বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, তিনি বেঁচে না থাকলেও আমি এ বাড়িতে আসবো, হাজারো ব্যস্ততা পিছনে ঠেলে হলেও আসবো। গিয়েছি। আগের মতো উচ্ছাস নেই, আনন্দ নেই। পুরোটা পথ অনুভূতিহীন এক প্রাণ নিয়ে গিয়েছি যদিও, কিন্তু রাতে ঘুমোতে গিয়ে আবিস্কার করি, আসলে বাবার বাড়ি, বাবার বাড়িই।যেখানে গেলে কোন দ্বায়িত্ব কিংবা ভাবনা থাকেনা। কেমন যেন এক শান্তি শান্তি ভাব লেগে থাকে মনে, প্রাণে এবং শরীরে।নিশ্চিন্ত এক জীবন। বাবা-মা’র শূন্যতা ছিল যদিও, কিন্তু সেখানকার প্রতিটি ইট-পাথরে, আসবাবপত্রে বাবা-মা’র ছোঁয়া তো লেগে আছে।
গ্রামে দাদার বাড়ি গিয়ে মনটা বিষন্ন হলো কিঞ্চিত। আমাদের ছোটবেলায় সেই আটের দশকের শুরুর দিকে শখ করে একতলা বাড়িটি নির্মান করেছিলেন বাবা। ! অথচ অযত্নে, অবহেলায় সবকিছু কেমন ভগ্নপ্রায় ! বাড়ির পিছনে বিশাল বাগান। নারকেল, সুপারী, আম সহ কতরকম গাছ সেখানে ! নিজহাতে কত যত্ন করেই না লাগিয়েছিলেন। গাছগুলো একই ভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কাকার ঘরে গিয়ে বসি। বাবার একমাত্র ছোটভাই। সেই আগের মতোই স্নেহ, মায়া আর গভীর মমতায় কাছে ডেকে বসায়। এটা সেটা খেতে দেয়। বাবা-কাকার মাঝে চিরকালই মতবিরোধ ছিল। কখনো খুব ভাব, কখনো মুখ দেখাদেখি বন্ধ। দুই ভাইয়ের মাঝে সম্পৰ্ক যা-ই থাকুক না কেন আমরা কখনোই কাকার আদর ভালোবাসা থেকে বিন্দুমাত্র বঞ্চিত হইনি। কাকীমা দুপুরের খাবারের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠেন। বলেন, তোর বাবা-মা নেই তো কী হয়েছে, আমরা আছি না ? আসলে রক্ত সম্পৰ্কগুলো মনে হয় এমনই। যুগ যুগ পর দেখা হলেও সেই নির্ভরতার হাত মাথার উপর ছায়া দিবেই।আগলে রাখবেই। দুপুরের পর আমরা তিন ভাইবোন দীঘির জলের পাশে বসি ক্ষণিক। যে দীঘিতে বাবা-চাচা’রা ধুপধাপ ঝঁপিয়ে পড়তো, ডুবতো, আবার ভেসে উঠতো। সাঁতরে এপাড় ওপাড় যেতো।
এখান থেকে কবরস্থান বেশ কাছাকাছি দূরত্বে। চারদিকে ইটের দেয়াল তোলা। পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকালীন সময়ে বাবা গ্রামে এবং শহরে ইটের দালান তৈরী করে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করেছিলেন। জীবনের শেষ সময়ে যখন প্যরালাইজড শরীর নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গ্রামে যেতেন, আমি কপট রাগ হতাম। ফোন করে বলতাম, কেন অসুস্থ শরীর নিয়ে এতো খাটাখাটুনি করছেন ! মানুষ কি তাঁর শেষ সময়টুকুনের আভাস আগেভাগে বুঝতে পারে ? কিংবা জীবনের শেষ সময়ে মানুষ কি তাঁর শৈশব, কৈশোরের স্থানে ফিরে যেতে চায় ? নইলে বাবা কেন তখন অসুস্থ শরীর নিয়ে এতো ঘন ঘন গ্রামে যেতেন ! বলতেন, কবরস্থানের চারপাশটায় ওয়াল তুলে দেই, গরু-ছাগল যেনো ঢুকতে না পারে। মরলে তো আমাকে এখানেই মাটি দিবে। আমি হাসতাম। ভাবতাম মৃত্যুর পর নিজের মৃতদেহ নিয়ে কেউ ভাবে নাকি! আমার বাবা ভাবতেন।আমাদের পুরো গ্রামের কবরস্থানের চারপাশে ওয়াল তুলেছেন গবাদি পশু যেন অবাধে সেখানে বিচরণ করতে না পারে, অপরিস্কার করতে না পারে। যে বাবা জীবনভর পরিচ্ছন্ন থেকেছেন, পরিকল্পনার মাঝে সামনে এগিয়েছেন। সেই বাবা-মা এখন নিজেদের প্রস্তুত করে রাখা কবরে ঘুমিয়ে আছেন। আমরা তিন ভাইবোন বাবা-মা এর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকটা সময়। এই যে আমি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে দূর পরবাস থেকে এসেছি, সাথে আমার ভাইবোনেরা ঢাকা থেকে এসেছে, বেঁচে থাকলে কতোই না খুশি হতেন তাঁরা। তাঁদের আনন্দিত, উচ্ছসিত হাসিমাখা মুখ যেন জ্বলজ্বল করছিল চোখের সামনে। এমন নানান টুকরো টুকরো বিষয় মনে পড়ছিল। আমি বাবা-মা’র সমাধিফলকে হাত ছোঁয়াই।আমার মনে হচ্ছিল, আমি বাবা-মা’কে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অঝোরে কাঁদি। আমার ভাইবোনও অশ্রুজলে ভাসে।আমরা কেউই কাউকে শান্তনা দেইনি। কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম মনে নেই।অদূরেই, পাশ দিয়ে বহমান স্রোতশ্বিনী নদীর ধারে অপেক্ষমান গাড়িটি দাঁড়িয়েছিল। হাতের তালুতে চোখ মুছে গাড়ির দিকে ফিরছিলাম। অবচেতন মনে, মনে হলো যেন দুটি মানুষ করুণ চোখে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে তীব্র আকুতিতে বলছেন, “ চইলা যাইতাছস ? আরো কিছুক্ষণ থাক না রে, মা। “ আমি এক পা, দু’পা করে ফিরে আসি।প্রতিবার আমার বিদায়বেলায় বাবা এমন করে বলতেন, “ আর কয়টাদিন থাক্ না রে মা।“ আমি খুব ধীরে আবারো বাবা-মা’র কবরের পাশে এসে দাঁড়াই। বুকফাটা আর্তনাদে অঝোরে কাঁদি,নিঃশব্দে । মৃত বাবা-মা’র কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এমন হৃদয় বিদীর্ন করা হাহাকার সেখানে ঘুমিয়ে থাকা আমার সকল পূৰ্ব পুরুষেরা শুনতে পেয়েছেন কিনা জানিনা। তবে আকাশের ওইপাড়ে যে স্রস্টা থাকেন, তিনি নিশ্চয়ই শুনবেন, হয়তো মুখ তুলে তাকাবেন পৃথিবীর দিকে, বাবা-মা’র কবরের পাশে বুকচেরা দীর্ঘশ্বাসে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের তিন ভাইবোনের দিকে।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৩টি মন্তব্য
মাহমুদ আল মেহেদী
আপনার লেখার মাঝে আমি নিজেকে দেখতে পেলাম ।
রিমি রুম্মান
এই একটা জায়গায় সন্তানদের অনুভূতিগুলো প্রায় একই রকম।
মৌনতা রিতু
একান্ত অনুভূতির এই প্রকাশ তোমার খুব টানে আসলে।
একটানা পড়ে নেয়া যায়।
রক্তের সম্পর্কগুলোতে ফাঁটল ধরলেও তা অটুট থাকে।
শেকড় গাছ ডালপালা
রিমি রুম্মান
খুব সুন্দর করে লিখলে। ভালোবাসা।
মোঃ মজিবর রহমান
ঠিক বলেছেন আপু, ম্রিত্যুর পূর্বে জানতে পারে । আমি মাকে বিদায় দিলাম মা তুমি যাও আমি আগামী সপ্তায় আসছি, কিন্তু আল্লাহর কি অসীম ইচ্ছা মাকে আর মা বলে ডেকে সারা দিতে পারিনি। কারণ সন্ধ্যায় পৈছে খাওয়া ও কিছুক্ষন গল্পর পর ব্রেন স্ট্রক পরের দিন সন্ধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাকে জিবিত পাইনি। ঠিক ৮ কিংবা ৯ মাসের মাথায় বাবাও চলে গেল। তখন দুনিয়াটা ভার ভার লাগতেছিল।
এখন গেলে কবর চেয়ে ফেল ফেল করে তাকিয়ে থাকি।
রিমি রুম্মান
এরচেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী হতে পারে ! আমার বাবা-মা দুই বছরের ব্যবধানে দুজনেই চলে গেলেন আমাদের সকলের মায়া ত্যাগ করে।
মোঃ মজিবর রহমান
সকলের বাবা-মা বেহেস্তে বাস মরুক, আমিন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
আমি বাবা-মা’র সমাধিফলকে হাত ছোঁয়াই।আমার মনে হচ্ছিল, আমি বাবা-মা’কে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অঝোরে কাঁদি।
চোখে জল এসে গেল
আমিও যে এতিম।
ঐপারে সকল মা বাবারা ভাল থকুক এই কামনা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুক আমাদের সকলের বাবা, মা। যেখানেই থাকুক।
নীলাঞ্জনা নীলা
মা-বাবা আজীবনই সন্তানের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকেন। রিমি আপু তোমার এসব লেখায় এতো আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি, কী লিখবো বুঝে পাইনা।
নিজেকে ভালো রেখো আপু। (3
রিমি রুম্মান
সারাদিনের কর্মব্যস্ততায় ভাল থাকি। রাতে চোখ বুজলেই ফিরে ফিরে আসে শৈশব, বাবা, মা , আরো কত কী ! সব অনুভূতি যদি লিখে বুঝানো যেত !
জিসান শা ইকরাম
মনটা আদ্র হয়ে গেলো দিদি ভাই,
বাবার কবরের পাশে গেলে এমনই এক অনুভুতি আমাকে গ্রাস করে।
চলে যাওয়া বাবা মা এরা ভাল থাকুক,
রিমি রুম্মান
🙁