লোভ (তৃতীয় পর্ব)

দিপালী ২৫ নভেম্বর ২০২০, বুধবার, ০২:২০:০৩অপরাহ্ন গল্প ৮ মন্তব্য

এরই মধ্যে একি গ্রামের কুয়েত ফেরত বেলাল হাসেমের সাথে রোদেলার বিয়ের কথা অনেক দূর এগিয়েছে।

বেলাল ক্লাস এইট পর্যন্ত লেখাপড়া করে কুয়েতে চাকুরী করতে যায়। প্রায় পাঁচ বছর কুয়েতে প্রবাস জীবন যাপন করে বিয়ে করার জন্য দেশে এসেছে। বিয়ের পর বউ নিয়ে আবার কুয়েত ফিরে যাবে। বেলাল দেখতে ভাল। বেলালের বংশও ভাল।

বিয়ের পর স্বামীর সাথে কুয়েত যেতে পারবে জেনেই বিয়েতে রাজি হয়ে যায় রোদেলা।

রোদেলার মা দীর্ঘদিনের শ্বাস কষ্টের রোগী সাথে প্রচন্ড বাতের ব্যথা। বাতের ব্যথায় উনি চলাফেরায় করতে পারেন না। শরীরের নীচের অংশ অনেকটা অবশের মতন। রোদেলার মায়ের যে হেকিম চিকিৎসা করেন তিনি আবার খুব নাম করা। দশ মুল্লুকের লোক তাকে এক নামে নাজের হেকিম নামে চেনেন।

রোদেলাদের বাড়ির পিছনে বিশাল এক পুকুর আছে। পুকুরের পাশ ঘেসে এক চিলতে জমি। বাড়িতে চাপ কল আছে আবার নতুন বিল্ডিং এ পাকা বাথরুমও আছে কিন্তু রোদেলা সব সময় এই পুকুরেই গোসল করে। সাঁতার কাটাতে খুব ভালবাসে রোদেলা। পুকুরের এ পার থেকে ঐ পাড়ে যেতে মাত্র বিশ মিনিট সময় লাগে রোদেলার। রোদেলার সাথে পুকুরে নেমে গোসল করতে সাহস পায় না চন্দন। রোদেলা দুইদিন জোর করে টেনে পুকুরে নামালে কেঁদে ফেলে চন্দন।

রোদেলার পুকুরে গোসল করার সময় টুকু চন্দন পুকুর পাড়ের এক চিনতে জমির উপর ধুতুরা গাছের পাশে দাড়িয়ে থাকে। এখানে দুই ধরনের ধুতুরা গাছ আছে। একটিতে সাদা ফুল হয় অন্যটিতে বেগুনী। বেগুনী ফুলের ধুতুরা গাছকে কৃষ্ণ ধুতুরা বলে। ধুতুরা গাছে বিষ থাকে। ধুতুরা গাছের ডাল পাতা ফুল ফল সব কিছুতে বিষ তারপরও এই জমির সব টুকু জুড়ে ধুতুরা গাছ। এক সাথে এত ধুতুরা গাছ এর আগে চন্দন কখনো দেখেনি। রোদেলা প্রায়ই এখানে ঘুরে বাড়ায়। রোদেলার প্রিয় ফুল নাকি ধুতুরা। পরে অবশ্য চন্দন জেনেছে এই ধুতুরা গাছ দিয়েই নাজের হেকিম চাচীর চিকিৎসা করেন।

রোদেলার মায়ের শরীরটা ইদানিং ভাল যাচ্ছে না। প্রতিদিনই মনে হয় আর বুঝি টিকল না। তিনি রোদেলার বিয়ে দেখে যেতে চান তাই তরিঘরি করে রোদেলার বিয়ের আয়োজন করলেন কবীর সরদার।

রোদেলার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে খারাপ লাগছে না চন্দনের। রোদেলাকে ভাল লাগে না চন্দনের। রোদেলাকে বিয়ে করতে পারলে কবীর সরদারের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হতে পারত সে। এখন আর সেটা সম্ভব হবে না। এটা ভাবলে যা একটু হতাশ লাগে।

কবীর সরদারের একমাত্র মেয়ের বিয়ে! করি না করেও অনেক কিছু করলেন তিনি। রোদেলার গা ভরা গহনা দেয়া ছাড়াও দশ গ্রামের লোক দাওয়াত করে খাওয়ালেন।

রোদেলাকে সুপাত্রে দান করতে পেরে হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচালেন কবীর সরদার। এই সুযোগে সাহস করে কবীর চাচাকে চন্দন তার কলেজে ভর্তি হবার কথাটা বলে ফেলল। চন্দনকে হতাশ করে দিয়ে কবীর চাচা বললেন -

: তোমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট তেমন ভাল না। তাই কলেজে পড়ে পরবর্তীতে তেমন ভাল কিছু করতে পারবে বলে আমি মনে করি না। তোমার আপওি না থাকলে কলেজে আর ভর্তি না হয়ে আমার আড়তের ম্যানেজারের কাজটা করতে পার। আর একান্তই যদি কলেজে পড়তে চাও তবে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব। তাতে আমার কোন অসুবিধা বা আপওি নেই।

চন্দন আড়তের ম্যানেজার হওয়ার ব্যাপারেই সন্মতি জানাল। তার নিজেরও মনে হল এই রেজাল্ট নিয়ে বি কম পাশ করলে তার অন্য কোথাও চাকুরী হবার কথা না। দেখা যাবে শেষ অবদি তাকে এই আড়তের ম্যানেজারের কাজই করতে হবে। তাই যেটা তখন করতে হবে সেটা এখন থেকেই করা ভাল।

রোদেলার মায়ের শরীর আরো খারাপ করেছে। যখন তখন অবস্থা। মাকে দেখতে এসেছে রোদেলা। সাথে রোদেলার স্বামী বেলালও।

বিয়ের পরও রোদেলার চেহারায় কোন উজ্জ্বাল্য আসেনি। বরং তার পোড়া এঁটেল মাটি গায়ের রঙটা আরো বেশি পোড়া দেখাচ্ছে। বকবকানি অবশ্য কমে গেছে। কমে গেছে মুখের হাসিও। রোদেলার স্বামী আবার দেখতে বেশ সুপুরুষ। দেখতে সুপুরুষ হলেও কথাবার্তায় বেরসিক। মনে হয় মুখে সারাক্ষণ চিরতা দিয়ে রাখেছে। পাশাপাশি দুজনকে খুব অদ্ভুত দেখায়।

রোদেলা এ বাড়িতে থাকাবস্থায় তিন দিনের মাথায় রোদেলার মায়ের মৃত্যু হলো। মায়ের কুলখানির পরের দিন স্বামী সহ শশুড়বাড়িতে ফিরে গেল রোদেলা। চন্দনের সাথে তেমন কোন কথা হলো না রোদেলার শুধু যাওয়ার সময় এক ফাঁকে গোপনে চন্দনকে বলে গেল বিদেশে চলে যাবার আগে চন্দনের সাথে শেষবারের মতন একবার থাকতে চায়।

বিয়ের ছয় মাস অতিবাহিত হলেও কুয়েত ফিরে যাচ্ছে না বেলাল। দিনে দিনে আসল খবর বেরিয়ে এল। কুয়েতে চাকুরী নেই বেলালের। চাকুরিচুত্য হয়েই সে দেশে ফিরে এসেছিল। বিদেশে নিয়ে যাবার মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে রোদেলাকে বিয়ে করেছে শুধু মাত্র কবীর সরদারের সম্পত্তির লোভে।

মেয়ের জামাইয়ের কুয়েতে চাকুরী নেই জেনে মুষরে পরলেন কবীর সরদার। তিনি ব্যবসা করার জন্য মেয়ে জামাইকে নিজ থেকেই তিন লক্ষ টাকা দিলেন। মাস দুয়েক পর পুনরায় বেলাল কবীর সরদারের কাছে টাকা চায়। কবীর সরদার পূর্বের টাকার হিসেব চাইলে শশুড় জামাতার মধ্যে মনোমালিন্যের সুত্রপাত হয়।

এই রকম চলা অবস্থায় এক কাক ডাকা ভোরে জানা গেল বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে বেলাল।

রোদেলা ফিরে এসেছে তার নিজ গৃহে, আপন আলয়ে।

এত অল্প বয়সে মেয়েকে বিধবা হতে দেখে প্রায় উন্মাদ অবস্থা রোদেলার বাবার। দশ জন মিলেও তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না।

কিন্তু রোদেলার মধ্যে কোন রকম দুঃখ শোক কোন কিছুই নেই। সে বরাবরের মতই স্বাভাবিক।

কবীর সরদারের বয়স হয়েছে। রোদেলার মা মারা যাবার পর এমনিতেই একটু ভেঁঙ্গে পরেছেন তার উপর আবার বেলালের মৃত্যু। কবীর সরদারের আড়ত, জমি জিরাত, ব্যবসা সবই এখন চন্দন দেখা শোনা করে।

কবীর সরদার সারাদিন আড়তে মনমরা হয়ে বসে থাকেন আর একটু পর পর রোদেলার এখন কি হবে বলে বিলাপ করেন। চন্দন তার সাধ্য মতন কবীর সরদারকে সান্ত্বনা দেয়। রাতে ঘুমাতে পারেন না কবীর সরদার। প্রায়ই মাঝ রাতে চন্দনের ঘরে চলে আসেন। সারা রাত বিনিদ্রায় কাটায় দুজনে।

কবীর চাচার দুর্দিনে আর কিছু না পারুক অন্তত সান্ত্বনা দিয়ে পাশে থাকতে পেরে মনে মনে তুষ্ট চন্দন। চন্দন কিছু করতে পারবে না জানেন কবীর সরদার তারপরও চন্দনের কাছে মনের কথা বলে অনেকটাই হালকা বোধ করেন তিনি।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে মাত্রই লেগে আসা ঘুমটা ভেঁঙ্গে গেল চন্দনের। দুই বার কে কে বলার পরও কোন উওর না আসায় আবার ঘুমিয়ে পরার চেষ্টা করে সে। অল্প কিছু ক্ষণ পর আবারও কড়া নাড়ার শব্দ হয়। এবার আগের বারের চেয়ে একটু জোড়ে। সব সময়ের মত কবীর চাচা এসেছেন মনে করে দরজা খুলে দিতেই চন্দন কিছু বুঝে উঠার আগেই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে চন্দনকে জড়িয়ে ধরে রোদেলা।

: কি করতাছো? ছাড়ো। আমার লগে তোমার আর এই রকম করনডা ঠিক না কইলাম।

: ক্যান? ঠিক না ক্যান?

: তুমি বিধবা মেয়ে মানুষ। পর পুরুষের কাছে আসলে আল্লাহ নারাজ হইব।

চন্দনকে ছেড়ে দিয়ে অঝড়ে কাঁদতে থাকে রোদেলা। মন নরম হয়ে যায় চন্দনের। রোদেলার মাথায় হাত রাখে চন্দন।

: কাইন্দো না। কাইন্দা আর কি করবা? ভাগ্যে যা লিখা আছিল তাই হইছে। ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডন।

রোদেলা আর কিছু বলে না। শাড়ীর আচঁল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

পরদিন সকালে থানা থেকে পুলিশ এসে হাজির। রোদেলার বিরুদ্ধে দুধের সাথে ধুতুরার বিষ পানে স্বামী হত্যার মামলা করেছে বেলালের পরিবার। তারই পরিপ্রেক্ষিতে রোদেলাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যেতে এসেছে পুলিশ।

এ কথা শুনামাত্র মূর্জা গেলেন কবীর সরদার। তার চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানো হল। রোদেলাকে হাতে হ্যান্ড কাফ পরিয়ে নিয়ে গেল পুলিশ। যাবার সময় কি এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হল তা অবর্ননীয়।

কবীর সরদারের সাথে চন্দনও থানা পুলিশ উকিল করতে লাগল। থানায় রোদেলার সাথে দুই দিন দেখা করতে গেলে চন্দনের সাথে কোন কথা বলে না রোদেলা। চুপচাপ দূরেই বসে রইল।

দুদিন পর জেল হাজতে প্রেরন করা হল রোদেলাকে। এলাকার সব চেয়ে নামী এবং সফল উকিলকে ঠি ক করা হলো রোদেলার জামিনের জন্য। বেলালের শরীরে ধুতুরার বিষের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে তাই জামিন হল না রোদেলার। উন্মাদ অবস্থা কবীর সরদারের।

পাশে সার্বক্ষনিক চন্দনকে নিয়ে প্রায় মাস তিনেক কোট কাচারী আর গ্রামীন দেন দরবারের পর মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে বেলালের পরিবারকে দিয়ে রোদেলার বিরুদ্ধে করা স্বামী হত্যা মামলা তুলিয়ে নিতে সক্ষম হলেন কবীর সরদার।

বাড়ি ফিরে এল রোদেলা। ইদানিং চন্দনের সাথে ভাষায় তেমন কথা হয় না রোদেলার। তাদের যা কিছু কথা হয় সব চোখে চোখে। এক রাতে আবারও চন্দনের ঘরে আসল রোদেলা। এতদিনে কবীর সরদারের সম্পত্তির জন্য টান জন্মে গেছে চন্দনের তাই কোন রকম দেন দরবার ছাড়াই পুরোনো সম্পর্কে ফিরে গেল তারা।

নতুন করে পুরানো সম্পর্কে বিয়ের ব্যাপারে রোদেলা তেমন আগ্রহ না থাকলেও চন্দনের আগ্রহ অফুরান। এক সময় চন্দন রোদেলাকে জানিয়ে দিল বিয়ে ছাড়া সে আর পাপ কাজ করতে পারবে না তাই রোদেলা অনেকটা বাধ্য হয়েই কবীর সরদারকে জানাল যে সে চন্দনকে বিয়ে করতে চায়।

চন্দন কবীর সরদারের সব কিছুই দেখা শোনা করে। তার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল কবীর সরদার। চন্দন ভাল ছেলে। পছন্দ করার মতই। তাই রোদেলার কথায় একবাক্যে  চন্দনের সাথে রোদেলার বিয়ে দিতে রাজী হয়ে গেলেন কবীর সরদার।

কবীর সরদার বিয়ে দিতে রাজী হলো ঠিকই কিন্তু  রোদেলাকে বিয়ে করার ব্যাপারে একটা শর্ত জুড়ে দিল চন্দন। বাজারে কবীর সরদারের যে  আড়ত আছে সেই আড়ত এবং ক্ষেতি জমির এক তৃতীয়াংশ লিখে দিতে হবে চন্দনের নামে।

চন্দনের শর্ত শুনে হতভম্ব কবীর সরদার। রোদেলা তার একমাত্র সন্তান। তার যা কিছু আছে সব কিছুই এক সময় রোদেলা আর তার স্বামীরই হবে। তবে কি আর সবার মতই চন্দনও লোভী! তিনি বিয়ের মত পাল্টে ফেললেন। কিন্তু জেদ ধরে বসে রইল রোদেলা। সে চন্দনেকেই বিয়ে করবে নয়ত মরে যাবে। চন্দনও তার শর্তে অনড় তাই বাধ্য হয়ে কবীর সরদার বাজারের আড়ত আর এক তৃতীয়াংশ জমি চন্দনের নামে লিখে দিলেন ঠিকই  তবে তার সাথে তিনিও জুড়ে দিলেন একটি শর্ত। কোন কারনে যদি চন্দন রোদেলাকে তালাক দেয় তবে চন্দন সম্পত্তির মালিকানা হারাবে।

অতঃপর খুব সাধারন ভাবে চন্দনের সাথে রোদেলার বিয়ে দিয়ে দিলেন কবীর সরদার।

বিনা পরিশ্রমে শুধু মাত্র বুদ্ধি খাটিয়ে ভালবাসার খেলায় জিতে অগাধ সম্পত্তি মালিক হলেও চন্দনের মধ্যে আগের সেই প্রাঞ্জল ভাবটাই রয়ে গেছে। দিনে দিনে আরো কর্মঠ এবং দায়িত্বশীল হয়ে উঠছে চন্দন।

একদিন যে মামার বাড়িতে চন্দন থাকতে পারেনি মামির কারনে, পকেটে পয়সা আসার পর থেকে সেই মনু মামাকে খুব মনে পরে চন্দনের । কি ভীষন অভাবের সংসার মনু মামার! চন্দন দেখেছে সংসারের খানি টানতে টানতে মনু মামার জীবন প্রায় যায় যায় অবস্থা। চন্দনের এখন সামর্থ হয়েছে। চন্দন এখন তার মনু মামাকে সাহায্য করতে চায়। তাই চন্দন মনস্থির করে সামনের শুক্কুরবারে মামা বাড়ি যাবে সে।

...... চলবে

 

 

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ