
ভেবেছিলাম নতুন করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হবার দিন ফুরিয়ে এসেছে। মারাত্নক প্রাণঘাতী ছোঁয়াচে এই রোগের প্রাদুর্ভাব কমে এসেছে। আমরা আমাদের ভীত-সন্ত্রস্ত সময়টুকু পার হয়ে এসেছি। করোনার সঙ্গনিরোধকাল শেষ হবার পথে। কিংবা সময়ের সাথে সাথে ভাইরাসটি নিজেই হয়তো পরাস্ত হতে চলেছে। কিন্তু আসলেই কী তাই ? এত দীর্ঘ সময় মনের ভেতরে শঙ্কা আর অস্থিরতা নিয়ে অস্বাভাবিক এক জীবন-যাপন আর কতদিন! আর তাই চারপাশের মানুষজনের মাঝে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে একপ্রকার ঢিলেমি চলে এসেছে। বিপন্ন, বিপর্যস্ত সময়কে আমরাও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে নতুন স্বাভাবিক নিয়মে জীবন যাপন করছিলাম। স্কুল খুলে যাচ্ছে, সহসাই দীর্ঘ শীতের প্যাকেটবন্দি জীবন শুরু হতে যাচ্ছে, এবার তো বাচ্চাদের নিয়ে অন্যবারের ন্যায় সমুদ্রে ডুবে ডুবে গোসল হোল না, এমনতর নানাবিধ ভাবনায় পরিকল্পনা করা হোল আটলান্টিক সিটি যাবো। হোটেলে থাকবো। আটলান্টিক বিচে ভেজা যাবে। একটু দূরের ভ্রমণও হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বন্ধুরা সকলে সপরিবারে রওয়ানা দেই। সেখানকার আবহাওয়া অনেকটাই ঠাণ্ডা ছিল। সন্ধ্যায় সাগরতীরের শীতল বাতাসে হাঁটুজলে হেঁটেছি অনেকটা সময়। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছিল বালুচরে। বেশ ভালোলাগা অনুভূতি নিয়ে হোটেলরুমে ফিরে কাপড় পাল্টে আবার বেড়িয়ে পড়ি। রাতভর আলো ঝলমলে কাঠের ডকে হেঁটে বেড়িয়েছি। বাচ্চারা বিভিন্ন রাইডে খেলতে বসে গিয়েছিল। সবমিলে অসাধারণ সুন্দর, আনন্দময় সময় কাটাই। পরদিন সকালের নাস্তা সেরেই ঝকঝকে রোদে সমুদ্রতীরে চলে যাই ভিজবো বলে। শীত অনুভূত হওয়ায় ভিজবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যদিও, কিন্তু সমুদ্রের এতো কাছে এসে ভিজবো না, নিদেনপক্ষে পা ভেজাবো না, তা কী করে হয়! আমরা আবার নেমে গেলাম সবাই হাঁটুজলে। বড় বড় ঢেউ এলো। আমাদের গায়ে সজোরে আছড়ে পড়লো। ঢেউয়ের তীব্রতা আমাদের জলে ফেলে ভিজিয়ে দিল। ঠাণ্ডা আবহাওয়াতেই সমুদ্রজলে ভিজলাম অনেকটা সময়। আমরা ভুলে গেলাম আমাদের শরীরে শীতের কাঁপন লেগেছে। আমরা ভুলে গেলাম অসুস্থ হয়ে পড়ার সবরকম সমূহ সম্ভাবনার কথা।
দুপুরের খানিক পর আমরা যখন খাবারের আয়োজন করছিলাম, তখনই টের পেলাম তীব্র কাঁপুনি দিয়ে শীত লাগছে। রাতে বাড়ি ফিরে সমস্ত শরীরে ব্যথা অনুভব করি। পরদিন দুপুর অব্দি রাজ্যের ক্লান্তিতে পেয়ে বসে। ব্যাস, এ পর্যন্তই। পরবর্তী দুইদিন অন্য কোনো লক্ষণ না থাকলেও ঘ্রাণশক্তি হারালাম। অর্থাৎ খাবারের স্বাদ পাচ্ছিলাম না একেবারেই। বাচ্চারাও উল্লেখযোগ্য কোনো লক্ষণ ছাড়াই সামান্য সর্দিতে ভুগলো একদিন। তারপর সকলেই সুস্থ। আমরা ভেবে নিয়েছিলাম ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় সমুদ্রে লম্ফঝম্ফ করেছি বলে সেই ফল পাচ্ছি। কিন্তু সমস্যা শুরু হোল তখনই, যখন আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের ভ্রমণজনিত কারণে ইমিগ্রেশনে দেবার জন্যে করোনা রিপোর্টের প্রয়োজন পড়লো। একজনের রিপোর্ট পজেটিভ এলো। অমনি হুলুস্থুল পড়ে গেল। আমরা পরিবারের অন্য সকল সদস্য দলবেঁধে হাসপাতালে ছুটলাম করোনা পরীক্ষা করাতে। নমুনা দিয়ে এলাম। দুইদিন বাদে সবার রিপোর্ট এলো। আমরা সকলেই ‘ কোভিড-১৯ পজেটিভ’। শুরু হোল নতুন যন্ত্রণা। রোজ সকালে সিটি থেকে ফোন আসতে লাগলো। একবার নয়, দুইবার নয়, গুণে গুণে ছয়বার। পরিবারের ছয় সদস্যের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন ফোন আসতে লাগলো। কী হয়েছিল, কোথায় গিয়েছিলাম, কোথা থেকে আক্রান্ত হয়েছি বলে মনে হচ্ছে, এমনতর নানাবিধ সম্ভাবনার ডাল-পালা ছড়াতে ব্যস্ত ফোনের অন্যপ্রান্তের নারী কণ্ঠস্বর। এছাড়া নানান উপদেশ তো আছেই। কীভাবে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে, থালা-প্লেট, কাপ-চামচ আলাদা হতে হবে, গরম পানিতে জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে, শ্বাসকষ্ট শুরু হলেই যেন ৯১১ নাম্বারে কল করে হাসপাতালে চলে যাই, এমন হাজারো উপদেশ। বাইরে একেবারেই যাওয়া যাবে না। প্রয়োজনে তোমাদের খাবার পাঠানো হবে, মাস্ক পাঠানো হবে, ইত্যাদি। প্রতিদিন ছয়বার ফোনের জবাব দেয়া অর্থাৎ প্রতিবার অন্ততপক্ষে তিরিশ মিনিট করে ছয়বার কথা বলা রীতিমত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলার মতোই মনে হচ্ছিল। তাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে যেহেতু আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য, বিধায় এতবার ফোন করে অতিষ্ঠ করে তুলো না। একবার ফোন দিয়ে যা খবর নেয়ার নিয়ে নিবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! এটাই যে ওদের চাকুরি।
এদিকে সন্তানদের অনলাইন স্কুল শুরু হয়ে গিয়েছে। চলছে নিয়মিত। আমরা ঘরে আবদ্ধ সময় পার করছি। একের সাথে অন্যের দূরত্ব বজায় রাখছি। বদলে নিয়েছি জীবনযাপন প্রণালী। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, সচেতনতা বেড়েছে। যখন তখন ছোটোখাটো অসুখ বিসুখে ডাক্তারের শরণাপন্ন না হয়ে বাড়িতেই নিরাময়ের উপায় বের করছি। প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র সবসময় প্রস্তুত থাকছে বাড়িতেই। ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক সময় মানুষের জীবনেরই অংশ। জীবনে অনিশ্চয়তা যেমন আছে, তেমনি এটাও তো সত্য, যে কোনো অনিশ্চয়তাই খুব বেশিদিন স্থায়ী হয় না। শত বছরে একবার মহামারির প্রাদুর্ভাব হয় শুনেছি। আর আমরা সেই শতবর্ষের অভিজ্ঞতার অংশ হয়ে রইলাম।
১৮টি মন্তব্য
রেজওয়ানা কবির
করোনা মানুষের জীবন থেকে সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে,।সচেতন আরও বেশী আমাদের হতে হবে। টেনশন করিয়েন না, সুস্থ থাকুন, আল্লাহ ভরসা।
জিসান শা ইকরাম
করোনা নিয়ে আমাদের শতর্কতা অনেক কমে গিয়েছে। একটা ঢিলেমি ভাব এসে গিয়েছে বাংলাদেশের সবার মধ্যে। যেন করোনা চলে গিয়েছে অথবা আমাকে মনে হয় করোনা ধরবে না এমন একটা মনোভাব।
আসলে অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি আমরা। মেনে নেয়াও বলা যায় একে।
সবাই করোনা টেস্ট পজেটিভ জেনে দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব। এই অসুস্থতা নিয়েও ব্লগে পোষ্ট দিলে দিদি ভাই!
দোয়া করি, যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারো দ্রুতই।
শুভ কামনা দিদি ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
আল্লাহ যেন এই সমূহ বিপদ থেকে সহসাই আপনাদের মুক্ত করে
এই প্রার্থনা ই করি। আমিন।
ফয়জুল মহী
আপনার আশু আরোগ্য কামনা করি। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন সবার মাঝে।
কামাল উদ্দিন
মনে সাহস রাখেন আপু, আমি এবং আমার স্ত্রী ও করোনা আক্রান্ত হয়েছিলাম। এবং এক সময় সেরেও উঠেছি। তবে ফ্যামেলীর দুর্বল লোকদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছি।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সবখানেই ঢিলেমি চলে এসেছে । কোন শংঙ্কা, সাবধানতা নেই কারো মাঝে। সাবধানে থাকুন । ঈশ্বর সহায় হোন আপনাদের সবার
আলমগীর সরকার লিটন
খুব সুন্দর লেখেছেন এখন কার বাস্তব্তার সাথে মিল আছে—————
রেজওয়ানা কবির
লিটন ভাই আপনার মন্তব্য আমার কাছে বোধগম্য হলো না,আপু লিখেছেন সে সহ তার পরিবারের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা, সেখানে আপনি লিখেছেন খুব সুন্দর হয়েছে।আমার মনে হয়, আপনি লেখাটি ভালো করে পড়েন নি। আমার মনে হয় লেখা ভালো করে পড়ে মন্তব্য করতে হয়।ভুল বললে সরি।ভালো থাকবেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
@ রেজওয়ানা, আপনার এই কমেন্ট মনে হয় না লিটন ভাই এখানে পড়বেন। যে একটা আস্ত পোস্ট না পড়েই কমেন্ট দিয়ে যায়, তিনি কি আর…. ?
আমার কাছে ভালো লাগলো আপনার এমন উক্তি। সরি বলার কিছু নেই। ভুল ধরিয়ে দিলে সেটা অন্যের উপকারেই আসে।
আলমগীর সরকার লিটন
আপনারা দুজনে এই ভাবে মন্তব্যের উত্তর দিবেন আসলেই দুঃখজনক, অবশ্যই পড়েছি আপনাদের সাথে তর্ক্তে যাব না আমাদের বোধগম্য যা হয়েছে আপনারা তাই করেছেন————————–
মোঃ মজিবর রহমান
আল্লাহ সবাইকে সব বিপদ থেকে দূরে রাখুক কামনা করি। আমরা করোনাকে এখন বলতে গেলে ডরাই না।
ইঞ্জা
সত্যি আমাদের সতর্কতায় যথেষ্ট ঢিলেমি চলে এসেছে, তার উপর সবাই অহরহ বেরুচ্ছে বিভিন্ন উছিলায়, একি কথা আমাদের দেশেও, মানুষ বেড়াচ্ছে, ঘুরছে, সাধারণ যাপিত জীবন যেমন চলে তেমনই জীবনে সবাই ফিরে গেছে।
একি ভাবে আপনারা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন শুনে সত্যি উদ্বীগ্ন হলাম আপু, দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন এই দোয়া করছি মহান আল্লাহর দরবারে।
তৌহিদ
আপনার এবং পরিবারের সকলের সুস্থতা কামনা করছি আপু। আমাদের এখানেও সকলের সতর্কতা কমে গিয়েছে। আল্লাহ সহায়।
শুভকামনা সবসময়।
আরজু মুক্তা
আল্লাহ ভরসা।
দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।
রেহানা বীথি
আপনিসহ পরিবারের সবার আরোগ্য কামনা করছি। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন।
সাবিনা ইয়াসমিন
আল্লাহ তায়ালার কাছে আপনাদের জন্য প্রার্থনা করি। তিনিই সুস্থ করার মালিক। সাবধানে থাকবেন রিমি আপু। দোয়া ও শুভ কামনা 🌹🌹
পপি তালুকদার
আসলে এই অজানা, অদেখা ভয় আমাদের সকলকে গ্রাস করে ফেলেছে! প্রতিদিন যেন গুনে গুনে পার করছি। কবে এই অস্বাভাবিক অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাবো একমাত্র মহান আল্লাহ পাক জানেন!আপনার পরিবারের সকলের দ্রুত সুস্থতা কামনা করছি।
রোকসানা খন্দকার রুকু
আমরা আসলেই কিছুই নেই এমন ভাব নিয়েই চলছি। এখন থেকে সাবধানে চলুন। ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।