রাজনৈতিক ভাবনা (প্রথম পর্ব)

অপার্থিব ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ০৫:১৫:০২অপরাহ্ন সমসাময়িক ২৬ মন্তব্য

আপনি মানুন কিংবা না মানুন মূলত তিনটি উপায়ে হাসিনা সরকার পতনের সম্ভাবনা আছে।
১) আর্মি অভ্যুত্থান।
২) তথাকথিত ইসলামী বিপ্লব বা জঙ্গী উত্থান।
৩) নির্বাচন।

হাসিনা সরকারের দীর্ঘ মেয়াদী অস্তিত্ব নির্ভর করছে এই তিনটি সম্ভাব্যতা ঠেকানোর উপর। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক ইতিহাস তাতে আর্মিদের আবার সরাসরি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা কঠিন। এদেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রকৃত গণতন্ত্র থাকুক বা না থাকুক দেশে গণতান্ত্রীক শাসন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে এরকমটি ভাবতে এদেশের মানূষ পছন্দ করে। এদেশের মানুষ রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে বসে রাজনীতি নিয়ে আড্ডা দেয়। কার মিছিলে কত লোক হল তা নিয়ে তর্ক বাঁধায়। ভোটের আগের রাতে ১০০ টাকা পেলেই খুশিতে নাচতে নাচতে ভোট দেয়। ভোটের গুরুত্ব বাঙ্গালীদের কাছে দুই ঈদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। বাঙ্গালীদের কাছে ভোট মানেই গণতন্ত্র, গণতন্ত্র মানেই ভোট। এই ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া এদেশের মানুষ কখনোই মানবে না। গণতন্ত্রহীনতায় আবারো গর্জে উঠবে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হবে বাংলার রাজপথ। ঝরবে রক্ত, জন্ম হবে নুতুন কোন নুর হোসেনের। স্লোগানে বিক্ষোভে আবারো নড়ে উঠবে স্বৈরাচারের ভিত। বাংলার জনগণের এই ভোট তথা ডেমোক্রেসি প্রীতির কথা আর্মিরা জানে তাই ন্যাড়া হয়ে আবার তাদের বেলতলায় না যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যুক্ত হয়ে পাবলিকের গাল মন্দ খাওয়ার চেয়ে তাদের কাছে জাতি সংঘের শান্তি মিশন তুলনামুলক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনারা জাতি সংঘের হয়ে শান্তি বিতরণ করে ডলার ইউরো কামাবেন। অতঃপর ফ্লাট গাড়ি কিনে বউ বাচ্চা নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন পার করবেন। মন্দ কি!!

তথাকথিত ইসলামী বিপ্লব বা জঙ্গী উত্থান সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশেরও প্রধান সমস্যা। পাকিস্থান আফগানিস্থানের পর দক্ষিণ এশিয়ার আরো একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটুক সেটা আমেরিকা কিংবা আঞ্চলিক মোড়ল ভারত কেউই চায় না। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি আন্তজাতিক রাজনীতিতে হাসিনা সরকারের বড় একটি রাজনৈতিক ঘুঁটি। এই ঘুটির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য হাসিনা সরকারকে জঙ্গী দমনে অগ্রাধিকার দিতে হয়। আপনি স্বীকার করেন বা না করেন বাস্তবতা হল জঙ্গীবাদের প্রতি এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের নীরব সমর্থন রয়েছে। তাই জঙ্গী দমন করতে যেয়ে নিজের নামে আগে যাতে ইসলামবিরোধী ট্যাগ না জুটে সেটাও খেয়াল রাখতে হয় আওয়ামী লীগকে। ভোটের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে তাই ব্লগার হত্যার বিচারের চেয়ে ধর্মানুভুতি ঠেকানোই এখন আওয়ামী লীগের কাছে প্রধান প্রায়োরিটি। পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর সহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব ঠেকাতে বাংলাদেশকে পাশে রাখা ভারত ও আমেরিকা উভয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অনুগত হাসিনা সরকার তাই ভারত ও আমেরিকা উভয়ের জন্যই সহায়ক। যদিও চক্ষু লজ্জার খাতিরে বিশ্ব জুড়ে গণতন্ত্রের ফেরি করা আমেরিকার কাছে হাসিনার এক দলীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নয়। তাই হয়তো মাঝে মধ্যে সভা সেমিনারগুলোতে আমেরিকান রাষ্ট্রদুত গণতন্ত্রের সবক দেওয়ার চেষ্টা করেন। ইতমধ্যে নুতুন করে ক্ষমতায় আসার পর চীনের সঙ্গে সোনাদিয়ায় গভীর স্থল বন্দর নির্মাণ সংক্রান্ত চুক্তি স্থগিত করেছে হাসিনা সরকার। বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও বর্তমানে হাসিনা সরকারের অনুকূলে। তেলের দাম গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় আছে। মুল্যস্ফীতিও মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। গার্মেন্টসের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। ওয়ার্ল্ডের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেখানে ৩.৫% সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি এর প্রায় দ্বিগুন। পাশাপাশি নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়াও হাসিনা সরকারকে বড় একটি রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে। তবে হাসিনা সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ নিঃসন্দেহে সম্ভাব্যতা ১ ও সম্ভাব্যতা ২ এর কোঅর্ডিনেশন ঠেকানো অর্থাৎ আর্মিতে যাতে ইসলামী করন না ঘটে সেটা নিশ্চিত করা। আর্মিতে জঙ্গী প্রবেশের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই। সেনাবাহিনীতে গো আজম পুত্রের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হওয়া ও চিটাগং নৌ ঘাটির মসজিদে বোমা হামলায় জড়িত সন্দেহে নৌ বাহিনীর সদস্য অভিযুক্তের ঘটনা নিঃসন্দেহে সতর্ক সংকেত।

এটা অনেকটা নিশ্চিত বলা চলে যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং সেই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রকে নিজের অনুগত রাখাও আওয়ামীলীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সরকারের উন্নয়ন মুলক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনার জন্য গতিশীল আমলাতন্ত্রও জরুরী। এ লক্ষ্যে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী সরকার সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়েছে এবং এটা বলা যায় যে এই ধারা ভবিষ্যতেও অক্ষুন্ন থাকবে। আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে পুলিশ প্রশাসনের ভুমিকাও কম নয়। বিএনপি ও হেফাজতের দুটো বড় আন্দোলনকে কঠোর ভাবে দমন করেছে বাংলার পুলিশ। রাজপথে নামতে না দিয়ে বিএনপির আন্দোলনকে চোরাগুপ্তা পেট্রোল হামলার মধ্যে সীমিত রাখাও পুলিশের বড় সফলতা। এটা একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকেও অনেক বড় রাজনৈতিক সুবিধা এনে দিয়েছে। এর ফলে বিএনপির সাংগঠনিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেছে এবং বিএনপিকে একটি সহিংস রাজনৈতিক দল হিসেবে বহিবিশ্বের কাছে প্রচার করাকেও আওয়ামী লীগের জন্য সহজ হয়েছে। স্বভাবতই পুলিশ এখন আওয়ামী লীগের কাছে তার সফল কাজের পুরষ্কার চাইবে এবং চাইছেও। পুলিশ এখন নিজেদের জন্য ব্যাংক চাইছে, চাইছে বিশ্ববিদ্যালয়, চাইছে নানা রকম আর্থিক প্রণোদনা, ক্ষমতা। আওয়ামী লীগের সেসব না দেওয়ার কোন কারণ নেই। কারণ ভবিষ্যতে বিরোধী আন্দোলন দমন ও নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে তাদের পুলিশের সহায়তা লাগবে। ফলে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সর্ব ক্ষেত্রে পুলিশের কর্তত্ব পরায়ন মনোভাব আরো বাড়বে, বাড়বে ক্ষমতার অপব্যবহার, বাড়বে ক্রসফায়ার। পুলিশের হাতে ব্যাংক কর্মকর্তা নির্যাতন, উল্টো পথে গাড়ি চালিয়ে আশা ইউনিভার্সিটির ছাত্র হত্যার মত ঘটনা দেশে আরো ঘটবে। পুলিশের অনুভূতি আরো তীব্র হবে। কোন পুলিশ ভাইয়ের "পুলিশানুভুতি" আঘাত প্রাপ্ত হলে ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের ঘটনাও ঘটতে পারে। বলা যায় না আমি আপনিও সে মামলার ভুক্তভোগী হতে পারি। রাস্তার বাস ট্রাক আর সিএনজির গায়ে হয়তো নুতুন করে লিখে দিতে হবে -"পুলিশ হইতে একশ হাত দূরে থাকুন"। মোট কথা আপনি চান কিংবা না চান "মাছের রাজা ইলিশ আর মাইনষের রাজা পুলিশ" কথাটা আপনাকে মেনে নিতে হবে।

তাহলে বিএনপির ভবিষ্যৎ কি ? গয়েশ্বরের পর পাতি নেতারা যতই আশাবাদী হন না কেন বাস্তবতা হল আওয়ামী সরকারের অধীনে সংঘটিত হওয়া কোন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপির ক্ষমতায় আসা্র সম্ভাবনা জিরো পারসেন্ট আর আওয়ামী লীগের কাছে ত্বত্তাবধায়ক সরকার চাওয়াটা বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপির জন্য দিবা স্বপ্নও বটে। বিএনপিকে আবার ক্ষমতায় আসতে যেটা লাগবে তা হচ্ছে এক্সটার্নাল ফোর্সের সহায়তা। সেটা হতে পারে আর্মি অথবা হেফাজত টাইপের কোন সেমি জঙ্গী সংগঠন অর্থাৎ ঘুরে ফিরে সেই সম্ভাব্যতা ১ ও সম্ভাব্যতা ২। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরী করা যাতে পরোক্ষ ভাবে হলেও আর্মি আবার ক্ষমতা কাঠামোয় নুতুন করে যুক্ত হয়। অতীত ইতিহাস বলছে বিএনপি এ থেকে রাজনৈতিক সুবিধা পেতে পারে যেমনটা আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২০০৮-০৯ সালের ফখরু-মইন সরকারের কাছ থেকে। এমনকি হেফাজতী শফি বিপ্লব থেকেও রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হতে পারে বি এন পি। এক্সটার্নাল ফোর্সের সহায়তা না পেলে ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর আস্তে আস্তে বিএনপি তার রাজনৈতিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে। এর সঙ্গে অবশ্য আরো একটি ইম্পরট্যান্ট ফ্যাক্টর জড়িত তা হচ্ছে খালেদার মৃত্যু। খালেদার মৃত্যু আদর্শবিহীন রাজনীতি করা বিএনপির রাজনৈতিক কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিবে। বিএনপির থিংক ট্যাঙ্ক হয়তো তারেক পত্নী ডাঃ জোবায়দাকে দিয়ে রাজনীতিতে খালেদার গ্লামারাস অবস্থান পূরণের চেষ্টা করবে (তারেকের দেশে ফেরা তখনও অনিশ্চিত থাকবে)। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সফল নারী রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত দুটো জিনিসের অন্তত একটি থাকা প্রয়োজন। এক- বাপ কিংবা জামাই পরিচয়, দুই- গ্লামার। সংসদের ষ্পিকার আর ছাত্র জীবনে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্টের অধিকারিনী হওয়া স্বত্তেও গ্লামারের অভাবে শিরীন শারমীন চৌধুরী এমপি নির্বাচনে নমিনেশন পান না। আবার গ্লামারের বদৌলতে নির্বাচিত এমপি না হয়েও মন্ত্রী হয় তারানা হালিম। সাহারার বাপ-জামাই পরিচয় কিংবা গ্লামার কিছুই ছিল না। সাহারার মন্ত্রীত্ব টেকেনি, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও অস্তাচলের পথে। আমরা ভুলে গেছি একদা কোন এক কালে সাহারা খাতুন নামে বাংলাদেশের এক মন্ত্রী ছিলেন। কাজেই গ্লামারের বদৌলতে জোবায়দাকে নিয়ে বিএনপির থিংক ট্যাঙ্ক আশাবাদী হতেই পারে। তবে রাজনীতিতে খালেদার শুন্যস্থান ও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপির ক্ষয়িষ্ণু অবস্থান জোবায়দা কতটা পুনরুদ্ধার করতে পারবেন সেটা সময়ই বলবে। (চলবে)

sdf

0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ