস্যা নেই। আমি অনেক ভালো আছি। কদিন আগে যা ছিলো সব ভুল ছিলো, বুঝতে পারিনি বলেই তার সাথে চলতে শুরু করেছিলাম। আর এমন ভুল জীবনেও হবে না।
সম্পর্কে বিচ্ছেদ আছেই এটা যেমন সত্যি, তেমনি সমাধান বলেও একটা ব্যাপার থাকে। এক্ষেত্রে সস্তা ইগো পা এগিয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। কাউকে খুব করে চাইছি কিন্তু এতটুকুতে আর তাকে বলতে পারি না তোমাকে আমার প্রয়োজন। তোমাকে ছাড়া আমার চলে না। মনে সাহস আছে, দুসাহস নেই! যদি সে ফিরিয়ে দেয়, তবে তো আমি ছোট হয়ে যাবো। হয়তো সম্পর্কটি এতটুকুতে নতুন প্রাণ পেত ইগো আর ছোট হয়ে যাবার মতো খোঁড়া যুক্তিতে সেটি ওখানেই চাপা পড়ে শেষ হয়ে যায়। হয়তো শুধু একটা কথা বলা হয়না- এবার না হয় থেকেই যাও। একজন অন্যজনের উপর ভর করে আর এরজন্য বিচ্ছেদ ঘটে একটি জীবন্ত সম্পর্কের।
কাউকে ভালোবাসা/ ভালোলাগার পর অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়। চাওয়া বাড়ে, চাহিদা বেডে যায়। ঝামেলা শুরু হয় তখনি। অধিকার ও চাওয়া কারও কারও কাছে বেশি বেশি মনে হয়। মনে হয় নিজেকে উন্মুক্ত করে ফেলা হচ্ছে, আর কিছু অবশিষ্ট থাকছে না নিজস্বতা বলে। এই একগুয়েমী নিজস্বতা সম্পর্ককে আর টানতে পারে না, বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়।
সম্পর্কে ঝগড়া হবে আবার মিটমাটও হবে। অভিমান যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় এমনটা খেয়াল না রেখে আমরা অভিমান ভাঙ্গানোটাকে নিজের ইগো মনে করি। উটকো ঝামেলা মনে করে সেটির বিচ্ছেদ ঘটাই।
জীবনের একটা সময় এসে আফসোস থেকে যায় সেদিন একটু ছোট হলে পারতাম, নিজের কথাটা বলে দেখতে পারতাম। আজ তাকে খুব মনে পড়ছে। শুধু শুধু ভুলে যাবার, ছেড়ে যাবার অভিমান না ভাঙ্গাবার হয়তো কোন কারন ছিলো না।
বিচ্ছেদের ফল খুব একটা ভালো হয় না। চাওয়ার সময় আর চাইলেও তাকে পাওয়া যায় না। আজকাল বিচছেদের বড় একটি কারণ হলো মিথ্যা অভিনয় করা। কোনকিছু অযথাই চাপা দেবার চেষ্টা করা। তাতে জটিলতা বাড়ে। আর তা থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে যায়, সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে। যা মনে আছে, যা সত্যি তা নিশ্চিন্তে বলে ফেলাটা না শেখার জন্যই আজকাল অটুট বন্ধন আর নেই।
তবে আগেকার দিনে এমন ছিলো না। বনধুত্বে, ভালোবাসায়, মায়ায় একজন অন্যজনকে বছরের পর বছর জডিয়ে রাখতো।
সম্পর্কগুলো ঠুনকো না হোক। আমরা সম্পর্কের সম্মান করতে শিখি। চাওয়া- পাওয়ায় হয়তো কিছু মনেমালিন্য দেখা দিতে পারে। তা যেন বিচ্ছেদের দিকে না যায়। এটি খুব খারাপ শব্দ। বরং নিজের ইগো কমিয়ে, একটু ছোট হয়ে, ছার দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখি অনন্তকাল!!!
ছবি- নেটের
১৫টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
খুবই চমৎকার এবং গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট। আমাদের ইগো সমস্যা বিচ্ছেদের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্পর্কের মাঝে কোন সমস্যা ভুল বুঝাবুঝি করতেই পারে। কেউ একজন এগিয়ে আসলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। এক্ষেত্রে আমরা নিজেকে কেউ ছোট করতে চাই না। তাই সম্পর্কের অবনতি ঘটে যায়।
শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইলো অশেষ। ভালো থাকবেন
আলমগীর সরকার লিটন
খুবি চমৎকার লেখেছেন রুকু আপু সম্পর্ক আসলে কঠিন তবু ধৈর্যধারণ করতে হয়
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাই
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আমাদের মধ্যের সম্পর্কগুলো দিন দিন আলগা হয়ে যাচ্ছে। ভেঙ্গে যাচ্ছে। বিচ্ছেদে পর্যবসিত হচ্ছে অহরহ। আসলে টিকিয়ে নয় বজায় রাখতে হয় তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। সম্পর্কগুলো পরিচর্যা করতে হয়। যত্ন নিতে হয়। অনেকে মনে করে দীর্ঘকালের সম্পর্ক সেকেলে এবং একঘেয়েমিতে পরিণত হয়েছে। ঘটছে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। দুর্ঘটনা। আপনার কথাগুলো খুবই প্রণিধানযোগ্য — “সম্পর্কগুলো ঠুনকো না হোক। আমরা সম্পর্কের সম্মান করতে শিখি। চাওয়া- পাওয়ায় হয়তো কিছু মনেমালিন্য দেখা দিতে পারে। তা যেন বিচ্ছেদের দিকে না যায়। এটি খুব খারাপ শব্দ। বরং নিজের ইগো কমিয়ে, একটু ছোট হয়ে, ছার দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখি অনন্তকাল”!!!
রোকসানা খন্দকার রুকু
অতি দুঃখজনক। কৃতজ্ঞতা রইলো ভাই
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো আপু।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
মানিয়ে চলার নামই মনুষ্য জীবন।
ভাঙা গড়া নিত্য খেলা তো অন্য প্রাণির মাঝেও দেখা যায় না
যা মানুষ দেখায়।
আন্তরিক শুভ কামনা জানবেন সতত।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আপনার জন্যও শুভকামনা রইলো।
মনির হোসেন মমি
ডিজিটাল যুগে সম্পর্কগুলোও ডিজিটাল হয়ে গেছে।পূর্বকার সম্পর্কগুলোতে ছিলো লজ্জা ইতস্তঃ কিছুটা ভয়,সন্মান তাইতো সম্পর্কগুলোর স্থায়িত্ব ছিলো দীর্ঘকাল অনন্তকাল।এখনকার যুগে সম্পর্ক গড়তেও দেরি হয় না ভাঙ্গতেও সময় লাগে না।সম্পর্কের মাঝে প্রকৃত প্রেমানুভুতি থাকাটা বাঞ্ছনীয়।
রোকসানা খন্দকার রুকু
প্রেম নেই প্রয়োজন বেশি তাই সম্পর্কে বিচ্ছেদ!
ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
ছাড় দিতে হলে যে সহনশীলতা আমাদের দরকার তা আমরা প্রায় হারাতে বসেছি,
ফলে যা হবার তা-ই হচ্ছে, হবেও।
রোকসানা খন্দকার রুকু
অনেক ধন্যবাদ।
অনন্য অর্ণব
পড়তে পড়তে নস্টালজিক মেমোরি রিভিউয়ের কবলে পড়ে গেছিলাম। তবে ঠিক আছি এখনো, কেবল খুব মনে পড়ে গেছে আমার উচ্চমাধ্যমিকের রসায়ন শিক্ষক বাবু খগেন্দ্র কুমার সোম স্যারের বাসায় পড়তে যাওয়ার সেই দিনগুলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।