'খালাম্মা, মাইকে কি কয়?'
এমনিতেই মাইকের আওয়াজে রাহেলা বেগমের কান পাতা দায় , তার উপর সফুরাকে হাতের কাজ ফেলে বকবক করতে দেখে গা জ্বলে গেল। যদিও ঠান্ডা স্বভাবের রাহেলা বেগমের মুখে তার কোনোরকম অভিব্যাক্তি নজরে পড়ে না।
আজ এমনিতেই কাজের চাপ বেশি। বড় মেয়ের জামাই আসবে দুপুরে রাজশাহী থেকে। কি একটা অফিসিয়াল কাজে যেন ঢাকা আসছে । মেয়ের জামাই বলে কথা। সকাল থেকে তাই সফুরাকে নিয়ে রান্নার তোড়জোর চলছে যেন দুপুরের আগেই সব রান্না শেষ করতে পারেন।
হাতের ঝাঁঝড়িতে নতুন আলুর খোসাগুলো ডলে তুলতে তুলতে তাই তাড়া দিলেন , 'সব্জিগুলো জলদি কেটে দে সফুরা, রান্না বসাব।'
পেছনে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে অবাক হয়ে ফিরতেই দেখেন কোথায় সব্জী আর কোথায় সফুরা? বটির নীচে পটল বেগুণ সব গড়াগড়ি দিচ্ছে আর সফুরা রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান খাড়া করে মাইকের কথাগুলো গিলছে রীতিমত। এবার বিরক্ত হয়ে একটু জোরেই ডাক দিলেন।
'সফুরা!'
দৌড়ে এসে ঝটপট সব্জী কাটতে বসল মেয়েটা। যদিও মন তার মাইকেই পড়ে আছে। বিষয়টা খোলাসা হল একটু পরেই। কচি লাউটাকে বটিতে ফেলে পাকা হাতে ঘ্যাঁচ করে দুভাগ করেই মুখ খুলল ।
'খালাম্মা, মাইকে কইতাছে সরকার থেইকা নাকি মাইয়াগো এক মাসের জন্য সেলাই শিখাইব। যারা যারা শিখতে চায় তাগোরে ঐ প্রাইমারী স্কুলে গিয়া দেখা করতে কইছে। সরকারী লোকেরা ঐখানে সবার নাম ঠিকানা নিব । আমিও যামু খালাম্মা।'
' তুই সেলাই শিখবি! ' হাতের আলুগুলো ধুয়ে বাটিতে তুলে রাখতে রাখতে বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন।
একটু লজ্জা পেয়ে যেন মুখটাকে নীচু করল মেয়েটা। লাউগুলোকে তিনকোণা করে কাটতে কাটতে অস্ফুটে বলল, ' হ, খালাম্মা। অনেকদিনের শখ। আর সারাজীবন কি মাইনষের বাসায় কাজ করমু ? বাসা বাড়িতে কাম করলে দাম নাইগো খালাম্মা। সেলাই এর কাজটা শিখতে পারলে দর্জিবাড়িতে কাম নিতে পারমু। ইজ্জত আছে। ' মুখটা এবার প্রায় বটিতে ধরা লাউয়ের ডগাটার কাছে নিয়ে এল লজ্জায়। সকালের মিষ্টি রোদে সফুরার মুখে কেমন যেন এক গোলাপী আভা খেলা করছে।
হয়ত যে বাসায় এত বছর ধরে কাজ করছে সে বাসার খালাম্মাকেই এসব কথা বলতে লজ্জায় মরে যাচ্ছে । অথবা নিজের গোপন স্বপ্নটাকে বাস্তবায়নের আশায় বিভোর। কিন্তু তার অস্ফুট অথচ দৃঢ় কথা বলার ভঙ্গীই বলে দেয় সে যা বলছে তা আত্মবিশ্বাস থেকেই বলছে। সফুরার এই মানসিকতা ভালো লাগল রাহেলার। হঠাৎ করে যেন আজ তার সামনে অন্য এক সফুরাকে দেখতে পেলেন।
যে শ্রেণীতে সফুরার জন্ম, সেখানে থেকে প্রতিনিয়ত জীবনের সাথে যুদ্ধ করতে করতে 'ইজ্জতের কথা' ভাবা ; অর্থাৎ শারিরীক ইজ্জত না যা প্রত্যেক মেয়েই ভাবে, বরং সামাজিক 'ইজ্জত'কে গুরুত্ব দেয়াটা সফুরার মত মেয়েদের পক্ষে কঠিন। রাহেলা বেগম সেটা বোঝেন। অথচ সফুরাকে সেই ব্যাতিক্রম ভাবনাটা ভাবতে দেখে মনে মনে একটা স্যালুটই ঠুকে দিলেন তিনি। আজীবন এন জি ও তে চাকুরী করে নারী উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখে এসেছেন রাহেলা বেগম। যার জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন শোকেস ভর্তি। কিন্তু রিটায়ারমেন্টের পর আজ নিজের চোখের সামনে যে নারীকে দেখছেন তা যেন পুরো চাকরীজীবনে কখনো দেখেননি। সেলাই তো কতজনই শেখে, কিন্তু রাহেলা বেগম মুগ্ধ হলেন সফুরার মানসিকতায়।
'খালাম্মা, বাপ মা ছিল অশিক্ষিত। ঘরে কামাই ছিল না। পোলাপান কাউরেই তাই লেখাপড়া শিখাইতে পারে নাই। এই জমানায় অশিক্ষিতের দাম কি কন তো? এইজন্যেই মাইয়াডারে লেখাপড়া শিখাইতাছি। যেন আমার মত মাইনষের বাড়িতে কাম করন না লাগে। আমার মাইয়া চাকরী করব খালাম্মা। মাইয়ার বাপে কয়, মেয়েমানুষের অত পড়ালেখার দরকার কি? বিয়াই তো দিতে হইব। আমি কই, দরকার আছে। মাইয়া চাকরী করব, নিজে কামাই রোজগার করব। নিজের কামাই থাকলে আর জামাই এর লাত্থি গুতা খাওন লাগব না। নিজের একটা ডাঁট থাকব। কি কন খালাম্মা? আমিও তো কিছুই পারতাম না। মাইয়া আমারে ওয়ান টু শিখাইছে। ক খ শিখাইছে। মাইয়ারে কইছিলাম সেলাই শিখনের শখের কথা। মাইয়া কয়, ওয়ান টু না জানলে নাকি সেলাই শিখতে পারুম না। শেষে আমারে রাইতে বইসা বইসা একটু একটু কইরা সব শিখাইছে খালাম্মা। এখন তো নিজের নামটাও নিজে লিখতে পারি ! ' এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলে একটু হাঁপাতে লাগল সফুরা। রাহেলা বেগম মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছেন।
' তুই এই বয়সে এসে মেয়ের কাছে বসে এসব শিখেছিস? শুধু সেলাই শিখবি বলে! তাহলে এতদিন বসেছিলি কেন?'
'অনেক চেষ্টা করছি খালাম্মা শেখার। লোক পাই নাই। আর শিখাইতে অনেক ট্যাকা চাইত। আবার সারাদিন কাম কইরা খালাম্মা আর সেলাই শিখার টাইম পাইতাম না।শরীর ভাইঙ্গা খালি ঘুম আসে বাড়িতে ফিরলেই। এখন সুযোগ যখন পাইছি খালাম্মা একবার চেষ্টা কইরা দেখি। '
রাহেলা বেগম উৎসাহ দিতে এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন না। আজ যদিও রাজ্যের কাজ, তবু সফুরাকে একটু আগেই ছুটি দিয়ে দিলেন ভালোমত সব খোঁজখবর নিয়ে আসার জন্য।সফুরার সাথে সাথে রাহেলা বেগম নিজেও ভীষণ উৎসাহী হলেন তাকে স্বনির্ভর দেখতে।
পরদিন সফুরার আনন্দ আর ধরে না। কাজের সাথে সমান তালে তার মুখ চলতে লাগল, ' খালাম্মা সব খোঁজ নিয়া আসছি। এক্কেরে ডিটিল। এক মাসে সব ধরণের কাটিং শিখাইব।পায়জামা, জামা সব। সপ্তাহে তিনদিন কেলাস। সরকার নাকি ফ্রিতেই দিছে সব মাইয়াগো জন্য কিন্তু এই সরকারী লোকেরা খরচ ধরছে এক হাজার ট্যাকা.....'
সকালে নাস্তার পাট চুকিয়ে সবেমাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলেন রাহেলা বেগম।সফুরার কথায় রাগে গা চিড়বিড় করে উঠল তাঁর । কাপটা সযত্নে টি টেবিলে নামিয়ে রেখে সফুরাকে বললেন, ' সরকার ফ্রী দিচ্ছে তো টাকা নিবে কেন? ফাযলামী নাকি?'
সফুরা ড্রইংরুমের দামী শোপিসগুলোকে তখন লিকুইড ক্লিনারে ডলে ডলে ঝকঝক করছিল। ক্রিস্টালের শোপিসগুলো যত না ঝকঝক করছে, সফুরার চোখমুখ যেন তারচেয়েও বেশি চকচক করছিল এক অদ্ভুত আনন্দে। রাহেলা বেগমের মুগ্ধতা কিছুতেই কাটছিল না। এক অন্য সফুরা যেন তাঁর নতুন রুপ নিয়ে হাজির।
সফুরা হাতের শোপিসটাকে নামিয়ে রেখে বলল, 'সেলাই শেখা শেষ হইলে যারা ভালো করব তাগো নাকি একটা কইরা সেলাই মেশিন দিব খালাম্মা সরকার থাইকা। মনে হয় এইজন্যেই ট্যাকা নিতাছে।'
' সেলাই মেশিন যখন সরকার দিচ্ছে তখন ফ্রীতেই দিচ্ছে। এরা টাকাটা নিজেরা ভোগ করবে তাই নিচ্ছে। এ তো ভীষণ অন্যায়! এরা তোদের মত গরীব মানুষদেরকেও ঠকাচ্ছে আবার সরকারকেও ঠকাচ্ছে। তার উপর সরকার থেকে মেশিন কয়টা আনবে আর তোদেরকেইবা কয়টা দিবে কে জানে! এভাবেই তো লুটপাট করে এরা সরকারের বদনাম করে। চল তোর খালুকে নিয়ে গিয়ে দুটো ঝাড়ি দিয়ে আসি লোকগুলোকে আর টাকা নিতেও মানা করে আসি। গরীবের টাকা মেরে খাওয়ার শখ! সাহস কত !!'
রাহেলা বেগমের রাগ দেখে রীতিমত ভড়কে গেল সফুরা। খালাম্মা আর খালু গিয়ে সেখানে হৈ চৈ করে শেষে না তার শেখার সুযোগটাই হাতছাড়া হয়ে যায়! সরকারী লোক রাগ হয়ে গেলে কি আর তাকে নিতে চাইবে? মাত্র এক হাজার টাকাই তো! আর সবাইই তো দিচ্ছে। বরং এই টাকা দিয়ে যদি সেলাইটা শেখা যায় আবার মেশিনটাও পাওয়া যায় তাহলে কম কি? তার এত বছরের স্বপ্নটাও পূরণ হয়! এখন খালাম্মা গিয়ে না সব ভেস্তে দিয়ে আসে!আঁতকে উঠল মনে মনে।
হাতের ন্যাকড়া ট্যাকড়া সব ফেলে ফট করে এসে রাহেলা বেগমের পা জড়িয়ে ধরল , ' খালাম্মা, থাউক, আপনে রাগ হইয়েন না। এক হাজার টাকাই তো! মাইয়ার বাপে কইছে দিব । সবাই তো দিতাছে খালাম্মা। যেই দেশের যে নিয়ম। আপনে খালুরে কিছু কইয়েন না। আমি সেলাইটা শিখতে চাই খালাম্মা। ' চোখমুখে কাতরতা মিশিয়ে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যে রাহেলা বেগম মন নরোম করে নিলেন।
চোখের সামনে এত বড় অন্যায় সহ্য করা মুশকিল। কিন্তু সফুরার জন্য মায়া হল। থাক, মেয়েটা যদি এই টাকাটা খরচ করতে চায় করুক। তবু শেখাটা হোক। সেলাই মেশিনটা পেয়ে গেলে আর টাকার কষ্ট গায়ে লাগবে না। আর দেশের সর্বস্তরে যেখানে কোটি কোটি টাকার লুটপাট চলছে সেখানে এই কয়েক হাজার টাকার অন্যায় দেখে এই বয়সে হৈ চৈ করে প্রেশার বাড়িয়ে কি লাভ? আস্তে করে পা ছাড়িয়ে নিয়ে সফুরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। 'ঠিক আছে, তুই যেভাবে চাস সেভাবেই শিখ। তবু নিজের স্বপ্নটা পূরণ কর।'
সফুরা ফ্লোরে পা গুটিয়ে বসে আস্তে করে রাহেলা বেগমের পায়ের উপর নিজের গালটাকে চেপে ধরল। ' খালাম্মা, আমি খুব মন দিয়া শিখমু দেইখেন। সবার চেয়ে ভালো করমু। তাইলে আমারে মেশিন দিব বলছে।' বলতে বলতে আগামী স্বপ্নের চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে গেল সফুরা। ' সেলাই মেশিন পাইলে একটা দর্জির দোকান দিমু ঠিক করছি। পাশের ঘরের সালমা আর জুলেখাও বলছে আমার সাথে কাজ করব। আমরা তিনজন মিলা দোকানের কাজ করমু খালাম্মা। যদি ভালোমত চালাইতে পারি , আস্তে আস্তে দোকান বড় করমু। আশেপাশের মাইয়াগো কাম শিখায়া আমাগো সাথে কামে নিমু। সবাই মিলা কাজ করলে বেশিদিন লাগব না দর্জির ফ্যাক্টরি দিতে, কি কন খালাম্মা? সবাই মিলা মাথা উঁচু কইরা চলমু। মাইয়াগো আর কষ্ট থাকব না!'
সফুরা বকবক করে যায় তার স্বপ্নের বর্ণনায়, রাহেলা বেগম নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন স্বপ্ন দেখা মেয়েটির দিকে। এমনিতে শক্ত মনের মানুষ হলেও আজ কেন যেন বার বার চোখে পানি চলে আসছে সফুরার কথা শুনতে শুনতে। সেই পানি লুকোতেই যেন ঝারি দিয়ে উঠলেন, ' ঠিক আছে , ঠিক আছে।তোদের 'দর্জির ফ্যাক্টরি' যখন হবে তখন দেখা যাবে, এবার জলদি ঘর মোছাটা শেষ কর আগে।রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। '
সফুরা হুঁশ ফিরে ঝটপট কাজে হাত লাগালো। পেছনে রাহেলা বেগম লুকিয়ে শাড়ির আঁচলে দু ফোঁটা চোখের পানি মুছে নিলেন দেখতেও পেল না।
রোজ দুপুরে একটু আগেভাগেই আজকাল সফুরাকে ছুটি দিয়ে দেন । দুপুরে তার সেলাই ক্লাস থাকে। রাহেলা বেগম নিয়ম করে খোঁজ খবর নেন শেখা কেমন চলছে, নিয়ম করে যাচ্ছে কিনা। সফুরার অতি উৎসাহে একদিন গিয়ে দেখেও আসলেন সরেজমিনে । প্রায় বিশ পঁচিশজন মেয়ে সেলাই শিখছে সেখানে। সবার মধ্যে সফুরাই বেশ ভালো করছে। একটা সেলাই মেশিন পাওয়ার জন্য মেয়েটা কি পরিশ্রমটাই না করছে! সফুরার অধ্যবসায় রাহেলা বেগমের মমতা যেন দশগুণ বাড়িয়ে দেয়।
এক মাসের মধ্যে সফুরার সব শেখা শেষ। পরীক্ষাতেও খুব ভালোভাবেই পাশ করেছে। খুশি যেন আর ধরে না। সেলাই শেখানোর স্যার নাকি বলেছে আর কেউ পাক না পাক সফুরা একটা মেশিন পাবে নিশ্চিত । সেই খুশিতে আজ সকাল সকাল ঝটপট কাজ সেরে স্কুলে গিয়েছে সফুরা। আজ নাকি সেলাই মেশিন দিবে। মেশিন পেয়েই সবার আগে রাহেলা বেগমকে ফোন করে জানাবে বলে গেছে। যাওয়ার আগে পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতেও ভোলেনি। খালাম্মার উৎসাহেই তো এতদূর আসা, স্বপ্নের পেছনে এমনভাবে দৌঁড়ানো।
সুখবরটা শোনার জন্য তিনিও সকাল থেকেই অস্থির হয়ে আছেন। যদিও মেশিন পেলে আর কাজ করবে না বলেছে সফুরা। সেটা নিয়ে মাথাব্যাথাও নেই রাহেলা বেগমের। বরং মেয়েটা সম্মানের সাথে বাঁচুক এটাই মনে প্রাণে চান। স্বপ্ন তো কতজনই দেখে, কিন্তু সফুরার মত দীর্ঘদিন স্বপ্নকে লালন করে তা সফল করতে উঠেপড়ে লাগতে পারে কজন?
কলিং বেল এর শব্দে চমকে উঠলেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর অথচ সফুরার কোনো খোঁজ নেই। চিন্তিত মুখে দরজা খুলতেই দেখেন সফুরা। সকালের ঝলমলে মুখটায় কে যেন জোর করে কালি লেপে দিয়েছে, মুখ দেখে এমনটাই লাগছে । অথচ মেশিন পেয়ে তো মুখজুড়ে চাঁদের হাসি থাকার কথা! তাহলে?
'কিরে, ফোন দিলি না যে? কি হয়েছে?'
ঘরে ঢুকেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সফুরা। কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। হতচকিত রাহেলা বেগম দ্রুত দরজা লাগিয়ে সফুরার দুহাত ধরে আস্তে করে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আবারো জিজ্ঞেস করলেন, 'কিরে, কি হয়েছে বলবি তো!' অজানা আশঙ্কায় রাহেলা বেগমের বুক কাঁপছে, কিন্তু বুঝতে দিলেন না। বার বার জিজ্ঞেস করতে আস্তে আস্তে চোখ মুছে সফুরা বলল,
'খালাম্মা, সকাল থেইকা বইসা আছি স্কুলে। কারও কোনো খোঁজ নাই। যারা যারা শিখছি সবাই গেছিলাম। শেষে শুনি হেরা নাকি সব জিনিসপত্র কাগজপাতি নিয়া কাইল রাইতেই কই গেছেগা কেউ জানে না! ফোনেও চেষ্টা করছে সবাই। ফোন বন্ধ। সবাইরে ঠকায় দিয়া গেছেগা গো খালাম্মা! এখন কি হইব ! আমি তো মেশিন পাইলাম না! এই সেলাই শিখা আমি এখন কি করমু গো! এই সেলাই তো আর কামে লাগব না গো! সারাজীবন মাইনষের বাসায় কাম কইরাই খামু খালাম্মা। আমার সব আশা শ্যাষ হইয়া গেছেগা গো! আমি এখন কি করমু গো!' বলতে বলতে আবার কান্না শুরু করে দিল সফুরা। নিজের স্বপ্নের ধ্বংসস্তুপে দাঁড়িয়ে একটি নিতান্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত মেয়ে কান্না ছাড়া আর কীইবা করতে পারে!
সফুরার কান্না দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন রাহেলা বেগম। স্বপ্ন ভাঙ্গার কষ্টটা যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন নিজেও। একটা মাস কি পরিশ্রমটাই না করেছে মেয়েটা! সারাদিন কাজের ফাঁকে স্কুলে গিয়ে সেলাই শেখা, আবার ফিরে এসে মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করা, সন্ধ্যায় বস্তিতে ফিরে নিজেদের রান্না শেষ করেই স্কুলের সেলাই নিয়ে বসা, রাত জেগে সেলাই এর কাজ করে আবার ভোরে উঠেই 'ছুটা কাজের' দৌড়। রাহেলা বেগম নাহয় এই একমাস ছাড় দিয়েছিলেন, কিন্তু অন্য বাসার মালিকরা তো দেয়নি। তবু কি বিপুল উৎসাহে যে এত পরিশ্রমের পরেও নিয়মিত সেলাই শিখে যাচ্ছিল মেয়েটা, এই একটা মাস শুধু সেটাই দেখছিলেন রাহেলা বেগম। আজ সফুরার কান্নাটা যেন তাঁর নিজের বুকে এসেই ধাক্কা দিচ্ছে বার বার। এত বড় প্রতারণা এই দরিদ্র মানুষগুলোর সাথে বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে!
সফুরার মত মেয়েদের যেখানে স্বপ্ন দেখাই পাপ, সেখানে মেয়েটি রীতিমত এক মাস যাবত মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দুঃস্বপ্ন দেখে আসছিল। কিছু লোভী , প্রতারকের কারণে সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে এ যেন মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, না, সফুরার স্বপ্নকে তিনি কিছুতেই ব্যার্থ হতে দিবেন না।
'সফুরা, যা হাত মুখ ধুয়ে আয়। তারপর চল আমার সাথে।'
হেঁচকি তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করে সফুরা, 'কই যাইবেন খালাম্মা, স্কুলে তো কেউ নাই। সবাই বইসা থাইকা গেছেগা।আর যারা মাস্টর, সেলাই শিখাইছে, হেরা কই পলাইছে কেউ জানে? হেগোরে আর কই পাইবেন খালাম্মা?'
ভেতরের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে গম্ভীর কন্ঠে বললেন রাহেলা বেগম, ' স্কুলে না। 'সিঙ্গারের' দোকানে চল। আজই তোকে একটা মেশিন কিনে দিব। তুই ঐ মেশিন দিয়ে দর্জিবাড়ি দিবি, আস্তে আস্তে ফ্যাক্টরি করবি, সবাইকে নিয়ে তোর স্বপ্নটাকে পূরণ করবি। আমি তোর পাশে থাকব । তোকে আর এভাবে মানুষের বাড়ি কাজ করা লাগবে না। তুই তোর স্বপ্নটাকে পূরণ কর।'
সফুরার হা করা মুখের দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, ' আর শোন, মেয়েটাকে ভালোমত মানুষ করবি। নিজে যেমন সম্মান নিয়ে বাঁচতে শিখেছিস , মেয়েটাকেও শেখাবি। এইবার নে , হাউমাউ কান্না বন্ধ করে উঠে পড় আর আমার শাড়ি বের করে দে কোনটা পড়ে বের হব। '
সফুরা ততক্ষণে দ্বিতীয় দফা রাহেলা বেগমের পায়ের কাছে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে,'না, না, খালাম্মা, আমার কিচ্ছু লাগব না। কিচ্ছু লাগব না। '
রাহেলা বেগম জোর করে ফ্লোর থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালেন সফুরাকে। না, সফুরাকে না, যেন সফুরার স্বপ্নটাকেই হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
Thumbnails managed by ThumbPress
১৭টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
পড়লাম অল্প পরে আসছি আপু।
অশোকা মাহবুবা
অবশ্যই। অপেক্ষায়।
মোঃ মজিবর রহমান
শুভেচ্ছা অবিরত🖐
আরজু মুক্তা
এমন করে কজনাই ভাবে?
ভালো লাগলো। আমি আমার বুয়াদের নিয়ে গিয়ে ডিপিএস করে দেই। কখনো যদি কাজে লাগে।
ধন্যবাদ আপনাকে।
অশোকা মাহবুবা
অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য। এটা আসলে গল্পই। তবে আপনিও যে এমন করে ভাবেন জেনে সুখী হলাম। গল্পের উদ্দেশ্যই তো হলো পাঠককে চিন্তার খোরাক জোগানো। সেই অর্থে আপনি তো এগিয়েই আছেন অনেক আগে থেকেই। ভালো থাকুন। শুভ কামনায়।
আরজু মুক্তা
দোয়া করবেন।
মোঃ মজিবর রহমান
খুব ভাল লাগ্ল আপু।
অশোকা মাহবুবা
অনেক ধন্যবাদ ভাই কষ্ট করে পড়ার জন্য। শুভ কামনায়।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনাকেও আন্তরিক অভিনন্দন🖖
সাবিনা ইয়াসমিন
চেষ্টা থাকলে স্বপ্ন আর বাস্তবতার দুরত্ব খুব বেশি হয়না। সফুরাদের উদ্যম তাদের ঠিকই স্বপ্ন পূরণের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেয়। রাহেলা বেগমদের মত সাহায্যকারীরা সেই স্বপ্নগুলোকে আলোর পথ দেখান অকুণ্ঠিত হয়েই। ভালো লাগলো গল্পটি।
শুভ কামনা আপু, ভালো থাকুন 🌹🌹
অশোকা মাহবুবা
আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপু। ঠিক বলেছেন, চেষ্টাই স্বপ্নকে পূরণের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়। গল্পটি মন দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। শুভ কামনা।
তৌহিদ
লেখাটি গতকালই পড়েছি। আসলে কে কি কাজ করে সেটা বড় বিষয় নয়, আমাদের স্বপ্ন দেখার মানসিকতাই বড় বিষয়। রাহেলা বেগমের জায়গায় আমি থাকলেও একই আশ্চর্য অনুভূতি নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম।
মানুষ নিজেদের ভবিষ্যৎ ভালো করার জন্য কত কিছুইনা করে তার সব খবর কি আমরা রাখি?
গল্প ভালো লেগেছে আপু। আর এতদিন পরপর হাজিরা দিলে চা তো ঠান্ডা হয়ে যাবে। গরম চা খেতে চাইলে নিয়মিত সামান্য সময় করে আসুন। সোনেলা আপনাকে পেয়ে সত্যি আনন্দিত।
ভালো থাকবেন।
অশোকা মাহবুবা
মন দিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আসলে রোজ হাজিরার ইচ্ছে থাকলেও নানান কাজে পথ হারিয়ে ফেলি ভাই। তবে চেষ্টা করব অবশ্যই আরেকটু নিয়মিত হতে ইনশাল্লাহ। অনেক ধন্যবাদ। শুভ কামনায়।
জিসান শা ইকরাম
অনেক আশা জাগানিয়া গল্প,
সফুরারা এমন স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে আজকাল,
এমন রাহেলা বেগমও দুর্লভ।
তারপরেও এমন স্বপ্ন দেখা সফুরা আছে, রাহেলা বেগমও আছে।
সফুরাদের স্বপ্ন পুরনে এমন রাহেলা বেগমদের প্রয়োজন খুব বর্তমানে।
আপনি গল্প খুবই ভালো লেখেন।
শুভ কামনা
শুভ ব্লগিং।
অশোকা মাহবুবা
আপনার শারীরিক এই অবস্থাতেও এত বড় গল্পটি কষ্ট করে পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। রাহেলা বেগমদের নতুন করে ভাবাতেই এই গল্পের সূচনা। ভালো লেগেছে শুনে ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ। নিজের যত্ন নিবেন। সোনেলাকে এগিয়ে নিতে আপনার সুস্থ থাকাটা অত্যন্ত জরুরী। শুভ কামনায়।
ছাইরাছ হেলাল
অনেক সুন্দর উপস্থাপন, কোথাও থেমে যায়নি,
নিয়মিত লিখতে শুরু করুন।
অশোকা মাহবুবা
লেখার জন্য যে মাথা দরকার সেই মাথাটাই কাজ করে না ইদানিং। এই লেখাটা গত বছরের হুট করে লেখা। অনলি মি করে রেখে দিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই মনে হলো সোনেলায় দেই। ভালো লেগেছে শুনে আমারো খুব ভালো লাগল। ইনশাল্লাহ চেষ্টা করব লেখালেখিতে একটু মনোযোগ দিতে।ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন। শুভ কামনায়।