রেনু

রুমন আশরাফ ২৪ মার্চ ২০২১, বুধবার, ০৮:৫৮:৫২অপরাহ্ন ছোটগল্প ৬ মন্তব্য

মেয়েটিকে দেখেই চিনে ফেললাম। গতকালও ঠিক একই জায়গায় দেখা হয়েছিল। আমার কাছে এসেছিল ফুলের মালা বিক্রি করতে। আমি নিই নি। দুই তিন বার অনুরোধ করার পরেও আমার মন গলাতে পারেনি মেয়েটি। পরনে ছিল ময়লা ছেড়া ফ্রক, পায়ে কম দামী প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। বয়স হয়তো আট নয় হবে। আমি যখন মেয়েটিকে শেষ বারের মতো মানা করে দিলাম, মেয়েটি ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। আশাহত অবয়ব দেখেছিলাম ওর। মালা দিয়ে কি করবো? কাকে দেবো? দেবার মতো যে ছিল সে হয়তো এতদিনে মালা বদল করে ফেলেছে। খবর রাখা হয়নি বিচ্ছেদের পর। ছিন্ন হওয়া মালার বাঁধন নতুন করে বাঁধলে তাতে জোড়া লাগলেও গিটটা থেকে যায়। নয়তো ফুল গুলো সব খুলে নতুন করে সুতোয় গাঁথতে হয়। ম্লান হয়ে যায় তখন ফুলের মালাটি। আমি অম্লান চেয়েছি, ম্লান নয়।

 

মেয়েটি আজও এলো আমার কাছে। আমি সবে মাত্র সিগারেটটি ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছি মুক্ত বাতাসে।

-একটা মালা নেন। ভাল ফুল। মাত্র দশ টেকা।

-নাহ মালা লাগবে না।

 

আজও মানা করলাম। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। অনুরোধের পুনরাবৃত্তি হল না আজ। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সিগারেট ফুঁকা দেখছে মেয়েটি। আমি একটু সরে আসলাম পেছনের দিকে। মেয়েটিও আসলো আমার দিকে। এবারও দেখি আমার সিগারেট ফুঁকা দেখছে। আমি ইতস্তত বোধ করলাম এবার।

 

-কিরে কিছু বলবি?

-সিগারেট খাইলে ক্যান্সার অয়। আপনে জানেন না?

-নাহ জানিনা। তুই ক্যামনে জানোস?

-আমার বাপের ক্যান্সার হইছিল সিগারেট খাইতে খাইতে। পরে মইরা গেছে গা।

 

মেয়েটির শেষ কথাগুলো শুনে আমি আমার অর্ধ সমাপ্ত সিগারেটটি ফেলে দিলাম। জুতোর তলা দিয়ে পিষে নিভিয়ে ফেললাম জ্বলন্ত সিগারেটটি। মেয়েটির চোখদুটো হয়তো অশ্রুসিক্ত হয়েছে। আধো আলো আধো আঁধারে ঠিক বুঝা গেলো না। কিন্তু মনে হল, কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর কণ্ঠনালী কয়েকবার কম্পিত হয়েছে। মেয়েটির প্রতি এবার একটা মায়া জন্মাল। মাথা নিচু করে ওর চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম সোডিয়ামের আলোর প্রতিফলনে ওর চোখদুটো চিকচিক করছে। পাপড়িগুলো ভিজে গেছে লোনা জলে। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম-

-তুই থাকিস কোথায়? তোর মা কোথায়?

-আমি আর মা এক লগে থাকি। কাওরান বাজার বস্তিতে। মায়ে অহন পিঠা বানাইতাসে ঐযে রেললাইনের পাশে। আমার মায়ে খুব ভাল পিঠা বানায়।

-কি নাম তোর?

-আমার নাম রেনু।

-বাহ ফুলের সাথে তোর নামের মিল আছে দেখছি। আচ্ছা তুই ফুলের মালা রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করিস তোর ভয় করে না?

-আগে করতো। অহন আর করে না। আপনে মালা নিবেন না? না নিলে আমি যাইগা তাইলে।

-নিবো মালা। তার আগে চল তোর মায়ের বানানো পিঠা খাই।

-যাইবেন? চলেন তাইলে। ঐযে মায়ে পিঠা বানাইতাছে।

 

মেয়েটির চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দেখতে পেলাম। মায়ের হাতের বানানো পিঠা আমাকে খাওয়াবে ভেবেই তার এই আনন্দ। আমি ওর আনন্দকে নিরানন্দ করতে চাই না। এদিকে বেশ ভাল ক্ষুধাও লেগেছে। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। এখন সন্ধ্যা। প্রায় প্রতিদিনই অফিস শেষে আমি এখানে এসে একাকী কিছুটা সময় কাটাই নিজের মতো। অফিস শেষে চলে আসি এখানে। আজও এলাম।

 

মেয়েটি আগে আগে হাঁটছে আর একটু পরপর পেছনে ফিরে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি ওকে অনুসরণ করছি। মেয়েটির চোখেমুখে এখনও আনন্দের ঝিলিক। আমরা রেললাইন পার হলাম। দুপাশে বস্তি। বস্তির পাশদিয়ে মেয়েটির পিছু পিছু হাঁটছি। অদূরেই দেখলাম এক মহিলা পিঠা বানাচ্ছে। হয়তো এই মহিলাটিই এই মেয়ের মা।

 

-মা দেখো এক মামারে লইয়া আইসি। তোমার হাতের পিঠা খাইব। মালা লইতে কইসিলাম। লয় নাই। কইসে পিঠা খাইব।

ব্যস্ততার মাঝেও ঘোমটা দেয়া মহিলাটি মেয়ের দিকে একবার তাকিয়ে অতঃপর আমার দিকে তাকাল। মহিলাটির দৃষ্টিতে কেমন একটা চেনা-অচেনা ভাব পরিলক্ষিত হল। মহিলাটি নীরব। দৃষ্টিটি তার এখন পিঠার হাঁড়ির দিকে। আমি দোকানের সামনে রাখা নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসলাম। মেয়েটির চোখেমুখে এখনও যেন আনন্দের ঝিলিক লেগে আছে। আমার আশেপাশে বেশ কিছু ক্রেতা পিঠা কেনার অপেক্ষায় আছে। কেউ কেউ আবার ওখানে বসেই পিঠা খাচ্ছে। তাদের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। দুটো চুলায় দুরকম পিঠা বানানো হচ্ছে। একটাতে ভাপা পিঠা আর অন্যটিতে চিতই পিঠা। আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পিঠা বানানো দেখছি। পিঠা বানানোও একটা শিল্প। আমি সেই শিল্প খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি।

 

মেয়েটির মা সদ্য বানানো গরম গরম একটি ভাপা পিঠা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। পিঠা নেবার সময় খেয়াল করলাম মহিলাটি আমার পূর্ব পরিচিত। আমি একটা ধাক্কার মতো খেলাম। এক যুগ পর তাকে দেখলাম। মহিলটি যে আমার রানু আপা।

 

রানু আপা ছোট বেলা থেকেই আমাদের বাসায় থাকতো। মা-বাবা নেই। আমাদের বাড়িতে কাজ করতো আর পাশাপাশি পড়াশুনাও করতো। বয়সে আমার চেয়ে বছর পাঁচেক বড় হবে। পড়াশুনায় খুব একটা মনোযোগী ছিল না। কিন্তু ঘরের কাজে ছিল বেশ পারদর্শী। নিজের বাড়ির মতই থাকতো আমাদের বাড়িতে। আমি তাকে রানু আপা বলেই ডাকতাম। বেশ স্নেহ করতো আমাকে। ও ছিল আমাদের পরিবারের একজন। আমাদের বাড়িতে প্রায় ১০ বছর থাকার আমার বাবা তাকে এক সিকিউরিটি গার্ডের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর আমাদের সাথে যোগাযোগও ছিল বেশ। কিন্তু কর্মব্যস্ততা আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ধীরেধীরে আমাদের সাথে যোগাযোগ কমতে থাকে। একসময় যোগাযোগ একদমই বন্ধ হয়ে যায়। মোবাইল এর যুগ তখনও আসেনি।

 

পুরনো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে পিঠা শেষ করে ফেলেছি খেয়াল নেই। রানু আপা আমার পাতে আরও একটি পিঠা দিলেন। ভাপা পিঠা আমার খুব প্রিয়। এই কথা হয়তো রানু আপা আজও মনে রেখেছে। পিঠা খেতে খেতে আমাদের মধ্যে খানিকটা বাক্যালাপ হল। দুবছর আগে স্বামী হারা হয়। স্বামীর ভিটাও যমুনা গ্রাস করে নিয়েছে। বাঁচার তাগিদে তাই চলে এসেছে এই ঢাকা শহরে। পিঠা বিক্রি করে মা-মেয়ে জীবন চালাচ্ছে। মেয়েটি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে আর পাশাপাশি ফুল বিক্রি করে বাড়তি কিছু আয় করে। তবে শুধু বন্ধের দিনেই ফুল বিক্রি করে।

 

সেদিন আর তেমন বেশী কথা বলা হয়নি আমাদের। দুদিন পর আবার আসবো বলে সেখান থেকে বিদায় নিই। আসার সময় জোর করে কিছু টাকা রানু আপার হাতে গুঁজে দেই। আর রেনুর কাছ থেকে সবগুলো মালা কিনে নিই। এরপর মাথায় হাত বুলিয়ে দেই। আনন্দে রেনুর চোখ ভিজে গেছে।  এমন আনন্দ হয়তো এর আগে কখনও পায়নি। আমাকে বিদায় জানাতেও হয়তো এই বাচ্চা মেয়েটির খুব কষ্ট হচ্ছে। মুখটা কেমন যেন শুকনো করে ফেলেছে। দুদিন আবার আসবো এমন আশ্বস্ত করে আমি বিদায় হলাম। মা-মেয়ে হাত নেড়ে আমাকে বিদায় দিল। হাত নাড়তে নাড়তে রেনু বলে উঠল, “মামা তাড়াতাড়ি আইসো।“

 

পরদিন আমার আর যাওয়া হয়নি। প্রচণ্ড জ্বর এলো। টাইফয়েডের জ্বর। টানা ৮ দিন জ্বরে ভুগলাম। এই আটদিনে রানু আপার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। কাউকে দিয়ে খবরও দেয়াতেও পারিনি। মোবাইল ব্যবহারও তখন এতো বেশী ছিল না। এমনকি আমি নিজেও তখন মোবাইল ব্যবহার শুরু করিনি।

 

জ্বর থেকে সেরে উঠার পর অফিস শেষে রানু আপার বস্তিতে যাই। বস্তির গণ্ডির কাছাকাছি আসতেই সব কেমন যেন অচেনা মনে হল। এদিক অদিক তাকিয়ে ঠিক জায়গায় এলাম কিনা তা নিশ্চিত হবার চেষ্টা করলাম। নাহ জায়গা ঠিকই আছে। কিন্তু বস্তির ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে না। কাছাকাছি একটি ছোট্ট টং দোকান ছিল। দোকানদার জানালো চার/পাঁচ দিন আগে বস্তি উচ্ছেদ করা হয়েছে। রানু আপার কথা জিজ্ঞাস করলাম। কিন্তু কথায় গেছে তা জানাতে পারল না।

 

উক্ত ঘটনার পর আরও বেশ কয়েকদিন ওখানে যাই। ওদের খুঁজি। কিন্তু পাই না। মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করি। কেউ জানেনা।  ওদের না পেয়ে প্রতিবারই মন খারাপ নিয়ে বাড়ি চলে আসি। যতবার ওখানে যাই ছোট্ট রেনুর মুখটি যেন ভেসে আসে।

 

দেখতে দেখতে একযুগ পার হয়ে গেলো। রানু আপার সাথে যোগাযোগের বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজও পাইনি ওদের। এখনও ঐ এলাকায় গেলে এদিক ওদিক তাকাই। যদিও জানি ওখানে রানু আপা নেই। তবুও মনের অজান্তেই খুঁজি। প্রতিবারই মনে হয়, “আজ বুঝি পেয়ে যাব”। কিন্তু পাওয়া হয়নি। এতো বছর পর আজও সেই কথাটি যেন কানে বাজে, “মামা তাড়াতাড়ি আইসো।“ বুকটা তখন কেমন যেন খাঁখাঁ করে। বড্ড জানতে ইচ্ছে করে ওরা কোথায় কেমন আছে।

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ