হাতে সব্জির ব্যাগ নিয়ে চালের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন মিজান সাহেব। সব্জির যে দাম! ছোট্ট এই ব্যাগ ভরতি হতেই তিনশ টাকা চলে গেলো। ভাবা যায়! এখন কিনতে হবে চাল। এক বস্তা মোটা চাল কিনতেও লাগবে হাজার দুয়েক এর মতো। চাল কেনার মতো যথেষ্ট টাকা আছে কিনা নিশ্চিত হবার জন্য মানি ব্যাগ বের করে টাকাগুলো গুনে দেখলেন। যা টাকা আছে তা দিয়ে পুরো এক বস্তা চাল কেনা সম্ভব হবে না। সিদ্ধান্ত নিলেন আধ বস্তা চাল কিনার। এদিকে বাজারে আজ প্রচণ্ড ভিড়। চালের দোকানেও বেশ কিছু ক্রেতা চাল কিনছে।
-“ভাই কিছু লাগবো?” লুঙ্গি আর নীল রঙের গেঞ্জি পরিহিত তরুণ বয়সী এক ছেলে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো।
-“চাল কিনবো। আধা বস্তা চাল লাগবে”।
-“একটু দাঁড়ান। দিতাছি।“
ছেলেটি অতি উৎসাহের সাথে চাল কিনে দেবার জন্য দোকানীর কাছে এগিয়ে গেলো। মিজান সাহেব দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। কিছুক্ষণ বাদে আধা বস্তা চাল সমেত ছেলেটি এসে হাজির হল। মিজান সাহেব চালের দাম পরিশোধ করে আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন। রিকশা নিতে হবে। এদিক ওদিক তাকিয়ে রিকশা খুঁজছেন। হৃষ্টপুষ্ট কোনও রিকশাওয়ালা পেলে ভালো। আসার সময় এক রোগা রিকশাওয়ালার রিকশায় উঠেছিলেন বলে বাজারে আসতে দেরী হয়ে গেছে। আজ আবার অনেক কাজ পরে আছে তার। তরুণ ছেলেটি আবারও এগিয়ে এসে বলল, “স্যারের কি রিকশা লাগবো?” মিজান সাহেব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। ছেলেটি পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে ছুটল রিকশার খোঁজে। যাবার আগে মিজান সাহেব ছেলেটিকে বললেন, “ধুপখোলা যাবো। পাঁচতলায় চালের বস্তা উঠিয়ে দিতে পারবে এমন রিকশাওয়ালা লাগবে।“
কিছুক্ষণ পর ছেলেটি রিকশা নিয়ে দোকানের সামনে চলে আসলো। মোটামুটি নতুন রিকশা। চালকও দেখতে বেশ স্বাস্থ্যবান। মিজান সাহেব রিকশায় চড়লেন। ছেলেটি চালের বস্তাটি রিকশায় উঠিয়ে দিল। মিজান সাহেব কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হাসি মুখে বিশ টাকার একটি নোট ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে দোকান থেকে চলে আসলেন।
যাত্রীসহ রিকশা চলছে। মিজান সাহেব পকেট থেকে বের করে সিগারেট ধরালেন। অনেকক্ষণ ধরে সিগারেট খাওয়া হয়নি।
-“তোমার বাড়ি কোথায় ভাই?”
-“মাদারীপুর”।
-“ঢাকায় কত বছর ধরে আছো? থাকো কোথায়?”
-“তিন বছর হইসে ঢাকায় আইছি। জুরাইন থাকি।“
-“রিকশা কোন জায়গার?”
-“রিকশা আমার নিজের কিনা। কিস্তিতে কিনছি। অনেক বছর ভাড়া চালাইছি। একমাস হইছে কিনছি।“
-“বাহ খুব ভালো। নিজের একটা সম্পদ হল তোমার।“
-“হ ছার। সবই আল্লার ইচ্ছা।“
পাঁচতলা একটি বিল্ডিঙের সামনে এসে রিকশাটি দাঁড়ালো। মিজান সাহেব সবজির ব্যাগ হাতে নিয়ে রিকশা থেকে নামলেন। রিকশাওয়ালা তার গলায় ঝুলানো গামছা দিয়ে ঘেমে যাওয়া মুখমণ্ডল মুছল।
-“যাও একটু কষ্ট করে বস্তাটি পাঁচতলায় একটু উঠিয়ে দিয়ে আসো। আমি এক্সট্রা টাকা দেবো। বয়স হয়ে গেছে ভাই। এখন শরীরে আর কুলায় না। ভারী জিনিস উঠানো নিষেধ আছে আমার।“
-“ব্যাপার না ছার। আমি তুইলা দিমু। পাঁচ তালার কোন পাশে ছার?”
-“সিঁড়ি দিয়া উঠেই ডান পাশের ফ্ল্যাট। সমস্যা নাই। আমি নিচে আছি। তোমার রিকশা আমি দেখবো। তুমি বস্তাটি রেখে নিচে নেমে ভাড়াটা নিয়ে নিও।“
রিকশাওয়ালা চালের বস্তাটি কাঁধে উঠিয়ে হাঁটা শুরু করলো। এই বিল্ডিঙে লিফট নেই। রিকশাওয়ালা একেক তলায় উঠছে আর মনে মনে গুনছে কয় তলায় উঠলো। পাঁচতলায় এসে দেখল ডান বাম পাশ বলে কিছু নেই। একটি মাত্র দরজা ওখানে। রিকশাওয়ালা কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। অবশ্য দরজাটি সিঁড়ির ডান পাশেই রয়েছে। চালের বস্তাটি কাঁধ থেকে মেঝেতে নামিয়ে রেখে সিঁড়ির সাথে লাগানো জানালা দিয়ে নিচে তাকানোর চেষ্টা করলো। পাশের বিল্ডিং এর দেয়াল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রিকশাওয়ালা কিছুটা চিন্তিত মুখে কলিং বেল চাপলো। কিছুক্ষণ পর মধ্যবয়স্কা এক ভদ্র মহিলা দরজা খুললেন।
-“ছারে পাঠাইছে। নিচে দাঁড়াইয়া রইছে ছারে। চাইলের বস্তাটা কই থুমু?”
-“অফিস বাদ দিয়ে এই অসময়ে চাল! কাল বললাম পুরো এক বস্তা কিনতে। কিনে পাঠিয়েছে আধা বস্তা। আজব মানুষ।“
মহিলার কথাগুলো শুনে রিকশাওয়ালা মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। মনে হচ্ছে মহিলার কথাগুলো শুনে সে বেশ আনন্দিত।
চালের বস্তা ভিতরে রেখে সদর দরজার কাছে ফিরে এসে এক গ্লাস পানি চাইলো রিকশাওয়ালা।
-“আমারে এক গ্লাস পানি দিবেন?” ঘাম মুছতে মুছে বলল।
-“দাঁড়াও দিচ্ছি।“
ভদ্র মহিলা পানি এনে দিলেন। রিকশাওয়ালা মেঝেতে বসে তৃপ্তি নিয়ে পানিটুকু পান করে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিচে নামতে থাকল।
-“ওস্তাদ এই সকাল সকাল বড় একটা দাইন মারলেন। এক হাজার টাকার বিনিময়ে পঞ্চাশ হাজার টাকা দামের জিনিস“। রিকশায় চালকের আসনে বসে লুঙ্গি আর নীল গেঞ্জি পরা তরুণটি কথাগুলো বলল।
-“হা হা হা। অনেকদিন পর এতো বড় দাইন মারলাম রে। ওরে যখন চাইলের বস্তা নিয়া পাঁচ তলায় যাইতে কইলাম, তখন একবার ভাবলাম যে কামডা ঠিক মতো করতে পারুম কিনা। তুই লগে লগে আইসস বইলা রিকশা লইয়া চম্পট দিতে পারলাম।“
ওস্তাদ আর সাগরেদ দুজনেই হাসছে। রিকশা চলছে দ্রুত গতিতে ধুপখোলা হতে ধোলাইখালের দিকে………
৭টি মন্তব্য
খাদিজাতুল কুবরা
ধাক্কা খেলাম গল্পটি পড়ে। এই দুর্মূল্যের দিনে সবই সম্ভব!
অপরাধীর ও পেটের টান আছে, তাই রিকসাওয়ালার সর্বস্ব নিয়ে সেও কারো প্রয়োজন মিটিয়েছে।
বনে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায়না।
স্বার্থক ছোটগল্প লিখেছেন।
রিতু জাহান
ওরে আল্লাহ্!
একি কাণ্ড, একেবারে পাশা উল্টায়ে দিলেন!
আহারে বেচারা রিক্সাআলা,,
বেচারা নীচে এসে দেখবে তার রিক্সা নিয়ে চম্পট দিছে ধোকাবাজ পেসেঞ্জার।
গল্পটা শিক্ষনীয়।
ভালো লিখেছেন।
নার্গিস রশিদ
চারদিকে ধোঁকার রাজত্ব । কাউকে বিশ্বাস নাই।
মনির হোসেন মমি
ভন্ডামীতে সব ভরে গেছে।কাউকে বিশ্বাস করা যায়না। চমৎকার গল্প।ম্যাগাজিনের জন্য লেখা দিবে।
নাজমুল আহসান
আরে! চমৎকার লিখেছেন তো!
সৌবর্ণ বাঁধন
চমৎকার হয়েছে গল্পটা।
হালিমা আক্তার
কী মন্তব্য করবো। অবাক হয়ে গেলাম। এমন ভাবে ছিনতাই। ভাবা যায় না। চমৎকার গল্প। শুভ কামনা রইলো।