শাহবাগ- ঐতিহাসিক গর্ভপাত হলেও, আপামর বাঙালীর বিভ্রান্ত প্রজন্মটিকে মাতৃগর্ভ ঠিক চিনিয়ে গিয়েছে।
শুরুটা সীমাহীন স্বপ্ন জাগিয়েছিলো ঘুমন্ত বাঙালী চেতনায়। কাদের মোল্লার 'বিজয়' চিহ্ন দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো বাঙালীর মননে।
মনে আছে, কাদের মোল্লার রায় শুনে অফিসেই বসেই কেঁদে চোখ লাল করেছিলাম। হতাশার সীমাহীন যন্ত্রণা বুকে জন্ম দিয়েছিলো তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা।
মাত্র একটা আহ্বান 'চলো যাই শাহবাগ'। আমিও সেদিন আমার ফেসবুক ওয়াল থেকে এ আহবানটি শেয়ার দেই। মাত্র একটা আহ্বানেই স্রোতের মতো লোকজন জমায়েত হতে শুরু করে।
মনে পড়ে, ৮ ফেব্রুয়ারির সেই মহাসমাবেশে অজানা টানে সেদিন ছুটে গিয়েছিলাম। হায়! বর্ষায় বাঁধ ভাঙলে বানের পানি যেভাবে ধেয়ে আসে সেদিন ঠিক তেমনি মানুষের স্রোতকেও ধেয়ে আসতে দেখেছি। সেদিন অনুভব করেছিলাম বাঙালী যুদ্ধকালীন সময়ে কেমন ভাইভাই হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাঠে নেমেছিলো। কেউ কাউকে চিনে না কিন্তু সবার দাবী এক, লক্ষ্য এক। আর এখানেই সকলের মিলিত স্রোত এক কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়ায়।
পরদিন ভোর ছ'টায় দু'জনে মিলে রওয়ানা দেই। পৌঁছে দেখি তখনো ৭টাও বাজেনি, কিন্তু মানুষ অনেক। বেলা বাড়ার সাথেসাথে মানূষের ঢল! মনে আছে, দু'জনকে প্রশ্ন রেখেছিলাম। বুকের ভেতর লালন করা ঘৃণা আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সকলের মাঝে খুঁজে পেয়ে অজান্তেই যেনো নিজেও সাংবাদিকদের মতো পাবলিক সেন্টিমেন্ট জানতে কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। এক ৭০/৭২ বয়সী ভদ্রমহিলা, তিনি কাদের মোল্লার 'ভি' চিহ্নকে সহ্য করতে না পেরে নীলফামারী থেকে প্রতিবাদে শরীক হতে চলে এসেছেন। আর দেড়মাসের শিশু কোলে নিয়ে আসা মা'কে প্রশ্ন রেখেছিলাম, এতো ছোট্টবাচ্চাকে নিয়ে আসতে সাহস করলেন কিভাবে? তাঁর উত্তর, নিজ সন্তানকে এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী রাখতে তাঁদের ছুটে আসা। ভোরে চলে এসেছেন, যাতে ভীড় বাড়ার আগেই চলে যেতে পারেন, কিন্তু তাঁকে অবাক করে দিয়ে সাত সকালেই লোকে লোকারণ্য!!
সেদিনের শাহবাগ বাঙালীকে আবারও তার শেকড় দেখিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন থেকে শেকড় চিনতে শুরু করেছে বিভ্রান্তির বেড়াজালে আটকে থাকা নতুন প্রজন্ম।
বছরের পর বছর নানা ফন্দিফিকির করে গড়ে তোলা প্রজন্মকে নিয়ে সাজানো সেই বাগানে সত্যের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটেছিলো সে সময়টাতে। তাইতো নিজেদের কঠিন সময়কে মোকাবেলা করতে মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছিলো নষ্টচক্র।
ভয় পেয়ে গিয়েছিলো! হ্যাঁ, ভয় পেয়ে গিয়েছিলো! তাইতো ঐতিহাসিক সেই জনসমাগমকে দুর্বল করে দিতে কলুষিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। নাম দিয়েছিলো, 'শাহবাগী' 'নষ্ট ছেলেপেলে' ট্যাগায়িত করেছিলো 'নাস্তিক' হিসাবে। তার সাথে যোগ হয় আরো একটি ভয়! যোগ-বিয়োগের হিসাব! সেই হিসাবের টানাপোড়ন আর পারষ্পারিক অবিশ্বাস নষ্ট করে দেয় বাঙালীর এই গরজে উঠা দ্রোহকে।
তবুও আমি আশাহত হই না। ২০১৩ সালে যেই দাগ বাঙালীর বুকে আঁচড় কেটেছিলো, এর সুফল আসবেই। ইতিহাসের সুফল অল্পদিনে আসে না। সেদিনের গণ বিস্ফোরণের তাজা সুফল ছিলো 'জয় বাংলা' স্লোগানকে ফিরিয়ে আনা। এক সময় এই 'জয় বাংলা' উচ্চারণ করতেই মানুষ ভয় পেতো।
৭৫-৯০, বাঙালীকে যে উল্টো রাস্তা দেখানো হয়েছিলো, সময়ের ঘেরাটোপে বিভ্রান্ত বাঙালী সে পথেই হাঁটতে বাধ্য হয়েছিলো। ওই সময়টাতে বেড়ে উঠা বিভ্রান্ত প্রজন্ম ২০১৩ তে তার সঠিক পথটি খুঁজে পেয়েছে, এবার হাঁটতে হাঁটতে আলোকিত অবস্থায় ফিরে আসবেই।
ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। কাজেই আমাদের দায় বেশি। নষ্টচক্র কিন্তু বসে নেই! নতুন করে বিভ্রান্তির ফাঁদ পাতার জন্য তৎপর। তাদের এই অপতৎপরতাকে রুখে দেয়ার দায় কিন্তু আমাদেরই।
বিঃদ্রঃ অনিবার্য কারণবশতঃ আজকের পোস্টটি দেরী করে দেয়ায় আগামীকালের নির্ধারিত পোস্টটি রাত ১১:৪০ এর পরে প্রকাশ করা হবে, ব্লগের ২৪ ঘন্টার নিয়ম মেনে।
Thumbnails managed by ThumbPress
১২টি মন্তব্য
পারভীন সুলতানা
আমার একটা ছোট্ট লেখা আছে , যা আপনার লেখার সমার্থক । ভাল লাগতে পারে……………।।
শাহবাগের ফাঁসি
গতকাল ছিল কৃষ্ণপক্ষ, নিকষ কালো রাত
সাধু বেশি তস্কর চুরি করে নিল ইতিহাস ।
ঘুম ভেঙ্গেই দেখি ধুয়াটে সকাল, ভীষণ মুখভার তার,
বুকের মধ্যে বোবা যন্ত্রণার হাহাকার, নিষ্ফল তোলপাড়
ক্ষনে অক্ষনে গুমোট কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে আকাশ,
পতাকায় শকুনির আচড়, শয়তানের অট্টহাসি আর উল্লাস
উড়ে আসে মেঘের আড়ালে , বেড়েছে অনেক বেশি সাহস ।
কৃষ্ণচূড়ার আগুন লাল যার হৃদয়ে জ্বেলেছিল বনহিশিখা
সে শিখার আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছিল একুশের পতাকা,
চেতনায় ফাগুন, দিল ডাক, ছুটে আয় আরেক বার ।
রমনার দুধারে তখন রাশি রাশি কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধ্যত গ্রীবা
লাল রঙ তখন কবিতা মেধাবী ছাত্রের ।
ছুটে এল ওরা, হাতে তিনটি ব্যানার ,ঝড়ের অশনি সংকেত,
ভিন্ন ভিন্ন নামে,বৈরী ভাই একে অন্যের।
বিভাজন আর বিদ্বেষ, একের আঘাতে অন্যে লাশ ।
শকুনির অট্টহাসি আজ মহা উৎসব আর উল্লাশ
আজ ফাসিতে ঝোলে, মায়ের কোল জনতার শাহবাগ
আজ ফাসি হল বিবেক জনতার, শাহবাগের
আকাশের বুকে রক্তাক্ত যন্ত্রনা, গুমোট আধার ।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপু, আস্তো একখান কবিতে দিয়ে দিলেন! সমার্থক তো বটেই। আমরা যারা একই পথের মানুষ, কেন্দ্রবিন্দু তো একটাই হবে।
অনেক শুভ কামনা -{@
শুন্য শুন্যালয়
এই শাহবাগ কে ঘিরেই দেখেছিলাম, পলিটিকেল ভেদাভেদ ঘুচে গিয়ে সবাই রাজাকারের বিচারের অন্যায় ফলাফলে রুখে গিয়েছিল। সে কি অদ্ভূত এক উন্মাদনার নাম। শাহবাগের সে ভীড় টেলিভিশনে বসে বসে দেখেছিলাম, আর আক্ষেপে দেশের জন্য প্রান মুচড়েছে।
মিরজাফর, ঘষেটি বেগম ছিল, আছে থাকবেই। আজ হোক কাল হোক, সূর্য্য একদিন উঠবেই। ৭১ এ পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবেনা।
চমৎকার এক পোস্টে শাহবাগের সে উত্তেজনা আবারও টের পেলাম আপু। ফেসবুকে ঢুকলে সবার একটাই কথা ছিল, চল শাহবাগে যাই। সকল বিভ্রান্তি সরিয়ে নতুন প্রজন্মের জন্য শাহবাগ এক আলোর মশাল হয়ে থাকুক। অনেক ধন্যবাদ অসাধারন পোস্টটির জন্য।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, অদ্ভুত উম্মাদনার নাম ছিলো শাহবাগ! স্লোগানগুলো শুনলে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যেতো! অহংকারে বুক স্ফীত হতো, সারা বাংলার বুকে দেশপ্রেমের জলন্ত শিখা দেখে।
আহ! কি সেই উম্মাদনা। আমার আরো কিছু অবজারভেশন আছে এই জনস্রোতকে দেখে। আস্তে আস্তে সবই লিখবো।
আর হ্যাঁ, কালেকালে ঘষেটি বেগম, মীরজাফররা ছিলো, আছে, থাকবে। ইতিহাসে এরা কালো স্থানেই জায়গা করে নিয়েছে, নেবে।
অনেক ধন্যবাদ -{@
ব্লগার সজীব
শাহাবাগ একটি স্ফুলিঙ্গর মত জ্বলে উঠেছিল বাঙ্গালিদের হৃদয়ে। স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
কেবল মাত্র নেতৃত্বের ভুলে এত বড় একটি আন্দোলন মুখ থুবড়ে পরে গেলো। এমন পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শাহবাগ জেগেছিলো বলেই লক্ষ বাঙালী তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়ে দিয়েছিলো, ” যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি চাই, রাজাকারের ঠাই নাই।”
মুখ থুবড়ে পরলেও এর স্পিরিট পিছিয়ে পড়া বাঙালীকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাঙালীর আগামীর শক্তি এই শাহবাগ!
ধন্যবাদ ভাইয়া -{@
রিমি রুম্মান
শাহবাগ নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু এটা তো মানতেই হবে যে, ঘুমন্ত আমাদের জাগিয়ে তুলেছিল শাহবাগ।
লেখা ভাল লেগেছে, আপু।
শুভেচ্ছা। -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শুভেচ্ছা আপনাকেও। আগামী শনিবার ১লা বসন্ত, তাই বাসন্তী শুভেচ্ছা।
হ্যাঁ, শাহবাগ ঘুমন্ত বাঙালীকে জাগিয়ে দিয়েছিলো। ইউটার্ন নিয়ে বাঙালী আবার সঠিক জায়গায় ফিরে আসতে শুরু করেছে।
জিসান শা ইকরাম
রাজাকারদের যে বাঙ্গালী মনে প্রাণে ঘৃণা করে, এর প্রমাণ শাহাবাগ এর জনজাগরণ।
বুকের মাঝে দাউ দাউ করে জ্বলে রাজাকারদের প্রতি ঘৃণার আগুন।
সঠিক দিনে সঠিক পোষ্ট দেয়ার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
শাহবাগ জেগেছিলো বলেই আজ এক এক করে রাজাকারদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে আর আমরাও কিছুটা হলেও ইতিহাসের দায় থেকে মুক্তি পাচ্ছি।
অপার্থিব
শাহবাগ আন্দোলনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে কিন্তু শাহ বাগের সেই আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ঠিকই থেকে যাবে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অবশ্যই। যে যেভাবেই কালিমা ছড়াক না কেনো স্বাধীন বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে শাহবাগ যে ভুমিকা রেখেছে, ইতিহাসে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।