
ভাগ্য এ কোন খেলায় মেতেছে আমায় নিয়ে? যেনো একটা ধাক্কায় ভেঙ্গে দিলো আমার সমস্ত সাজানো গোছানো স্বপ্ন। যা আমি অর্জন করতে চেয়েছিলাম নিজের যোগ্যতা। কিন্তু ভাগ্য বোধহয় অন্যকিছু চেয়েছিল। সমস্ত স্বপ্ন আমার ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে কারো রোষানলে এ আমার কল্পনাতেও আসেনি কখনো। কেনো এমন হলো আমার সাথে?
আরো একটা বছর অপেক্ষা করার জোর আমি কোথায় পাবো? সাজানো স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্ত্রণা এতো ধারালো কেনো? যেনো তীক্ষ্ণ ছুরির আঘাতে এ এফোঁড় ওফোঁড় করছে আমাকে, আমার সমস্ত সত্ত্বাকে। ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত করছে আমার হৃৎপিণ্ড।
হঠাৎ তার বাবার মুখ ভেসে উঠলো নিলুর সামনে। কি করে সবটা বলবে তার বাবাকে? তার মেধাবী আদরের মেয়েটার এমন সর্বনাশ মানতে পারবে কি তার অসহায় দরিদ্র পিতা? মানুষটা যে আশায় বুক বেঁধে আছে। মেয়ে পড়াশোনা শেষ করে অনেক বড়ো চাকরি করবে। বন্ধক রাখা ঘর ছাড়াবে। সুখের সময় আসবে আনোয়ারের সংসারে। তারপর সুন্দর একটা যোগ্য ছেলে দেখে মেয়ে বিয়ে দেবে। এতোটুকু স্বপ্ন বুকে ধারণ করে বেঁচে আছে যে বাবা তাকে কি করে এই নৃশংসতার কথা বলবে নিলু?
নিজের স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্ত্রণা সইয়ে ওঠার আগেই নিলুর কাছে খবর এলো তার বাবা অসুস্থ। নিলু কে দ্রুত বাড়ি যেতে বলেছে। নিলু আর কাল বিলম্ব না করে বেড়িয়ে পরলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাসে উঠে বসে অপেক্ষা করছে ঘরে ফিরার। একটা সময় এই অপেক্ষার অবসান হবে। কিন্তু বাবার সামনে দাঁড়াবে কি করে নিলু? ভাবতেই যেনো বুক কেঁপে উঠলো নিলুর। কি হবে যখন তার বাবা জানতে চাইবে তার রেজাল্ট এর কথা? সত্যিটা বলতে পারবে না কিন্তু মিথ্যেটাই বা বলবে কি করে? নিলু কখনো তার বাবাকে মিথ্যে বলেনি। হায় ঈশ্বর এ কেমন ঝড় তুললে তুমি নিলুর জীবনে! এতোক্ষণ নিলুর মাথায়ই ছিলো না তার বাবা অসুস্থ।
কি হয়েছে বাবার, কেমন আছেন এখন? পরীক্ষার জন্য অনেক দিন বাড়ি আসা হয়নি। কতোদিন দেখি না বাবা মাকে। মাস দুয়েক আগে একবার বাবা এসেছিলেন । তখন বাবাকে কিছুটা ক্লান্ত দেখালেও অসুস্থ মনে হয়নি। হঠাৎ কি হলো বাবার? প্রচণ্ড চিন্তা হচ্ছে, না জানি কেমন আছেন বাবা? আল্লাহ তুমি আমার বাবাকে সুস্থ করে দাও।
বাস দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাস যতো বাড়ি মুখো হচ্ছে নিলুর ততোই শিউরে উঠছে। না জানি বাড়িতে কি অপেক্ষা করছে ওর জন্য? বাস থেকে নেমে ভ্যানে চেপে রওনা দিলো বাড়িতে। মিনিট বিশেক পর ভ্যান ভাড়া মিটিয়ে দিলো। পাঁচ মিনিট হেঁটে বাড়ির সামনে আসতেই মাকে দেখলো উঠানে দাঁড়িয়ে থাকতে। মা মেয়েকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলো। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো মা তুমি এসেছো। দেখো না তোমার বাবা কয়দিন ধরে বেশ অসুস্থ। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে সারাদিন শুধু তোমার কথা বলছে। শুধু বলছে নিলুর মা আমার নিলু ভালো আছে তো। মেয়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে। বুকের ভেতর কেমন করে উঠছে। আল্লাহ তুমি আমার মেয়েকে ভালো রেখো।
নিলু কেবল নির্বাক হয়ে মায়ের কথা শুনছে। নিলুর ভেতরে ভেঙ্গেচুরে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। বাবা কি করে বুঝলো তার আদরের সন্তানের জীবনে অলরেডি কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে গেছে? অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলো নিলু। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির আভা টেনে বললো
নিলুঃ তোমরা শুধু শুধুই আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করো। আমি একদম ঠিক আছি মা। আচ্ছা মা বাবা কোথায়? বাবাকে দেখছি না তো।
আয়েশাঃ উনি একটু ব্যাপারীর বাড়ি গেছেন। ব্যাপারী ডেকে পাঠিয়েছেন। কি কথা আছে নাকি?
তুমি যাও মা হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রাম নাও। আমি খাবার দিচ্ছি।
নিলুঃ না মা, এখন কিছু খাবো না। বাবা ফিরে আসুক। তখন না হয় একসাথে খাবো। কতোদিন তোমাদের সাথে, একসাথে বসে খাইনা বলো তো।
আয়েশাঃ ঠিক আছে তাহলে তুমি বিশ্রাম করো। আমি দেখি তোমার বাবা এখনো আসছে না কেনো? মানুষটার শরীর খুব খারাপ তবুও গেলো। কি আর করার ব্যাপারী সাহেব ডেকে পাঠিয়েছে, না গিয়ে তো উপায় নেই।
নিলুঃ এই অসুস্থ শরীরে তুমি বাবাকে একা ছাড়লে কেনো মা? তুমিও যেতে পারতে।
আয়েশাঃ আমি যেতে চেয়েছি। উনি সাথে নেননি আমায়। বলে বাড়িতেই থাকো। যদি নিলু আসে তবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। মেয়েটা এতোদূর থেকে এসে যদি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে কেমন লাগে বলো?
নিলু ভাবে কোনো বাবা কি করে তার মেয়েকে এতো ভালোবাসতে পারে? পৃথিবীর সব বাবাই কি এমন হয়! সব বাবারাই কি তাদের সন্তানদের এমন ভালোবাসতে পারেন? না তা কি করে হবে, তাহলে তো পিতার ছুরিকাঘাতে মরতে হতো না কোনো নিষ্পাপ শিশুকে। বলি হতো না কোনো কন্যা শিশুর। অনেক ভাগ্যবতী আমি, এমন বাবার ওরসে জন্ম নিতে পেরেছি।
নিলুর তখন শাওনের কথা মনে পড়ে গেলো। সেও তো বাবা, তারও তো দুটো মেয়ে সন্তান আছে। আমার এতো বড় ক্ষতি করার আগে মনে পড়লো না তাদের মুখ গুলো। নাহ্ সব বাবাই বাবা হয় না, হতে পারে না। নিলু প্রচণ্ড অস্বস্তি বোধ করছে। সে ভাবলো যদি গতিক সুবিধার হয় তবে সব সত্যি কথা তার বাবাকে বলবে।
এমন সময় আনোয়ার চিৎকার করতে করতে ঘরে ঢোকে। মা নিলু, নিলু তুমি এসেছো মা। কতোদিন দেখি না মা তোমায়। আমার সোনা কেমন আছো তুমি? বলতে বলতে হঠাৎ করেই পড়ে যায় নিলুর বাবা। নিলু দৌড়ে গিয়ে কোনো রকমে ধরে ফেলে তার বাবাকে। মা মেয়ে ধরাধরি করে কোনো রকমে টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যায় নিকটবর্তী সাস্থ্যকেন্দ্রে। প্রাথমিক চিকিৎসায় আনোয়ারের জ্ঞান ফিরলেও ভয় থেকেই যায়। নিলু ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি বলেন এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন। কিন্তু উনাকে একবার শহরে নিয়ে চেকআপ করিয়ে নিন। আমার উনাকে ঠিক মনে হচ্ছে না। নিলু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বাবাকে নিয়ে বাড়ি এলেন।
নিলু ঠিক করে নেয় দ্রুত তার বাবাকে শহরে নিয়ে যাবে। মায়ের সাথে কথা বলে নিলু। কিন্তু এতে তো অনেক টাকার ব্যাপার বলে নিলুর মা। নিলু বলে মা চিন্তা করো না। আগে তো নিয়ে যাই শহরে তারপর দেখা যাবে।
নিলু মাকে যতোই সান্ত্বনা দিক না কেনো ঐ একই চিন্তা নিলুর মস্তিষ্কে ঘুর ঘুর করছে। নিলু এস এস সি ভালো করারই উপবৃত্তি পাচ্ছিলো। কয়েক মাসের উপবৃত্তির টাকাটা তুলেনি। সেখানে কিছু টাকা রয়ে গেছে। সেই টাকার ভরসায় তার বাবাকে শহরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো। ডাক্তার দেখে কয়েকটা টেস্ট দিলো। বললো রিপোর্ট এলেই বলতে পারবো উনার কি হয়েছে। সমস্ত পরীক্ষা করে বাবাকে নিয়ে বাড়িতে। রিপোর্ট পেতে কিছু সময় লাগবে।
আনোয়ারঃ নিলু মা তোমাকে কিছু বলার আছে। আমার কাছে এসে বসো মা।
নিলু হঠাৎ কেঁপে উঠলো। মনে মনে ভাবছে এই মুহূর্তে যদি তার রেজাল্ট নিয়ে প্রশ্ন করে তাহলে কি জবাব দেবে বাবাকে?
২০টি মন্তব্য
নুর হোসেন
আপাতত হাজিরা দিলাম, পড়ে মন্তব্য করতেছি।
সুরাইয়া পারভিন
আচ্ছা আপনার মন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করছি।
নুর হোসেন
নিলু ভাবে কোনো বাবা কি করে তার মেয়েকে এতো ভালোবাসতে পারে? পৃথিবীর সব বাবাই কি এমন হয়! সব বাবারাই কি তাদের সন্তানদের এমন ভালোবাসতে পারেন?
-আসলেই ভাবনার বিষয়, গল্প ভালো জমেছে চলুক।
সুরাইয়া পারভিন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
ছাইরাছ হেলাল
সাথে আছি,
দেখি বাবা এবার মেয়েকে কী বলেন।
সুরাইয়া পারভিন
হুম সেটাই দেখার
সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ অশেষ ভাইয়া
তৌহিদ
এ এক কঠিন সময়, বাবা মা যদি জানতে পারেন নীলুর রেজাল্টের খবর কি হবে? নীলুর জন্য লজ্জাস্করতো বটেই।
ভালো লাগছে লেখা আপু। আপনার সাবলীল লেখাই পাঠকপ্রিয় হবে নিশ্চিত থাকুন। শুভকামনা রইলো।
সুরাইয়া পারভিন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
কৃতজ্ঞতা অশেষ। দোয়া করবেন ❤
তৌহিদ
অবশ্যই, দোয়া রইলো।
কামাল উদ্দিন
কিছু মানুষের জীবনটা সত্যিই এমন কঠিন হয়, কিন্তু জীবন ঠিকই কোন না কোন ভাবে এগিয়ে চলে। গল্পের বাকী অংশ পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম আপু।
সুরাইয়া পারভিন
সুন্দর বলেছেন।সত্যিই তাই
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
কামাল উদ্দিন
আপনাকেও ধন্যবাদ আপু
মনির হোসেন মমি
পুরুষতান্ত্রীক সমাজে নারীদের ধমিয়ে রাখা যেন এখন পানিভাত। তবুও নিলুরা এগিয়ে যায় সব বাধা অতিক্রম করে। দেখা যাক বাবা কী চমৎক দেন। চমৎকার ভাবে লেখা এগুচ্ছে। চলুক।
সুরাইয়া পারভিন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এইতো জীবন,কার যে কখন কি ঘটে যাবে কেউ বলতে পারে না। সুন্দর হচ্ছে আপু
সুরাইয়া পারভিন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন দিদি
জিসান শা ইকরাম
নীলুর মনের অবস্থা সুন্দর ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন,
পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি,
শুভ কামনা।
সুরাইয়া পারভিন
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন ভাইয়া
এস.জেড বাবু
বাবার কাছে সত্যটা বলতে পারা / না পারার দোটানা থাকলো-
শাওনের মতো মানুষের বোধোদয় হয় না/ হবেও না।
নিলুর বাবার জন্য শুভকামনা-
সঞ্জয় মালাকার
বাবার কাছে সত্যটা বলতে পারা / না পারার দোটানা থাকলো –
দেখি বাবা এবার মেয়েকে কী বলেন।
বেশ ভালো লাগলো দিদি।