“লাল” আমার ছেলে,আমার সম্ভ্রম

রোকসানা খন্দকার রুকু ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ১১:৪৪:১৪অপরাহ্ন গল্প ৩১ মন্তব্য
  • "জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ইশ্বর"।

ছোটবেলা থেকেই সবার পড়া একটি কবিতার লাইন।আমাদের শিক্ষকরা শিখিয়েছেন অনেক করে,কিভাবে প্রানিদের উপর মায়া করতে হয়, ভালোবাসতে হয় , পাশে থাকতে হয়।সভ্যতা আর সভ্য জাতির নামে আমরা অনেক অনেকদুর এগিয়ে যাচ্ছি।সাথে অনেক কিছুই ভুলতে বসেছি। তাই আজ  গরুর চোখে মরিচ ঢুকিয়ে নদী পার করছি।খুধার্থ পাহারাদার কুকুরদের,পথরোধ করা হিংস্র  কুকুর বানিয়ে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।যেন বসবাসের যোগ্য শুধু আমরাই।অথচ আল্লাহ মাখলুকের একটিকেও অপ্রয়োজনে বানাননি।

সাল ১৯৭১।দেশে যুদ্ধকালীন ভয়াবহ অবস্থা বিরাজমান।পাকিস্তানি সেনাদের সাথে দেশীয় স্বার্থান্বেসী পান্ডারা যোগ দিয়েছে বিভিন্ন ভাবে।তাঁদের আশ্রয় দিয়েছে নিজের বাড়িতে।খোঁজ দিচ্ছে কোন বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা আছে।কোন বাড়িতে যুবতী সুন্দরী মেয়ে আছে।কোন বাড়িতে সুন্দরী বউ আছে।তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে দিনের পর দিন নির্যাতন করছে।বীরাঙ্গনাদের গল্প পড়লে আজও আমাদের গা শিউরে ওঠে,লোম খাঁড়া হয়ে যায়।কিভাবে তাঁদের বন্দি শিবিরে নির্যাতন করা হয়েছে। এরকমই একটি ঘটনা হয়ত ঘটতে পারত কারও জীবনে।তিনিও খেতাব পেতেন বীরাঙ্গনার। তাঁকে বাঁচিয়েছিল তাঁর ছেলে ‘লাল‘একটি কুকুর।

নুরজাহান খন্দকার। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তখনকার দিনে বারো তের বছর বয়সে বিয়ের নিয়ম থাকায় যুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র এিশ বছর।লম্বা,ফর্সা,স্লিম হওয়ায় তা আরো কম লাগত।তিন ছেলেমেয়ে আর স্বামী সহ সুখের সংসার।বড় ছেলেটি সবেমাত্র ম্যাট্রিক পাস করেছে,মেয়ে ক্লাস টেনে পড়ে আর সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতক শিশু।আর অন্যতম সদস্য ,লাল‘।কুডিয়ে পেয়েছিলেন রাস্তায়।তাঁকে কুকুর বলতে নারাজ তিনি।ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন লালকে।

 

পাশের বাড়িতে আশ্রিত কিছু মানুষ। নিজেদের ‘মুক্তিফৌজ‘ পরিচয় দেয়।আসলে তাঁরা "মুক্তিফৌজ"নামে ডাকাত। তাঁরা দিনের বেলা খোঁজ খবর নেয় কোন বাসায় বড় গরু,ছাগল,ভেড়া আছে।রাতে চলে ডাকাতি।সাথে বাড়ির যুবতী মেয়ে কিংবা মা তাঁদের তুলে নিয়ে যেত।

নুরজাহানের বড় ছেলে ও স্বামী গেছে যুদ্ধে।বাড়িতে মেয়েসহ দিন কাটছে নানা দুশ্চিন্তায়।কখন কোন বিপদ এসে হামলে পড়ে!

কোন এক সকালে পাশের বাড়ির "মুক্তি ফৌজ"এল চাঁদা চাইতে।তিনি সাধ্যমতোই দিলেন।তাতে তাঁদের মন ভরল না,চেয়ে বসল একটা গরু আর একটা খাসি।

নুরজাহান বললেন,বাবা আমার স্বামী ছেলে তো কেউ বাসায় নেই আমি কেমন করে দেই।

অনেক অনুরোধেও তেমন কোন কাজ হললা। তাঁরা মনমতো গরু খাসি ধরে নিয়ে গেল। সন্ধ্যা থেকে চলছে গান বাজনা আর রান্নার মৌ মৌ গন্ধ।খাওয়া দাওয়া শেষ হলে শুরু হয় সুরাপান।তারপর যাঁদের ধরে আনা হয়েছে চলবে তাদের উপর অত্যাচার।

আকাশ বাতাস ভারী হবে তাঁদের আত্মচিৎকারে।দেশীয় দালাল আর পাকিস্তানী হানাদাররা উল্লসিত হবে আদিম নেশায়।

লাল বিকেল থেকেই ভীষন অস্হির।পুকুর পাড়ে যায় আর ঘেউ ঘেউ করে জোরে জোরে। শত্রুদের সাবধান করে ফিরে এসে মায়ের আঁচল টেনে বোঝাতে চায়-

মা আজ আমাদের সমুহ বিপদ।তুমি সাবধান হও,আমার বোনকেও সাবধানে রাখ। আমি তোমার ছেলে বড় অসহায়!কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা।শত্রুরা অনেক শক্তিশালী।তাঁরা তৈরি হচ্ছে রাতের জন্য।

নুরজাহান আজ অনেক অস্হির!কি করবেন ভেবে পাচ্ছেননা। হঠাৎ মাথায় এল বুদ্ধিটা।যেই ভাবা সেই কাজ।ছোট বাচ্চা ও মেয়েসহ শিফট হলেন বাঁশের বেড়া দেয়া ভাঙ্গা চোরা গোলা ঘরটাতে।কারন দুটো।এক,সবাই জানে তিনি কোন ঘরে রাতে ঘুমান।রাতে সেই ঘরটাতেই হামলা হবে।দরজা ভেঙ্গে ভেতরে হায়েনারা ঢুকলে মা-মেয়ে বের হতে পারবেননা।ইটের তৈরি বিল্ডিং থেকে বের হওয়ার উপায় নেই।

দুই, বাঁশের বেড়া দেয়া ঘরের বেড়া ভেঙে তাঁরা সহজেই বেড়িয়ে যেতে পারবে॥

এখন মধ্যরাত।কারো চোখেই ঘুম নেই।দুইসন্তানকে বুকে আঁকড়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছেন কবে এ দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি মিলবে।লাল পুরো বাড়ি পায়চারী করে চিৎকার করে শত্রুকে ভীত করবার চেষ্টা করছে।এখন সে দরজার সামনে কড়া প্রহরায় তাঁর চোখ রক্তলাল,ঘুম নেই।কান খাঁড়া, কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আছে।

তিনটে শব্দ হল বাড়ির বাইরের কোন এক গাছে।মা-মেয়ে একে অপরকে আঁকড়ে ধরল।লাল উচ্চস্বরে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।খটখট করে হেঁটে আসার শব্দ হল।দরজার কাছে আসতেই মনে হল কারও উপর হামলে পড়লো সে। তাঁকে দমনের চেষ্টা করছে কেউ। কিন্তু সে কিছুতেই থামছেনা।দরজা আগলে চিৎকার করেই যাচ্ছে আর শক্ত পোক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।তার মা বোনের সম্ভ্রম বাঁচাতে সে আজ বদ্ধপরিকর।

কেউ বলছে-সর,সর,সরে যা কুকুর।

অন্য কেউ বলছে-দুর মেরে দে।

ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে শব্দ হল। নুরজাহান বুঝতে পারলেন তাঁর লালকে বল্লম দিয়ে হানছে।তিনি মেয়েকে নিয়ে গোলার তলায় ঢুকে পড়লেন।চলে গেলেন ভাঙ্গা বেড়ার কাছে।লাল শত্রুদের সাথে যুদ্ধরত।দু একজনকে কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে।তারা কাউমাউ করে চিল্লাচিল্লি করছে।

এই ফাঁকে বেড়া ভেঙে মা - মেয়ে বেড়িয়ে পড়লেন।দৌড়,দৌড়,দৌড় যেদিকে যাওয়া যায় সেদিকে। তাঁরা দুরে কবরস্থানে  সারারাত অঝোর বৃষ্টিতে ঠকঠক করে কেঁপে রাত কাটালেন। বাড়িতে ছোট্ট শিশু।

লাল একসময় পরাস্ত হল।দরজা খুলে হায়েনারা ভেতরে ঢুকল।কাউকেই পেলনা। ডাকাতি করে বাড়িতে যা ছিল সব নিয়ে গেল।

সকাল বেলা মা- মেয়ে বাড়িতে ফিরে এল।লাল মরে পড়ে আছে।পাশে ছোট্ট শিশু এমন ভাবে ঢেকে আছে কেউ বুঝতেই পারবে না ।লাল তাঁকে আগলেই মরে পড়ে আছে।

হাউমাউ করে এক মায়ের ছেলে হারানোর কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে গেল।লালকে মাটি চাপা দিয়ে তিনি মেয়ে আর শিশু বাচ্চাকে নিয়ে বাবার বাড়ি গেলেন।

বেঁচে থাকার অধিকার জন্মগত। আমাদের উচিত নয় নিজের স্বার্থ আর সুবিধার জন্য কারওটা হরন করা।

ছবি-সংগৃহিত

0 Shares

৩১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ