রমজান মাস মানে সংযমের মাস। দীর্ঘ ত্রিশদিন পানাহার এবং যাবতীয় অপবিত্রতা-মিথ্যাচার-অনৈতিকতা থেকে নিজেকে বিরত রাখার মাস। এর সাথে যুক্ত হয় শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা, যা বরকতময় হিসেবে পরিজ্ঞাত। এখন এগুলোর মানে মোটামুটি জানলে/বুঝলেও খুব ছোটো বেলায় এসবের মানে তেমন একটা বুঝতাম না। তখন রোজার মানে যেটা বুঝতাম তা হলো ফজর আজানের আগে সেহেরি খেয়ে রোজার নিয়ত করে সারাদিন খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখা, আর সন্ধ্যায় ইফতারের আগে নিয়ত পড়ে ইফতারি খাওয়া। এছাড়া সারাদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, তারাবীহ নামাজ আদায় করা। নামাজ কালাম ব্যাতিত রোজার পূর্ণ ফজিলত পাওয়া হয়না। কেমন করে পালণ করতাম সেইসব রোজার দিনগুলো তাই লিখবো...

* ছোট বেলায়: ছোট বেলায় প্রথম রোজা রেখেছিলাম যখন আমার বয়স ৯/১০। এর আগেও রেখেছি, দিনে তিনবার খেয়ে। প্রথম সব কিছুই স্মরণীয় হয়, তাই আমি প্রথম রাখা পূর্ণ রোজাটিকেই গোনায় ধরি। আমাদের ছিলো যৌথ পরিবার। আমার দাদা-দাদী মারা গিয়েছিলেন আব্বার ছোট বেলাতেই। একটা ফুফু ছিলেন, বিয়ের পর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তিনিও মারা গিয়েছিলেন। তাই আব্বা আমাদের নিয়ে নানা-নানির সাথে এক পরিবারে থাকতেন। আমরা আমাদের নানা-নানি, মামা-খালাদের আদর যত্নে বড়ো হয়েছি।

প্রথম রোজা রাখার দিনে অন্যান্য রোজার মাসের মতোই পরিবারের সবার সাথে আমি, আমার ছোট ভাইবোন, মামাতো-খালাতো ভাইবোনেরা সবাই মিলে সেহেরি খেয়েছিলাম। আমাদের পরিবারে ওটাই নিয়ম ছিলো। সেহেরি এবং ইফতারে ছোটদের অবশ্যই সাথে রাখা। সেদিন রোজার নিয়ত করে সেহেরি খেলাম, মার সাথে ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে গেলাম। ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠার পরই দেখি আমার প্রচন্ড ক্ষিধে পেয়ে গেছে। মার কাছে গিয়ে বললাম ক্ষিধে লাগার কথা, মা বললেন

- এটাতো হবেই। রোজার মানেই হলো ক্ষিধে আর তৃষ্ণার কষ্টকে অনুভব করা। তুমি চাইলে খাবার খেয়ে রোজা ভাঙতে পারো।... আমি বললাম ওওও এই কথা! আচ্ছা দেখি তাহলে, কতক্ষণ থাকতে পারি। এটা বলে আমপারা হাতে নিয়ে মসজিদে চলে গেলাম।

আমি ছোটবেলায় আমাদের এলাকার মসজিদে আরবী পড়া শিখতে যেতাম। আমার মা আমার জন্যে বাড়িতে একজন হুজুর রেখেছিলেন, কিন্তু একা একা তার কাছে বসে পড়তে আমার ভালো লাগতো না। তাই এলাকার আমার বয়সি আরও ছেলেমেয়েদের সাথে আমি মসজিদে গিয়ে আরবী পড়া শিখতে যেতাম। এমনিতে প্রতিদিন বিকেলে পড়ানো হতো, কিন্তু রোজার মাসে সকাল-বিকেল দুইবেলা পড়াতো।

মসজিদে যাওয়ার পর হুজুর আমাদের পড়া দিলেন। পড়ার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কে কে রোজা রেখেছি। অনেকের সাথে আমিও হাত তুলে জানালাম, আমি রোজাদার। শুনে হুজুর হেসেছিলেন, আর বললেন রোজাদাররা অল্প হিসেবেই বেহেশতে যায়। তাদের পাপ গুলো রোজার মাধ্যমে কাটাকাটি হয়। আমিতো শুনে মহা খুশি! ভাগ্যিস ক্ষিধের ঠ্যালায় তখন রোজা ভাঙিনি।

বাড়িতে ফিরে খেলাধুলা, এটাসেটা করে দুপুর হলো। তারপর এলো গোছলের টাইম। আমার থেকে একটু বড়ো এক দূর সম্পর্কের খালা থাকতো আমাদের পাশের বাড়িতে। কি মনে করে সেও এলো আমার সাথে গোছল করতে। দুজনেই ঢুকলাম। আমি অজু করে মগ ভরে পানি নিয়ে ঝুপঝাপ করে গায়ে ঢালছি, হটাৎ সে গেলো রেগে। আমার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললো, তুই কি একটু থামবি? আমি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? তোমার গোছল করা শেষ? বললো, না। তারপর সে পানির কলে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে শুরু করলো! আমি বললাম, তোমার তো রোজা ভেঙে গেছে! সে বললো, না ভাঙেনি। গোছলের সময় পানি খেলে রোজা ভাঙে না! চাইলে তুইও খেতে পারিস।

সত্যি বলতে আমার তখন খুব ইচ্ছে করছিলো, আমিও একটু পানি খাই। কিন্তু বাথরুমের কল থেকে পানি খাওয়ার ব্যাপারটা আমার খুব ঘিনঘিনে লাগছিলো। বললাম, থাক খাবো না।

বিকেলে গেলাম আবার মসজিদে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে দেখি, হুজুর আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন, আর মিটিমিটি হাসছেন। এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, এখন কে কে রোজা আছো? আমি শিগগির হাত উঁচু করলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সকালের চেয়ে এখন হাত কমে গেছে! আমার ঐ খালা অবশ্য হাত তুলে ছিলেন।

আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর গোছল করার সময় পানি খেলে কি রোজা থাকে? সে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, না থাকেনা। আমি তখন বেদম খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম, ওয়াও! আমার রোজা ভাঙেনি। এই বলে খালার দিকে তাকিয়ে হাহাহা করে হাসি দিলাম, সাথে বাকিরাও। হুজুর যা বোঝার বুঝে সেও হাসতে লাগলেন। তিনি কখনো শব্দ করে হাসতেন না। অল্প হাসিতেই তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে যেত। আমি মাঝে মাঝে তাকে জিজ্ঞেস করতাম :

- হুজুর, বেহেশতে গিয়ে কি আপনিই আমাদের পড়াবেন?
তিনি হাসিমুখে জবাব দিতেন, আল্লাহ পাক চাইলে সেখানে আমাদের দেখা হবে। তোরা আমার জন্য দোয়া কর, আমিও করি।

আমাদের মসজিদের ঐ হুজুর তখনকার সময় কি জানি একটা চাকরী করতেন। পাশাপাশি মসজিদে আজান দেয়া, ইমামতি করার সাথে সাথে আমাদের পড়াতেন। অত্যন্ত সৎ এবং ইমানদার ব্যাক্তি ছিলেন তিনি। আমাদের মানে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের খুব ভালোবাসতেন। প্রতি ঈদের দিন আমরা নতুন জামাকাপড় পরে তার বাসায় যেতাম। তিনি আমাদেরকে সেমাই খাওয়াতেন, সাথে সবাইকে নতুন দুই টাকার নোট সালামি দিতেন। এখনকার হুজুরদের আমরা যেমন বিলাসবহুল জীবন যাপন করতে দেখি, তিনি মোটেও তেমন ছিলেন না। বরঞ্চ তাকে আমরা দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে দেখেছি। তিনি কতটা ধার্মিক ছিলেন তার উদাহরণ তিনি তার কর্ম এবং পারিবারিক জীবনে দিয়েছেন।

তিনি আজ বেঁচে নেই। বর্তমান সময়ে অনেকেই আমরা বুঝে নিই হুজুর মানেই লোভী, লম্পট, সুবিশাল অ্যাপার্টমেন্ট-ফ্লাটের মালিক বা এলাকার প্রভাবশালী সুদখোর আর মাতালদের দোসর,, তখন এসব হুজুরদের নামে চাইলেও কেউ কুৎসা রটাতে পারতো না। কারণ তাদের সততা, ধর্মভীরুতা আর ঈমানের বলেই তারা সাধারণ সমাজে মাথা উঁচু করে চলতেন। আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করি রাব্বুল আলামীন যেন আমার শিক্ষাদাতাকে বেহেশতের সম্মানিত আসনে জায়গা করে দেন।

যা বলছিলাম, বিকেল চারটায় বাড়ি ফেরার পর আমি ক্ষুধা পিপাসায় একেবারেই আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম। সামনে যা পাবো সব খেয়ে ফেলবো, এমন দশা হয়ে গিয়েছিলো।  আসর নামাজের পর অবস্থা হলো আরও ভয়াবহ। ঐ সময়ে আমাদের বাড়ি সহ আশেপাশের সব বাড়ি থেকে নানারকম ইফতার তৈরীর সুঘ্রাণ আসা শুরু হলো। আমি চুপচাপ আমাদের বাড়ির উঠোনের পেয়ারা গাছের ডাল ধরে ঝুলছিলাম। গাছ ভরা পেয়ারা কিন্তু  খেতে পারিনি। সারাদিন না খেয়ে রাখা রোজাটা ভাঙতে খুব মায়া লাগছিলো।

মা ইফতার বানাচ্ছিলো, আমায় একটি টাকা হাতে দিয়ে বললেন, সময় হয়ে আসছে শিগগির গিয়ে বরফ কিনে আনো। নয়তো শরবত বানাতে দেরি হয়ে যাবে। যদিও ঐ কাজটা বেশিরভাগ দিনে আমার আব্বা করতেন। কিন্তু যেদিন তার অফিস থেকে ফিরতে দেরি হতো, তখন আমি করতাম।

তখন সবার বাড়িতে টিভি কমবেশি থাকলেও ফ্রিজ ছিলো হাতেগোনা কয়েকজনের বাসায়। এছাড়া ধনী-গরীব সবার ভরসা ছিলো কেনা বরফের উপর। এলাকার দারোগা থেকে শুরু করে পান বিক্রেতা, সবাই ইফতারের শরবত তৈরীর জন্যে মোড়ের মাথা থেকে প্রয়োজনীয় বরফ কিনে নিতো। এতে লজ্জার কিছু ছিলো না। যারা বিক্রি করতেন তারাও অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছিলেন। বিভিন্ন ক্রেতাদের চাহিদা মতন বরফের বিশাল খন্ড টাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ধানের তূস আর কঁচু পাতায় মুড়ে বিক্রি করা হতো। ঐসব বিশাল আকারের বরফ খন্ড গুলোর  নাম ছিলো পাহাড়ি বরফ। আমি তখন ভাবতাম, ঐ বরফ গুলো বরফের পাহাড় কেটে আনা হয়!

টুকরো বরফ এনে পরিস্কার পানিতে ধুয়ে লেবু, চিনি, ইসুবগুল, কখনো বা বেল গুলানো পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। ইফতারের ঠিক আগে আগে সেটা গলে গিয়ে শরবত হয়ে যেত শীতল অমৃতের মতো।

বরফ এনে দেয়ার পর মা আমাকে পাঠালেন পাশের বাড়িতে ইফতার দিয়ে আসতে। তখন আশেপাশের বাড়িতে ইফতার পাঠানো অত্যন্ত সামাজিক আনন্দের বিষয় ছিলো। আমার পা যেন আর চলছিলো না, তবুও গিয়ে দিয়ে এলাম। এর মাঝে কতবার যে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম! এমনিতে ঘড়ির কাঁটা যেন ঘুরতোই না। কিন্তু একেকটা কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে এলেই দেখতাম ঘড়ির কাঁটা অনেক দূর এগিয়েছে!

এক সময় চলে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে আজানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ কানে এলো মাগরিবের আজানের সুমধুর ধ্বনি! আকাঙ্ক্ষার আজানের সুর কতো যে মধুর হয় তা সেইদিন উপলব্ধি করেছিলাম। অবশেষে ইফতারের দোয়া পড়ে ইফতার খেয়ে আমার জীবনের প্রথম রোজাটি সম্পূর্ণ হয়েছিলো।

** রোজা রাখা অবস্থায় মা আমাকে এত কাজ কেন দিয়েছিলেন পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম। মা বলেছিলেন রোজার সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হয়। তাহলে রোজার কষ্ট কমে যায়, আর সময়ও দ্রুত পার হয়। আমি এই বড়ো বেলাতে এসে এখন মায়ের কথার প্রকৃত অর্থ বুঝেছি 🙂

 

★ ছোটবেলার স্মৃতিময় রোজার লেখাটা একটু বেশি বড়ো হয়ে গেলো। তাই রোজা-বর্তমানে,লিখবো পরবর্তী পর্বে 🙂

 

* ছবি - নেট থেকে।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ