লোকমান হেকিমের কেরামতির গল্প-৩

নিতাই বাবু ১১ অক্টোবর ২০১৯, শুক্রবার, ০৯:০৮:২৬পূর্বাহ্ন গল্প ২৯ মন্তব্য

গল্পের দ্বিতীয় পর্ব এখানে➘

লোকমান হেকিমের কেরামতির গল্প-২ 

দ্বিতীয় পর্বের শেষাংশ➷

নিরুপায় বাদশা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে থাকা খাটের এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলেন, আজ হয়তো আমার নির্ঘাত মৃত্যু-ই হবে।

বাদশা এমন দুশ্চিন্তা নিয়ে একসময় ঘুমিয়ে পড়লেও, সেই রাতে বাদশার তেমন ঘুম হয়নি! মৃত্যুও হয়নি। ভোর হতে-না-হতেই বাদশা আবার ছুটে গেলেন বন্ধু লোকমান হেকিমের বাড়ি। বাদশার এখন আর কিছুই ভালো লাগছে না। খাওয়া নেই। নাওয়া নেই। ঘুম নেই। বাদশা এখন শারীরিক দিক দিয়েও ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বাদশাকে দেখে লোকমান হেকিম জিজ্ঞেস করলো, ‘বন্ধু, বেতের নৌকার খবর কী’? আর আমি তোমাকে বলেছি বেতের নৌকা। তা আসলে কিন্তু ছোট্ট একটা নৌকা নয়! হতে হবে বিশালাকৃতির এক জাহাজের মতো। যেহেতু আমরা সাগরে যাবো, সেহেতু আমাদের নৌযান হতে তার উপযোগী। সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ অতিক্রম করে আমাদের সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। কাজেই আমাদের নৌযানও থাকতে হবে ঐরকমই। আর মাঝিমাল্লাও থাকতে হবে পর্যাপ্ত। বেতের জাহাজ চলবে দিনরাত। মাঝিরা কেউ কাজ করবে, কেউবা বিশ্রামে থাকবে। তুমি সেইভাবেই জাহাজটা তৈরি করবে, বন্ধু।’

বাদশা বললো, ‘আমি জানি সাগরে চলার জন্য কোন ধরনের নৌযান উপযোগী। তোমার এব্যাপারে বলার আগেই আমি ইতোমধ্যে বেতের জাহাজ তৈরি করার জন্য শ’খানেক লোক লাগিয়ে দিয়েছি। তাও হবে দোতলা জাহাজ। জাহাজে থাকবে শখানেক মাঝিমাল্লা। থাকবে দীর্ঘদিনের খাবার সামগ্রী। আমার উজির সাহেব বললেন, খুব শীঘ্রই জাহাজ তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

লোকমান হেকিম বললো, ‘ঠিক আছে বন্ধু। তা-ই যেন হয়! আর তোমার কোঁয়া কোঁয়াকে সাগর ভ্রমণের ব্যাপারে কিছু বলেছ’? উত্তরে বাদশা বললো, ‘না বন্ধু! তা আর বলা হয়নি। তবে আজকেই রাক্ষসী কোঁয়া কোঁয়াকে বলবো’। লোকমান হেকিম বললো, ‘তাহলে এখন তুমি তোমার মহলে গিয়ে বিশ্রাম করো। আর বেতের জাহাজ তৈরির কাজে তদারকি করো। যাতে অতি তাড়াতাড়ি জাহাজ তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। আর তোমার কোঁয়া কোঁয়াকে ম্যানেজ করো’। এই বলেই লোকমান হেকিম বাদশাকে তাঁর মহলে জোর করে পাঠিয়ে দিলেন। বাদশা আগের মতোই ভয়ে ভয়ে মহলের দিকে রওনা দিলো।

বাদশা মহলে গিয়ে কোঁয়া কোঁয়াকে বললো, ‘ক’দিন পর আমরা সাগর ভ্রমণে বের হবো। নতুন বিবাহ করেছি তো, তাই তোমাকে নিয়ে হানিমুনে যাবো। কী বলো, কোঁয়া কোঁয়া?’ উত্তরে কোঁয়া কোঁয়া জবাব দিলো, ‘এসব আমার কিছুই ভালো লাগে না জাঁহাপনা। আপনি বরং নিজেই সাগর ভ্রমণে যান। আমি মহলেই থাকি। এতদিন বন জঙ্গলে ছিলাম। ভাগ্যক্রমে আপনার দেখা পেলাম। আপনাকে স্বামী হিসেবেও পেলাম। এখন আপনার মুল্লুক ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না।’ বাদশা বললো, ‘না কোঁয়া কোঁয়া, তা হয় না। তোমাকে আমার সাথে যেতেই হবে। না গেলে আর হচ্ছে না।’ বাদশার অনুরোধে শেষতক কোঁয়া কোঁয়া রাজি হলো। বেতের জাহাজ তৈরি করা সম্পন্ন হলো। জাহাজের ভেতরে মাসেক ছ’মাসের খাদ্যসামগ্রী তোলা হলো। সাগর ভ্রমণে যাবার দিনতারিখ ঠিক হলো। যাবার আগের দিন লোকমান হেকিমকে জানানো হলো। সঠিক সময়ে বাদশা কোঁয়া কোঁয়াকে নিয়ে বেতের জাহাজের দোতলায় গিয়ে উঠলো। মাঝিরাও জাহাজ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। অপেক্ষা শুধু লোকমান হেকিমের জন্য। কিন্তু বাদশার বন্ধু লোকমান হেকিম আসতে দেরি হচ্ছে। দেরি হবার কারণ হলো লোকমান হেকিম সাথে করে যেসব প্রয়োজনীয় কিছু ঔষধপত্র সাথে নিবেন, সেগুলো গোছাতেই হলো দেরি।

জাহাজের দোতলায় বাদশার সাথে বসে আছে রূপসী কোঁয়া কোঁয়া। কোঁয়া কোঁয়া বাদশাকে বলছে, ‘কী ব্যাপার জাঁহাপনা, জাহাজ ছাড়ছে না কেন?’ জবাবে বাদশা বললো, ‘মাঝিরা আমার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছে। আমার বন্ধু আসলেই জাহাজ ছেড়ে দিবে।’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘এটা আপনার কোন বন্ধু, জাঁহাপনা? ঐযে, সেদিন আপনার সাথে যাকে দেখলাম, তিনি?’ বাদশা মাথা নেড়ে জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ কোঁয়া কোঁয়া। এই বন্ধুটি ছাড়া আমি একদম চলতে পারি না। আমার যেখানেই যাওয়া হয়, আমি আমার বন্ধুকে নিয়ে সেখানে যাই।’ কোঁয়া কোঁয়া এবার খুব রাগ হয়ে বাদশাকে জিজ্ঞেস করলো, জানতে পারি, আপনার বন্ধু কী করে?’ বাদশা নির্ভয়ে মনে আনন্দ নিয়ে জবাব দিলেন, ‘আমার প্রাণপ্রিয় বন্ধু হলেন হেকিম। তাঁর নাম লোকমান হেকিম। তিনি গাছেদের সাথেও কথা বলতে পারেন।’ লোকমান হেকিমের কথা শুনেই কোঁয়া কোঁয়া রেগেমেগে অস্থির হয়ে বললো, ‘আমি সাগর ভ্রমণে যাবো না। আপনি আপনার বন্ধুটিকে সাথে নিয়ে ঘুরে আসুন!’ বাদশাও এবার একরকম রাগের মাথায় ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমার বন্ধু আমার সাথে যাবে, তাতে তোমার সমস্যা কী? আমিতো তোমার কোনও সমস্যা দেখছি না! প্রয়োজনে আমার বন্ধু জাহাজের নিচতলায়ই থাকবে। তবুও আমার প্রিয় বন্ধু সাথে যাবে।’

বাদশার এমন রাগ দেখে কোঁয়া কোঁয়া একটু নরম হলেন। চুপ করে বসে বসে কী যেন ভাবলেন। এরপর নিজে থেকেই বলে ফেললেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে জাঁহাপনা। উনি আসুক! নিচতলায় যখন থাকবে, তো আমার কোনও সমস্যা নেই! তবে হ্যাঁ, উনি যেন কোনও অবস্থাতেই উপর তলায় না উঠে। কারণ, আমি পরপুরুষের ছায়া দেখি না।’ কোঁয়া কোঁয়ার কথায় বাদশা মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এমন সময় লোকমান হেকিম তাঁর প্রয়োজনীয় ঔষধাদি সাথে নিয়ে জাহাজের সামনে হাজির হলেন। জাহাজে উঠে নিচতলায় গিয়ে বসলেন। মাঝিদের জাহাজ ছাড়ার জন্য বললেন। মাঝিরা জাহাজ ছাড়লেন। জাহাজ চলছে অজানার উদ্দেশে। কোথায় যাবে, কোনদিকে যাবে তার নির্দেশনা দিচ্ছেন, লোকমান হেকিম নিজেই। এভাবে চলতে চলতে দুই মাস পার হলে গেল। তবুও চলছে বেতের জাহাজ। এরমধ্যে কোথাও কোথাও বিরতিও চলছে। বিরতির সময় জাগায় জাগায় নেমে সবাই এদিক সেদিক ঘোরাফেরাও করছে। আবার চলছে জাহাজ অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে।

একসময় কোঁয়া কোঁয়া বিরক্ত হয়ে বাদশাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাঁহাপনা, আপনার ভ্রমণের গন্তব্যস্থান কোন সাগর পাড়ে? যেখানে যাবেন, সেখানকার নামটা জানতে পারি?’ কোঁয়া কোঁয়ার কথা শুনে বাদশা রীতিমতো থ বনে গেল! কোঁয়া কোঁয়ার কথার জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গ তুলতেই, নিচ থেকে লোকমান হেকিম বললো, ‘বন্ধু তোমার স্ত্রীকে বলো, আমরা ঠিক কুলসুম দরিয়ার কাছাকাছিই যাবো।’ লোকমান হেকিমের কথা শুনে কোঁয়া কোঁয়া হাসতে লাগলো। কোঁয়া কোঁয়ার হাসির শব্দ লোকমান হেকিমের কানে এলে, লোকমান হেকিম নিচ থেকে জানতে চাইলেন, ‘হাসির রহস্য কী?’ লোকমান হেকিমের জিজ্ঞাসার জবাবে কোঁয়া কোঁয়া বললো, ‘কুলসুম দরিয়া আমার খুবই পছন্দের।’ কোঁয়া কোঁয়ার মুখে এই কথা শুনে বাদশা ভয়ে থরথর! তারপরও তেমন ভয় পাচ্ছে না, কারণ বন্ধু লোকমান হেকিম সাথে আছে বলে।

কুলসুম দরিয়া কোঁয়া কোঁয়ার কাছে খুবই পছন্দের! এমন কথা শোনার পর লোকমান হেকিম বললেন, ‘বাহ্, বেশ তো! তাহলে তো অচেনা অজানা জায়গা নিয়ে আমাদের আর কোনও চিন্তাই নেই। এমনিতেই কুলসুম দরিয়ার পানিতে আঁশ নেই। যাকে বলে দো-আঁশ পানি। শুনেছি এই দরিয়ার পানিতে কোনকিছু ভেসে থাকে না। এ-ও শুনেছি যে, এই দরিয়ার নাকি কোনও তলাও নেই। শুধু পানি আর পানি। তা কী ঠিক, ভাবীসাহেবা? আমি কি তা ভুল শুনেছি?’ লোকমান হেকিমের কথার জবাবে কোঁয়া কোঁয়া বললেন, ‘যতসব আহাম্মকের মতো কথাবার্তা! দরিয়ার যদি তলাই না থাকে, তো এতো পানি আছে কিসের উপর? অবশ্যই পানিগুলো একটা পাত্রের উপরেই আছে! শুধু কুলসুম দরিয়া কেন, দুনিয়ায় সব নদীনালা, সাগর মহাসাগরেরও তলা আছে।’

এবার লোকমান হেকিম হেসে বললেন, ‘আমার বিশ্বাস হয় না যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে। আর যদি থেকেই থাকে, তো আপনাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। কুলসুম দরিয়ার তলা আছে তা কি আপনি প্রমাণ করতে পারবেন, ভাবীসাহেবা?’ কোঁয়া কোঁয়া রাগে গোস্বায় বললো, ‘অবশ্যই প্রমাণ দেখাতে পারবো।’ লোকমান হেকিম বললেন, ‘তা কীভাবে আপনি প্রমাণ দেখাবেন যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে?’ কোঁয়া কোঁয়া বললো, 'কুলসুম দরিয়ার মাঝখানে যাওয়ার পর আমি একটা সাপ হয়ে পানির নিচে যাবো। আমার লেজটা থাকবে আপনার হাতে। আমি কুলসুম দরিয়ার তলদেশে গিয়ে লেজ নাড়াচাড়া করলেই বুঝতে হবে আমি কুলসুম দরিয়ার তলদেশে পৌঁছেছি। আর নাহয় কুলসুম দরিয়ার তলদেশ থেকে আমি আমার মুখে করে মাটি নিয়ে আসবো। তাহলেই তো প্রমাণ হয়ে গেল যে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে!’ এখন আপনি কোনটাতে রাজি?’

লোকমান হেকিম বললেন, ‘আপনাকে কষ্ট করে এতো নিচ থেকে মাটি কামড়ে আনতে হবে না, ভাবীসাহেবা। আপনার লেজটা যদি আমার হাতেই থাকে, নিচে গিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে কুলসুম দরিয়ার তলা আছে।’ কোঁয়া কোঁয়া তাতেই রাজি হয়ে বললো, ‘ঠিক আছে হেকিম সাহেব তা-ই হবে।’ কোঁয়া কোঁয়ার মুখে এমন কথা শোনার পরই বাদশা জ্ঞানহারা হয়ে গেলেন। বাদশার আর কোনও হুশ নেই, জ্ঞানও নেই। বাদশা একটা মরা লাশের মতো শুইয়ে আছে। বেতের জাহাজও চলছে জোরেসোরে। কুলসুম দরিয়ার মাঝে পৌঁছতে আর অল্প ক’দিনের পথ বাকি। এরপরই শুরু হবে কোঁয়া কোঁয়া আর লোকমান হেকিমের কেরামতি।

চলবে…

এখানে☛ লোকমান হেকিমের কেরামতির গল্প-৪   

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ