লোকমান হেকিমের কেরামতির গল্প-২

নিতাই বাবু ৯ অক্টোবর ২০১৯, বুধবার, ০১:৪০:০৯পূর্বাহ্ন গল্প ২২ মন্তব্য

গল্পের প্রথম পর্ব এখানে➘

লোকমান হেকিমের কেরামতির গল্প-১

গল্পের প্রথম পর্বের শেষাংশ➷

বাদশা সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে বললো, এসব আমি বিশ্বাস করি না। আমাকে এর প্রমাণ দেখাতে হবে।’লোকমান হেকিম বললো, ‘অবশ্যই প্রমাণ দেখবে বন্ধু’।

বাদশা বললেন, ‘আর হ্যাঁ, প্রমাণ দেখতে হলে তোমার কিছু কাজ করতে হবে। তা কি তুমি পারবে?’ বাদশা বললেন, ‘অবশ্যই পারবো। বলো আমাকে কী করতে হবে?’ লোকমান হেকিম বললো, ‘প্রথমত তোমার মহল অভ্যন্তরে থাকা সমস্ত পানির উৎস বন্ধ করতে হবে। যেমন: ঘরে থাকা কলসিতে পানি থাকতে পারবে না। গোপনে পানির কলসি খালি করে রাখতে হবে। তা যেন তোমার নতুন রাণী না জানে। যদি তোমার মহলের ভেতরে পানির কল (জাঁতাকল) থেকে থাকে, তাও গোপনে উঠিয়ে ফেলতে হবে। মোটকথা তোমার মহলে যেন কোথাও কোনও পানি না থাকে। এসব তুমি কি করতে পারবে, বন্ধু?’ বাদশা সায় দিলেন, ‘পারবো। তারপর? লোকমান হেকিম বললো, ‘তারপর গভীর রাতে তুমি তোমার নতুন রাণীর কাছে এক গ্লাস পানি চাইবে। তুমি বলবে, আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে, আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। তখন দেখবে তোমার নতুন রাণী তোমাকে কোত্থেকে পানি এনে দেয়। তবে খবরদার! পানি যেখান থেকেই সংগ্রহ করুক-না-কেন, সেই পানি তুমি কিন্তু পান করো না। যদি ভুলবশত সেই পানি তুমি পান করো, তাহলে তোমার নির্ঘাত মৃত্য’। এই বুদ্ধি দিয়ে বন্ধু লোকমান হেকিম বাদশার মহল ত্যাগ করে নিজের গন্তব্যে চলে যায়। যাবার আগে বলে গিয়েছে, ‘আমি বন্ধু আগামীকাল আবার তোমাকে দেখতে আসবো’। বন্ধু লোকমান হেকিমের কথা শুনে বাদশা সেসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য মুহূর্তেই লোক লাগিয়ে দিলেন।

বন্ধু লোকমান হেকিমের কথা শুনে বাদশা সেসব কাজ সম্পন্ন করার জন্য মুহূর্তেই লোক লাগিয়ে দিলেন।
যাঁর লোকের অভাব নেই, তাঁর কাছে অনেক কঠিন কাজ সহজে করাটাও কোনও ব্যাপার নয়। মুহূর্তেই সব কাজ সমাধা হয়ে গেলো। এখন আর বাদশার মুল্লুকের কোথাও এক ফোঁটা পানি পাওয়া যাবে না। কেউ পানি পানি করে চিল্লা-চিল্লি করলেও পানি পাবে না। না পাক! তাতে বাদশার কিছুই আসে যায় না। বাদশার দরকার কোঁয়া কোঁয়ার রূপ দেখা। একসময় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত হলো। বাদশা দরবার হল থেকে কোঁয়া কোঁয়ার ঘরে যেতে ভয় পাচ্ছিল! না গেলেও হচ্ছে না। ভয় করলেও বাদশাকে অন্তত আজকের রাতটুকু কোঁয়া কোঁয়ার ঘরে কাটাতে হচ্ছে।

নিরুপায় বাদশা উপায়ান্তর না দেখে ভয়ে ভয়েই কোঁয়া কোঁয়ার ঘরে গিয়ে শুয়ে রইলেন। কোঁয়া কোঁয়া বাদশাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাঁহাপনা, কিছু মুখে না দিয়ে শুয়ে রইলেন যে’? বাদশা ভয়ে কোঁয়া কোঁয়ার দিকে না তাকিয়ে বললো, ‘আজ আমার পেটে ক্ষুধা নেই। আমার শরীরটা খুবই ক্লান্ত। তাই শুয়ে রইলাম। আমাকে আর ডাক দিও না, কোঁয়া কোঁয়া। আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে’। এই বলেই বাদশা ঘুমের ভাণ ধরে শুয়ে রইলেন। রাত যখন গভীর হলো, বাদশা কুড়মুড়িয়ে উঠে পানি পানি করতে লাগলো। বাদশার গলার আওয়াজ কোঁয়া কোঁয়ার কানে যেতেই, কোঁয়া কোঁয়া ঘুম থেকে উঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘জাঁহাপনা, আপনার কি পানির পিপাসা পেয়েছে’? বাদশা মাথা নেড়ে সায় দিল। কোঁয়া কোঁয়া একটা গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরে থাকা পানির পাত্র কলসির সামনে গেল। কিন্তু কলসিতে পানি নেই! হাতে গ্লাস নিয়েই ঘরের বাইরে থাকা জাঁতাকলের সামনে গেলো। জাঁতাকলও নষ্ট! পানি ওঠে না। কোঁয়া কোঁয়া এখন ভাবছে! কী ব্যাপার? ঘরের কলসিতে পানি নেই, জাঁতাকল নষ্ট। এসবের মানে কী? কোঁয়া কোঁয়া ঘরে এসে ভাবতে শুরু করলো। ভাবতে ভাবতে চোখের সামনে লোকমান হেকিমের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। কোঁয়া কোঁয়া বুঝতে পেরেছে এটা বাদশার বন্ধুর শলা-পরামর্শগুলোর মধ্যে একটি।

কোঁয়া কোঁয়া ভাবছে, আর বাদশা বুজুবুজু টেরা চোখে ভয়ে ভয়ে দেখছে। এমন সময় কোঁয়া কোঁয়া ঘরের জানালা খুললো। জানালা খুলে জানালার রড বেঁকিয়ে ফেললো। তারপর বাম হাতে পানির গ্লাসটা ধরে জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে দিলো। সেই দৃশ্য বাদশা টেরা চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। বাদশা দেখতে পেলো, গ্লাস-সহ হাত শুধু লম্বাই হচ্ছে। এতে পানির গ্লাস-সহ হাত যে কোথায় যাচ্ছে, তা বাদশার ছিল অজানা। এরপর বাদশা জ্ঞানহারা হয়ে বিছানায় ঢলে পড়ে রইল। কোঁয়া কোঁয়া মুহূর্তেই গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে এলো। পানির গ্লাসটা বাদশার সামনে ধরে বলছে, ‘জাঁহাপনা, পানি নিন, পান করুন!’ কিন্তু বাদশার আর হুঁশ নেই, জ্ঞান নেই। বাদশার এই অবস্থা দেখে কোঁয়া কোঁয়া বুঝতে পেরেছে, বাদশা ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে। কোঁয়া কোঁয়া মনের ক্ষোভে পানি ভর্তি গ্লাসটা ঘরে মেঝেতে ফেলে দিয়ে শুইয়ে রইল।

সকাল হতে-না-হতে বাদশা কোঁয়া কোঁয়াকে ঘুমে রেখেই একটা ঘোড়া নিয়ে বন্ধু লোকমান হেকিমের বাড়িতে রওনা দিলো। লোকমান হেকিম তখনও ঘুমের ঘোরে। বাদশা বন্ধু লোকমান হেকিমের ঘরের দরজায় টোকা দিতেই লোকমান হেকিম ঘরের দরজা খুলে বাইর হলো। ঘর থেকে বের হয়ে লোকমান হেকিম দেখলো বন্ধু বাদশাকে। বাদশা কাঁদা কাঁদা স্বরে বললো, ‘বন্ধু আমাকে বাঁচাও! এই রাক্ষসীর হাত থেকে আমার মুল্লুক বাঁচাও!’ হেকিম বললেন, ‘কেঁদো না বন্ধু, তুমি শান্ত হও! সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। এই বলেই লোকমান হেকিম তাড়াতাড়ি করে বাদশাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। বসতে দিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘটনা কী বন্ধু? কিছু টের পেলে? তোমার নববধূ কোত্থেকে পানি এনেছিল? এবার বুঝতে পেরেছো তো’? বাদশার মুখে কোনও কথা নেই। অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন।

লোকমান হেকিম এবার জিজ্ঞেস করলো, ‘বন্ধু তোমার কোঁয়া কোঁয়া কি রাতে কিছু পানি এনেছিল? যদি পানি এনে থাকে তো কীভাবে এনেছি’? লোকমান হেকিমের প্রশ্নের জবাবে বাদশা গতরাতে ঘটে যাওয়া ঘটনা বলতে গিয়ে বললেন, ‘বন্ধু আমি তোমার কথামতো ঘুমের ভাণ করে অনেক রাত পর্যন্ত শুইয়ে রইলাম। এরপর একসময় আমি এক গ্লাস পানি দেবার জন্য কোঁয়া কোঁয়াকে বললাম। কোঁয়া কোঁয়া ঘরে বাইরে কোথাও পানি না পেয়ে ঘরের জানালার রড বাঁকা করে গ্লাস-সহ হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি দেখলাম কোঁয়া কোঁয়ার হাত শুধু লম্বা হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থা দেখেই আমি জ্ঞানহারা হয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম। এরপরের ঘটনা কী ঘটেছে, তা আর আমি জানি না, বন্ধু’। লোকমান হেকিম বললেন, ‘এখন প্রমাণ পেলে তো’? তুমি বন্ধু ভুল করে যেই রাক্ষসী তোমার মুল্লুকে এনেছো, এর খেসারত তুমি তো দিবেই; সাথে তোমার মুল্লুকের জনসাধারণকে দিতে হবে’।

লোকমান হেকিমের কথায় রাগ না করে বাদশা বললেন, ‘এখন উপায়?’ লোকমান হেকিম বললো, ‘অবশ্যই এর উপায় আছে বন্ধু। তবে আরও কিছু কাজ করতে হবে’। জবাবে বাদশা বললেন, ‘এই রাক্ষসীকে তাড়াতে যা করা দরকার তা-ই করবো। আর যাকিছু লাগে তা-ই দিবো। তবু আমার মুল্লুক থেকে এই রাক্ষসীকে তাড়াও, বন্ধু’। লোকমান হেকিম বললেন, ‘ঠিক আছে বন্ধু, তা-ই হবে। এখন তুমি তোমার মহলে চলে যাও’! মহলে যাবার কথা শুনেই বাদশা ভয়ে কেঁপে কেঁপে বললো, ‘না বন্ধু, এই রাক্ষসী থাকতে আমি আমার মহলে যাবো না। তুমি তাড়াতাড়ি ও-কে তাড়ানোর ব্যবস্থা অরো’! লোকমান হেকিম বললেন, ‘তাড়াতে তো অন্তত কয়েকদিন সময় লেগে যেতে পারে, বন্ধু। আর এই সময়ের মধ্যে একটা বড় বেতের নৌকা তৈরি করতে হবে। বেতের নৌকাটি হবে দোতলা’।

সেই নৌকায় চড়ে আমাদের যেতে হবে কুলসুম দরিয়ায় (নীল দরিয়া)। যেই সাগরের পানির উপরে কিছুই ভেসে থাকে না। লোহা দিয়ে তৈরি করা জাহাজও ভেসে থাকে না। এমনকি কাঠের জাহাজ অথবা নৌকাও ভাসে না। সব রকমের বস্তু দিয়ে তৈরি জাহাজ অথবা নৌকা মুহূর্তেই ডুবে যায়। ডুবে না একমাত্র বেত দিয়ে তৈরি করা জাহাজ অথবা নৌকা। বেতের নৌকায় চড়ে আমরা সেই দরিয়া-ই যাবো। সাথে তোমার নববঁধূও থাকবে। তবে এর আগে তোমার কোঁয়া কোঁয়াকে শুনাতে হবে যে, আমরা কিছুদিনের জন্য সাগর ভ্রমণে যাবো। সাথে আমার এক বন্ধুও যাবে। তোমার কোঁয়া কোঁয়া অবশ্য যেতে চাইবে না। তারপরও শত চেষ্টা করে হলেও তাকে রাজি করাতে-ই হবে। তুমি কি পারবে বন্ধু’? জবাবে বাদশাই বললেন, ‘বেতের নৌকা তৈরি করতে বেশিদিন সময় লাগবে না বন্ধু। আমি আমার লোকজন দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি সময়ের মধ্যেই বেতের নৌকা তৈরি করে ফেলবো। হয়তো একটু সময় গালবে কোঁয়া কোঁয়াকে রাজি করাতে। তা যেভাবেই হোক আমি কোঁয়া কোঁয়াকে রাজি করাবো-ই’।

বাদশার কথা শুনে লোকমান হেকিম বললেন, 'তাহলে এবার তুমি মহলে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় কাজ করো। আর হ্যাঁ, তোমার রূপসী কোঁয়া কোঁয়ার সাথে আমাদের কথোপকথন ভুলেও ফাঁস করবে না। যদি করো তো মহা বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।' এই বলেই লোকমান হেকিম কইয়ে-বইয়ে বাদশাকে মহলে পাঠিয়ে দিলেন। বাদশা ভয়ে ভয়ে মহলে গেলেন। মহলে গিয়ে উজির, নাজির, কোতোয়ালকে সাথে নিয়ে দরবারে বসলেন। তাঁদের হুকুম দিলেন, ‘আজ থেকে তিনদিনের মধ্যে আমাকে একটা বেতের নৌকা তৈরি করে দিতে হবে। এর জন্য কী করতে হবে আমাকে বলুন’! এরপর দরবারে উপস্থিত থাকা সবাই বললেন, ‘ঠিক আছে জাঁহাপনা, তা-ই হবে’। এই বলেই উজির নাজির কোতোয়াল বের হলেন বেতের নৌকা তৈরি করার কারিগরের খোঁজে। বাদশা গেলেন অন্দরমহলে। মনের ভেতর ভয় থাকার কারণে বাদশা কোঁয়া কোঁয়ার ঘরে আর যায়নি। গিয়েছে বড় রাণীর ঘরে। বড় রাণীর ঘরে যাবার সময় কোঁয়া কোঁয়া বাদশাকে দেখে ফেলেছে। এরপর কোঁয়া কোঁয়া বড় রাণীর ঘর থেকে বাদশাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিজের ঘরে নিয়ে আসে। নিরুপায় বাদশা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে থাকা খাটের এক কোণে বসে বসে ভাবতে লাগলেন, আজ হয়তো আমার নির্ঘাত মৃত্যু-ই হবে।

চলবে...

এখানে☛লোকমান হেকিমের কেরামতির গল্প-৩ 

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ