শরতের কথকতা 

মাহবুবুল আলম ১৮ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার, ১২:০৭:৪৪অপরাহ্ন সাহিত্য ১২ মন্তব্য

মাহবুবুল অলম //

ষড়ঋতুর আমাদের এই বাংলাদেশ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এই ছয়টি ঋতু নিয়ে আমাদের ঋতুচক্র; দুই মাস পর পর যার পালাবদল ঘটে। আকাশে রৌদ্র-মেঘের লুকোচুরি খেলা জানান দেয় তার আগমনী বার্তা। প্রকৃতির মালিন্য মুছে দিতে মেঘের ভেলায় চড়ে প্রকৃতিতে হাজির হয় আমাদের চিরচেনা শরৎকাল। বর্ষার বৈরিতা শেষে প্রকৃতি যেন সাজে  নতুন সাজে। পথে-প্রান্তরে কাশফুলের শুভ্রতায় ছুঁয়ে যায় মানুষের সৌন্দর্যপিপাসুদের হৃদয়গহন। শরতের সকালে বয়ে চলে ঝিরিঝিরি হাওয়া। ছোট ছোট পাখিদের কিচিরমিচির, ফুটন্ত শিউলির প্রাণ জুড়ানো ঘ্রাণ। শিউলি তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দূবার্ঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকে রাশি রাশি শিউলিফুল। আমনের মাঠে মাঠে শিশিরসিক্ত সবুজের স্বচ্ছ শামিয়ানা! বাতাসের দাপটে নদী ও জলাশয়ে অবিরাম ঢেউ তুলে যায় বিক্ষিপ্ত বাতাস। নদীর তীরে শুভ্র সাদা কাশফুলের অপূর্ব শুভ্রতায় নে সবটুকু সৌন্দর্য ঢেলে দেয় প্রকৃতিতে। শরতের আকাশের মতো স্বচ্ছ আকাশ আর কোনো ঋতুতে চোখে পড়ে না।

ঋতুচক্রের পথপরিক্রমায় শরতের আগমন ঘটে বর্ষার পর। প্রতিটি ঋতুই এদেশের প্রকৃতিকে আপন সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে তুলে। তবে শরৎ ও বসন্ত যেন সৌন্দর্যের ঢালি নিয়ে হাজির হয় বাংলাদেশের প্রকৃতিতে। এ দুই ঋতুতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য়ের দিক দিয়ে আলাদা করে অনুভব করা যায়। তাই বসন্তকে যদি আমরা ঋতুর রাজা বলি, তাহলে শরতকে নির্দ্বিধায় ঋতু রাণী হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে। তবে অন্যান্য ঋতুর সৌন্দর্যও কম নয়। বাংলাদেশে ষড়ঋতুর পরিক্রমায় প্রকৃতি কখনো হয় প্রাণোচ্ছ্বলা চঞ্চলা তরুণী, চক্ষুশীর্ণ সন্নাসিনী, আবার কখনো বা স্নেহময়ী মায়ের মতো। প্রকৃতি এই সময়ে ভেজা রূপ বিষণœতা পরিহার করে আসে শান্ত-সিগ্ধ কোমল রূপ নিয়ে, যেখানে থাকে না কোনো মলিনতা, আছে কেবল নির্মল আনন্দ আর অনাবিল উচ্ছ্বাস। এই ঋতুতেই যেন রূপসী বাংলা তার যৌবন বিকশিত করে মেলে ধরে আকাশের কোণায় কোণায়, বাতাসের পাখায় পাখায়। ঋতুবৈচিত্র্যের এ বাংলাদেশের শরৎ এসে যেনা প্রকৃতিতে কাঁপন তুলে। এক আশ্চর্য রূপমাধুরী নিয়ে ফেরে সে দ্বারে দ্বারে। শরতের ছোঁয়ায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে আরো অপরূপ ও লাবণ্যময়। শরতকালে বাংলার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে নবীন ধানের সঙ্গে কাশফুলের দোলা আর নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। এসময়ে শরৎ যেন প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে সৃষ্টি  করে মোহনীয় এক পরিবেশ। শরতের আগমনে ঝিমানো প্রকৃতি হঠাৎই প্রাণ পেয়ে ফুরফুরে হয়ে ওঠে। সকাল, দুপুর, বিকেল, রাতে আসে শরতের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সবুজ-শ্যামল আর পাখির গুঞ্জনে মুখরিত আমাদের প্রিয় স্বদেশ। অপূর্ব রূপ এবং বর্ষার বিদায়ক্ষণে শরতের আগমনে প্রকৃতি রঙ ছড়ায়। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এমনই সাজে সাজে প্রকৃতি, তাতে মন উড়ে যায় শুভ্র মেঘের নীল আকাশে। বিকেলের রোদের ঝলমলে হাসি আর সন্ধ্যার শান্ত আবছা শিশিরে মন উড়ে যায় অজানায়। নদীর ধারে মৃদুমন্দ বাতাস আর চাঁদনী রাত শরতের আবেদনকে আরো বাড়িয়ে তোলে। শরতে মানুষ ভুলে যায় ক্লান্তি ও যাপিত জীবনের নানান অসঙ্গতি। ঘাতপ্রতিঘাত ভুলে জীবন নদীতে সুখের নৌকা ভাসায় আপামর মানুষ। শরৎ তারুণ্যের হৃদয়কে নবযৌবন রাগে রাঙিয়ে দেয়।

অপরূপ সৌন্দর্যম-িত শরৎ ঋতু শারদ লক্ষ্মী নামেও পরিচিত। শরৎকালের মধ্যেই যেন বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পর্শ মেলে। তাই শরতের প্রকৃতি দর্শনে অনেক সময় অন্তরে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য লাভের বাসনা জেগে ওঠতে পারে। এ সময়ে যেন প্রকৃতি ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে-শেফালি, মালতি, কামিনী, জুঁই, টগর আর সাদা কাশফুল মাথা উঁচিয়ে শরৎ জানান দেয় রূপসী বাংলার অবারিত সৌন্দর্যের কথা। শিউলির মিষ্টি সুবাস ছড়িয়ে যায় নতুন বিভায় সবুজ-শ্যামল রূপসী বাংলায় শরৎ তার রূপের সুষমা নিয়েই ধরা দেয় মানুষের মনে। শরৎকালে প্রকৃতি সেজে ওঠে অন্যরূপে  সেই সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে। এর স্নিগ্ধতা উচ্ছ্বসিত আনন্দে ভাসায় সবার মন। প্রকৃতি  ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নিতে চায় সবাইকে শরৎ সেই ভালোবাসার মনে দোলা দিয়ে যায় অন্য এক আবেশে। শরৎকালের মধ্যেই যেন বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায়। নদীর তীরে তীরে কাশফুলের শুভ্রতার প্লাবন, মাঠে মাঠে সবুজের মেলা; এত নীল আর এত সাদার মিলিত সমাবেশ কেবল শরতেই দেখা মেলে এই রূপসী বাংলায়। এই সময় খাল-বিল-পুকুর ডোবায় ফোটে অসংখ্য জলজ ফুল। শেষ রাতের মৃদু কুয়াশায় ঢেকে থাকা মায়াবী শাপলা ফুলেরা রূপ বিলায় গ্রামের হাওর-বাওর, খাল-বিল জুড়ে । প্রকৃতির বুকে এক অনাবিল আনন্দের ঝর্ণাধারা ছড়িয়ে দেয় এই ঋতু। এ সময় গাছে গাছে ফুটতে শুরু করে ছাতিম, বরই, দোলনচাঁপা, বেলি, শাপলা, জারুল, রঙ্গন, টগর, রাধাচূড়া, মধুমঞ্জুরি, শ্বেতকাঞ্চন, মল্লিকা, মাধবী, কামিনী, নয়নতারা, ধুতরা, কল্কে, স্থল পদ্ম, সন্ধ্যামণি, জিঙে, জয়ন্তীসহ নাম না জানা আরো নানা জাতের ফুল।

দিগন্তের প্রান্ত ছুঁয়ে উড়ে চলে গাঙচিল, বাঁশঝাড় কচুরিপানা থেকে ভেসে আসে ডাহুকের ডাক। বাতাসের সাথে সন্ধি করে কলকল ধ্বনি তোলা নদীতে চলে পাল তোলা নাও। শরতের নিজস্বতা মিশে রয়েছে কাশফুলের সঙ্গে। শরৎ মানে নদীর দুধারে প্রিয়ার গন্ধমাখা বাতাসে দোল খাওয়া সাদা সাদা কাশফুল কিংবা নীল আকাশে শুভ্র বকের সাড়ি। এই সময়ে তাল দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠা, পায়েস? নদী-নালা খাল বিলে ক্রমেই পানি কমতে শুরু করে। সেই সুযোগে গ্রাম বাংলার জনসাধারণেরা মিলেমিশে আনন্দঘন নৌকা ভ্রমণের আয়োজন করে। এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদীর বুকে মাঝিরা ডিঙি নাও বইতে বইতে গেয়ে ওঠে ভাটিয়ালি গান। যদিও কালের বিবর্তনে তা তেমন চোখে পড়ে না তবু শরতকালের সৌন্দর্য সম্ভাওে এর অবদান কম নয়। পুকুরপাড়ে গাছের ডালে মাছরাঙা ধ্যান করে বসে থাকে কখন যে শিকারের ওপর দেবে ঝাপ। এ সময় আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া, পেঁজা তুলার মতো শাদা মেঘ ভেসে বেড়ায় যখন-তখন। এ দৃশ্য ভাবুক মনকে বিবাগী করে তোলে।

শরৎ যেমন বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে তেমনি সাহিত্যকর্মেও শরতের উজ্জ্বল উপস্থিতি করা যায়। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকরা শরতকে নানাভাবে বর্ণনা করেছেন। শরৎ-সন্ধ্যায় গ্রামের মেঠো পথে যেতে যেতে পথিকের মনে নতুন ভাবনার উদ্রেক হয়। শরৎ যেন প্রতিটি সাধারণ মানুষের মধ্যে কবি-ভাবকে জাগ্রত করে দেয়। শরৎ নিয়ে মানুষের এমন মুগ্ধতা কয়েকশ' বছরের নয়, এ মুগ্ধতা হাজার-হাজার বছরের। শরতের স্নিগ্ধতা চোখে জড়িয়ে তাই মহাকবি কালিদাস বলে ওঠেন : 'প্রিয়তম আমার ঐ চেয়ে দেখ

নব বধুর ন্যায় সুসজ্জিত শরৎকাল সমাগত।'

কালিদাসের দৃষ্টিতে শরৎকাল নববধূর মতো, এ যেন কবির আরেক প্রিয়া। অন্যদিকে মধ্যযুগের কবি আলাওল শরৎকালে দেখেছেন দম্পতিদের সুখের প্লাবন। 'পদ্মাবতী' কাব্যে তিনি লিখেছেন :

আইল শরৎ ঋতু নির্মল আকাশ

দোলায় চামর কাশকুসুম বিকাশ।

নবীন খঞ্জন দেখি বড়ই কৌতুক

উপজিত থামিনী দম্পতি মনে সুখ

ডপ্রয়া কাছে থাকলে শরৎকাল হয়ে ওঠে আরো মাধুর্যময়। প্রিয়াবিহীন শরৎকাল ভীষণ বেদনার। কবি চন্ডিদাসের ভাষায় :

'ভাদর মার্সে আহোনিশি অন্ধকারে

শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহলে

তাওনা দেখিবো যঁবে কাহ্নাঞ্চির মুখ

চিন্তিতে চিন্তিতে মোর ফুটি ফুটি জায়ির বুক

আসিন মাসের শেষে নিবিড়ে বাবিধী

মেঘ বাহিআঁ শেলেঁ ফুটেবেক কাশী।'

মধ্য যুগের কবিরা তো বটেই, আধুনিক যুগে এসেও শরৎ নিয়ে কবিতা চর্চা শেষ হয়নি বরং আরো যেনভাবে উদ্ভাসিত। বাংলাসাহিত্যের অধিকাংশ কবিই শরৎ নিয়ে কবিতা লিখেছেন। রবী›ত্রনাথ ঠাকুর শরতের বন্দনা করছেন এভাবে :

'আজি কী তোমার মধুর মুরতি

হেরিনু শারত প্রভাতে

হে মাতা বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ

ঝলিছে অমল শোড়াতে।'

বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎ নিয়ে রচনা করেছেন এমন প্রচুর কবিতা ও গান এর মধ্যে এটির কথাও উল্লেখ করা যায়-

শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি

ছড়িয়ে গেল ছাপিয়েমোহন অঙ্গুলি।

শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে,

বনের-পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলি

আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।

 

কবি জসীমউদ্দীন শরতকে দেখেছেন ‘বিরহী নারী’ মননে।

কবি ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ কাব্যগ্রন্থে রূপাই আর সাজুর বিচ্ছেদ বেদনা এভাবে অঙ্কন করেছেন-

‘গণিতে গণিতে শ্রাবণ কাটিল, আসিল ভাদ্র মাস,

বিরহী নারীর নয়নের জলে ভিজিল বুকের বাস।

আজকে আসিবে কালকে আসিবে,

হায় নিদারুণ আশা, ভোরের পাখির মতন

শুধুই ভোরে ছেয়ে যায় বাসা।

রূপসী বাংলার কবি জীবনান্দ দাশ ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের ‘এখানে আকাশ নীল’

কবিতায় বলেন-

‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে হিম শাদা রং তার, আশ্বিনের আলোর মতন;

শরৎ বন্দনায় প্রেম ও দ্রোহের কবি নজরুলকেও আলোড়িত করেছিল শরতের প্রকৃতি। বিশেষ করে, শরতের শিউলি তাকে মুগ্ধ করেছিল। ‘এসো শারদ প্রাতের পথিক এসো শিউলি-বিছানো পথে।

এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো অরুণ-কিরণ-রথে...।’

এ ঋতুতে কারো মুখে ফোটে হাসি, আবার শরৎ কারো চোখে নিয়ে আসে বিরহীর অশ্রু। সেজন্য শরৎ কারো কারো কাছে রুক্ষ, কারো কারো কাছে শুভ্রতার। কবি আহসান হাবিবকে বলতে শুনি : 'এবার শরৎ রাত্রি স্বপন নয় এসেছে সঙ্গিন/ লুণ্ঠিত স্বর্গের শীষে সে স্বপন রঙ্গিন/কেঁদে মরে মৃত্তিকায় মিশে যায় ধীরে/এবার শরৎ রাত্রি উদযাপিত হবে আঁখি নীড়ে।'

স্বাধূনতার কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় শরৎ এসেছে জ্যোতি ছড়িয়ে। তাঁর কবিতা : ‘জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে/নিমিষে শরতের শিশির জ্যোতিকণা।’

শরতে প্রিয়ার রূপ-বন্দনায় ব্রতী হয়েছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তাঁর ছান্দিক অনুভব :

‘সবে তো এই বর্ষা গেল/ শরৎ এলো মাত্র/ এরই মধ্যে শুভ্রকাশে/ভরলো তোমার গাত্র।/শেষের আলে মুখ নামিয়ে/পুকুরের এ পাড়টায়/ হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে/বাঁশবনের ঐ ধারটায়।’

একেকজন কবি শরৎকে একেকভাবে বর্ণনা করবেন এটাই স্বাভাবিক। তাই কবি বন্দনায় বাংলার গ্রামীণ প্রকৃতিতে শরতের রূপের খোঁজ মিলে ভিন্ন ভিন্ন উপস্থাপনায়। শরৎ সকালে সবুজ ধানের কচি পাতার ওপর জমানো শিশিরবিন্দু যেন মুক্তোর মতো দ্যুতি ছড়ায়। আমাদের দেশের কৃষক তখন নবান্ন উৎসবের দিনগুনতে থাকে।

বিশ্বসাহিত্যেও শরৎ-বন্দনার অসংখ্য কবিতা পাওয়া যায়। কবি ফ্রানারজ তাঁর ‘মাই ওটাম গার্ল’ কবিতায় লিখেন, 'তোমার শরৎ ঠোঁট/শরৎ চুল/শরৎ চোখ/শরৎ হাসি/শরৎ গ্রীবা /আমি শরতকালে স্রষ্টাকে চুম্বন করি।’ Home' কবিতায় কবি ইৎঁপব ডবরমষ লিখেছেন ÔHome' কবিতায় কবি  Bruce Weigl লিখেছেন ‘I did not know I was grateful for such late autumn bent up corn tields'’.. কানাডার সাহিত্যপ্রেমীরা শরৎকে মনে করেন খানিকটা বিরতির সময়। তার মানে একটু জিরিয়ে সময়। আমেরিকানরা মনে করে শরৎ কিছুটা নরম ও আরামদায়ক সময়। চাইনিজরা শরতের তৃতীয় মাসের শেষ রাতে বৃষ্টির শব্দ শুনে ঘুমাতে পছন্দ করতো। শরতের নিয়ে এমন অনুভব তাদের সাহিত্য চেতনাকে সমৃদ্ধ করে।

শরৎ যেমন প্রকৃতিকে অপরূপ রূপে সাজিয়ে যায় তেমনি সংস্কৃতিতেও ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে মানুষের ক্লান্তি গোছানোর ক্ষেত্র তৈরি করে। শরৎ অবসাদগ্রস্ত মনে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করে। শরতের কাশবন আর জ্যোৎস্নায় প্রিয়জন সান্নিধ্যে হারিয়ে যাওয়ার বাসনা প্রবল হয়, শত কষ্ট গোপন করেও।

শরতের সৌন্দর্য বাংলার প্রকৃতিকে করে রূপময়। গাছপালার পত্রপল্লবে গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার ফিকে হয়ে আসতেই পাখপাখালির দল মহাকলরবে ডানা মেলে উড়ে যায় নীল আকাশে। আকাশের উজ্জ্বল নীলিমার প্রান্ত ছুঁয়ে মালার মত উড়ে যায় পাখির ঝাঁক। হালকা শিশিরে ভেজা দূর্বাঘাসের ওপর চাদরের মত বিছিয়ে থাকে সাদা আর জাফরন রং মেশানো রাশি রাশি শিউলিফুল। শরতের ভোরের এই সুরভিত বাতাস মনে জাগায় আনন্দের বন্যা। শরত সন্ধ্যোয় যেন থেমে যায় চারপাশের কমের্কালাহল। প্রকৃতিতে নেমে আসে এক অন্যরকম আবহ। সূর্য টগবগে লাল রক্তের রূপ ধারণ করে সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে। সূযের্র রক্তিম আলোর ছটায় প্রকৃতি যেন অন্যরকম রঙে নিজেকে সাজায়। পশু-পাখি নীড়ে ফিরতে থাকে। এই সময়ে আকাশ মেঘমুক্ত থাকলেও ঘন নীল মেঘের ভেসে বেড়ানোর ছায়া শুভ্র কাশবনে ছেয়ে গিয়ে গ্রামীণ প্রকৃতিতে শরৎ হয়ে ওঠে এক অনন্য ঋতু। তবে ইট-কাঠের এ যান্ত্রিক নগরীর বাসিন্দারা শারদীয় এ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত। শরৎ উপভোগ করতে হলে, তাকে দেখতে, জানতে ও অনুভব করতে হলে যেতে হবে মাটির কাছাকাছি, নদীর কাছাকাছি। কেননা, সেখানেই যে সৌন্দর্যের  পসরা সাজিয়ে বসে থাকে শরৎ! সময়ের সাথে সাথে ঋতুর পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হয় ঋতুর বৈচিত্র্যেও। শরৎ প্রতিবছর বাঙালির জীবনে আসে নতুন আবেদন ও আবহ নিয়ে। এভাবেই চলে এসেছে হাজার বছর এবং আগামীতেও যে তা চলবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ