শিকার ……… বন্দনা কবীর

বন্দনা কবীর ১৪ আগস্ট ২০১৩, বুধবার, ১২:১৫:১৩অপরাহ্ন গল্প ২৪ মন্তব্য

১/
ঈদের পরে রাজ্জাক ভাইয়ের বাসার ঈদ পার্টিটার জন্য একরকম অপেক্ষাই করে থাকে জুবায়ের। গত ছয় সাত বছর ধরে রাজ্জাক ভাইয়ের ঘনিষ্ট বিশ পঁচিশজন বন্ধুকে নিয়ে আয়োজিত এই বিশেষ পার্টিতে জুবায়েরেরও নিমন্ত্রণ থাকে পরিবার সহ । বরাবরের মতন এবারো নিমন্ত্রণ পেয়ে যথাসময়ে এসে হাজির হয়েছে জুবায়ের স্ত্রী শাম্মি আর ছেলে জিয়াদকে নিয়ে । রাজ্জাক ভাইয়ের বিশাল ট্রিপলেক্স টাইপের বাড়ির এক তলায় বাচ্চাদের খেলার ঘর । অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে জিয়াদকে ভিড়িয়ে দিয়ে উপরে উঠে আসে জুবায়ের শাম্মিকে নিয়ে। দোতলার সারি সারি শোবার ঘর আর ফ্যামিলি স্পেস ফেলে প্যাচানো সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠে যায় সোজা। তিনতলার হলরুমে নরম গালিচা বালিশ বিছিয়ে গানের আসর বসেছে জম্পেশ । চার পাঁচ জন বিভিন্ন ঘরানার নামকরা গায়ক গায়িকা বসে আছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে । এদের কেউ বাংলা গাইবেন, কেউ হিন্দি চটুল, কেউ বা গজল কেউ ইংলিশ । এখন চলছে গজল। শ্রোতাদের হাতে হাতে বরফ কুঁচি মেশানো সোনালী তরল । নারী পুরুষের সম্মিলিত হাসি কলরবের মধ্যে এসে আয়েশ করে বসে জুবায়ের । হাতে শক্ত পানীয়র গ্লাস । শাম্মিকে একটু পান করার জন্য চাপাচাপি করে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেই চুমু খেতে থাকে গেলাসের ঠোঁটে। গান চলছে সাথে মজাদার স্ন্যাক্স, চিজ । শাম্মি কিছুক্ষন হাসিমুখে বসে এর তার সাথে টুকটাক আলাপ করে আর নীচে গিয়ে ছেলেকে দেখে আসে। এই সব পার্টি শাম্মি খুব একটা এঞ্জয় করে বলে মনে হয় না জুবায়েরের। জিজ্ঞেস করলে অবশ্য বলে, ‘নাহ, ভালোই তো লাগছে। তোমরা এঞ্জয় করছো দেখতেও তো ভালো লাগে’ শাম্মি মেয়েটা অনেক লক্ষ্ণী’ ভাবে জুবায়ের। শুধু যদি আরো একটু স্মার্ট হত। স্মার্ট মানে পার্টির অন্য মেয়েগুলোর মতন একটু চটুল, আড্ডাবাজ ফূর্তিবাজ । না, সেরকম করে কমপ্লেইন নেই জুবায়েরের শাম্মির প্রতি, তারপরেও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আর কি । শাম্মিও বোঝে জুবায়েরের ইচ্ছেটা কিন্তু আজন্ম লালিত সংষ্কারটা ভাংতে পারেনা বলে একটু কুন্ঠিতও থাকে স্বামীর মন না রাখতে পারায় । এটাও ভাল লাগে জুবায়েরের। থাক, বাঙ্গালী মেয়ের তো এরকমই আচরন হবার কথা নাকি? রাত বাড়ে... চুমুকে চুমুকে শরীর অবশ হতে থাকে । শাম্মি কয়েকবার এসে ডেকে গেছে ওঠার জন্য। জুবায়ের ঘড়ি দেখে আরেকটু থাকি’ বলতে শাম্মি চলে যায়। শেষ মেষ শাম্মি আর জিয়াদকে নিয়ে দুই চাকার বাইকে ওঠে যখন তখন রাত দুটো চল্লিশ পার করে গেছে। হালকা শরীর কাঁপছে। শক্ত হাতে হ্যান্ডেল চেপে ধরে বাইকে স্টার্ট দেয় জুবায়ের। সুনসান গুলশান এলাকা। অলি গলি পার করে বনানী ঢোকার ব্রিজ পার হবার আগে আগে একটা তীব্র আলোতে চোখ ধেঁধে যায় জুবায়েরের।

২/
বিকাল বেলায় গাড়ি পোড়ানোর জন্য এক কেজি গান পাউডারের সাথে দুইটা আদেশ আর কড়কড়ে বিশ হাজার টাকা পেয়ে মন ভালো হয়ে গিয়েছিল বাশারের। কথা ছিল কাজ শেষ করে আরো তিরিশ পাবে । কিন্তু সন্ধ্যে আটটা বাজতে না বাজতেই মেজাজ চূড়ান্ত খারাপ হয়ে গেছে বাশারের। আগুনে যে বাশারের ভয় সেটা লিডারের জানার কথা না। কারন বাশার ডেয়ারিং টাইপের লোক এটা এক কথায় সবাই স্বিকার করে। খুন খারাবি তার বা হাতের কাজ। খুন মার্ডার বাশার কমও করে নাই জীবনে কিন্তু আগুন টাগুন লাগানো বা এই জাতীয় কাজ সে কখনোই করেনি। এই সব তার মত পাঁকা কর্মিরও নয়। তাই আগুনে যে তার ভয় আছে এটা প্রকাশও পায় নাই । আজকেও পেতো না। কিন্তু নিজের গাধামির জন্য আজকে তার এই দূর্বলতার কথা লিডার সহ অনেকেই জেনে গেছে ।

হরতালের আগের দিন হিসেবে সব সময়েই কয়টা গাড়ি টাড়ি পুড়িয়ে প্যানিক সৃষ্টি করার নিয়ম। এই সব কাজে এক্সপার্টদের একজন পাতি লিডার অসুস্থ্য হওয়ায় এবারেই প্রথম বাশারের দায়িত্ত্বে পড়েছিল এই কাজের। বাশারও নিশ্চিত ছিল তাহিল রব্বানিকে দিয়ে আরামসে কাজটা করিয়ে নেবে। কিন্তু ছাগল তাহিলের মাতুব্বরির জন্য বাশারের আম ছালা সবই গেল । বাসে আগুন দিতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়ে গনধোলাইয়ের পরে হাস্পাতালে পৌছে গিয়ে বাশারকেও ডুবিয়ে দিয়ে গেছে তাহিল । রব্বানি প্রাণ হাতে করে বেঁচে ফিরলেও লাভ হয়নি ছিটে ফোঁটাও । মালিবাগের দিকে ওদের দুইজনকে গান পাউডার দিয়ে পাঠিয়ে বাশার দ্বিতীয় কাজটা নিয়ে চিন্তা করছিল। একটা বাসে আগুন লেগে যাওয়ার পরে পুলিশ জনতার দৌঁড়াদৌঁড়ির মধ্যে নিজেদের একজন নতুন রিক্রুট সাথিকে ফেলে দেওয়ার নির্দেশ ছিল লিডারের । রাজনীতির খেলাতে একটা লাশ বড়ই দরকার । বাশার তাই নিয়েই মাথা খাটাচ্ছিল। ‘কাকে ফেলা যায় কাকে ফেলা যায়’ ভেবে শেষ করবার আগেই তাহিলের ধরা পড়া এবং মার খাওয়ার সংবাদ নিয়ে হাজির রব্বানি । একরামুল আর নিজাম ছিল বাশারের সাথে । রব্বানি সংবাদটা দেওয়ার সাথে সাথেই নিজামের পায়খানা চাপলো । পেট চেপে ধরে গায়েবও হয়ে গেল । এই নিজামই গিয়ে বাশারের কীর্তি ফাঁস করে দিয়েছে লিডারের কাছে। নিজাম যে লিডারের চর এটা জানা থাকলে জায়গাতে ওকেই ফেলে দিতো বাশার দুইবার চিন্তা না করে। চর টিকটিকি দু চক্ষে দেখতে পারেনা বাশার তা সে যত করিৎকর্মাই হোক না কেন। বাশারের বিশ্বাস এরা দুই মুখা সাপ । সুযোগ পেলেই ছোঁবল দেবে । তাই-ই হয়েছে । লিডারের কাছে গিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে তো? উফ্‌, সংগঠনে যোগ দেওয়ার এই এতো বছরে এতো কুৎসিত গালি খায় নাই বাশার । ফোনের মধ্যেই লিডার বাশারের মা বোন চৌদ্দ গুষ্টিকে রেপ করে দিয়েছে । এতো নোংরা ভাষায় বাশারও কোনোদিন কারো সাথে কথা বলছে বলে মনে করতে পারছেনা। এখনো কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে বাশারের আর রাগে শরীর জ্বলছে। লিডারের হুকুম ছিল যদিও সোজা তার কাছে যাওয়ার জন্য। বাশার শোনেনি। আর এই না শোনার ফল যে মোটেই ভালো হবেনা তাও জানা আছে তার ভালোই। কিন্তু এই মূহুর্তে লিডারের সামনে যাওয়া আর ক্ষুধার্ত বাঘের মুখে যাওয়ার মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। পরেরটা পরে দেখা যাবে ভেবে ধানাই পানাই দশ লাইন বলে কয়ে ফোন সুইচড অফ করে দিয়ে রেড বাটনে চলে গিয়েছে প্রথমে । সেখান থেকে দুই বোতল হুইস্কি কিনে সিএনজি নিয়ে সটান বনানী । রাত আড়াইটা পর্যন্ত বন্ধু শাফায়াতের বাসার ছাদে বসে বসে দুই বোতলই খতম করেছে তিনজনে মিলে। ওভার হেডেড হয়ে পরে রাস্তায় নেমেছে তিনজনে । রাস্তাটাও তেমন সুনসান । একেই ঈদের ছুটি তার উপরে হরতালের আগের দিন। পাব্লিক আরো নাই রাস্তা ঘাটে । দূর থেকে নাইট গার্ডদের একটা দুইটা বাঁশি শোনা যায় কি যায় না। শাফায়াতের নতুন কেনা পালসারে চড়ে তিনজনে ব্রিজটার মাথায় এসে থামতেই একটা মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ পায় বাশার। বনানী গুলশানের মধ্যে করা নতুন ব্রিজটার কয়টা লাইট এর মধ্যেই ফিউজ বলে ছায়াচ্ছন্ন হয়ে আছে জায়াগাটা । ক্রুর হেসে বাশার শিকারকে ব্রিজের এই মাথায় আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে শাফায়াতকে । রাগ আর মদের মিলিত রিয়েকশনে বাশারের শরীর মাথা ভিসুবিয়াসের মতন ফুটছে । একটা কিছু রক্তারক্তি না করলে এই লাভা ঠান্ডা হবেনা । ভেসপাটা কাছাকাছি আসতেই হেডলাইট অন করে বাশার । তীব্র আলোয় ভেসপার তিন আরোহীর শেষের জনকে দেখে দাঁত বের করে কোমরে হাত রাখে বাশার ।

৩/
প্রায়ান্ধকারে সরাসরি অতো বড় আলোটা চোখে পড়তেই চোখ ধাঁধিয়ে যায় জুবায়েরের প্রথম চোটে । টাল সামলাতে না পেরে স্পিড কমিয়ে পা নামিয়ে ফেলে জুবায়ের। পা নামিয়েই ভুলটা বুঝতে পারে । স্পিড বাড়ানোর পরিবর্তে জুবায়ের স্পিড কমিয়ে দিয়েছে দেখে শাম্মি আর্তচিৎকার করে ওঠে পেছন থেকে । কিন্তু লাভ নেই । দুই জন ষন্ডা এক লাফে জুবায়েরের ভেসপার হ্যান্ডেল ধরে কাত করে ফেলেছে। আর হ্যান্ডেল ধরেই একজন কষে চড় বসিয়ে দিয়েছে জুবায়েরকে। পেট ভরা মদের প্রকোপে এম্নিতেই দূর্বল তার উপরে অমন একটা রাম চড় খেয়ে ছিটকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জুবায়ের। জিয়াদ কিছু বোঝার আগেই একজনের থাবায় মাটি থেকে দশ হাত উপরে উঠে সপাটে আছড়ে পড়েছে ফের মাটিতে । জিয়াদকে মাটিতে পড়তে দেখেই মাথা ঘুরে পড়ে গেছে শাম্মি ।

জিয়াদকে ছেড়ে দিয়েই ড্যাগারটা উঁচিয়ে জুবায়েরের দিকে ছুটে গেছে বাশার । সপ সপ করে গুনে গুনে চৌদ্দটা কোপ মারে বাশার জুবায়েরের দেহ জুড়ে। তার চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধারের পরতিশোধে চৌদ্দটা কোপ । হাতের উল্টো পিঠে মুখের রক্ত মুছে চোখের কোনা দিয়ে রক্তাক্ত জিয়াদকে দেখে নিয়ে শাম্মির দিকে এগোয় । জ্ঞান হারা শাম্মির লুটিয়ে পড়া জর্জেট শাড়ির আঁচলটা নাকের কাছে এনে একটু শুকে নিয়ে মুখ বিকৃত করে হাসে বাশার। একরামুল আর শাফায়াত দাঁত বের করে একটা নোংরা হাসি দিয়ে উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ায় । এক টানে শাম্মির ব্লাউজ ছিড়ে বুক খাঁমচে ধরতেই শাম্মির জ্ঞান ফেরে। মুখ তুলে চিৎকার দেওয়ার আগেই বাশার তার মুখে ছেড়া ব্লাউজটা গুঁজে দেয় ।

পাশে পড়ে থাকা জিয়াদের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শাম্মি পাশবিকতা সহ্য করে । পর পর তিনবার ।

 

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ