রঙধনু আকাশ (২৫তম ও শেষ পর্ব)

ইঞ্জা ২০ নভেম্বর ২০২০, শুক্রবার, ০৮:০৫:৪৩অপরাহ্ন গল্প ২২ মন্তব্য

রুদ্রর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, ওর মুখে কোনো রা নেই, যেনো বাকশক্তি হারিয়েছে ও।

রুদ্রর মা ওর অবস্থা দেখে কান্না করে দিলেন, জড়িয়ে ধরে বললেন, রুদ্র বাপ তুই এই সব শুনিস না, এইসব মিথ্যা কথা, আমি তোর মা, রুদ্র তুই কথা বল বাবা, বলেই হু হু করে কান্না করতে লাগলেন। 

অনিলাও পাশে বসে রুদ্রকে স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে ওরও। 

মম তুমি ওকে ছাড়ো, সত্য কখনো চাপা পড়ে থাকেনা, নীল বললো।

তুই চুপ কর, বেশি কথা বলবিনা, রুদ্রর মা ফুঁসে উঠলেন। 

নীল আরও ক্ষেপে গেলো, না আমি চুপ থাকবোনা, ওর আর কিছুই নেই এখানে, যেমন ওকে আস্তাকুঁড়ে থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলে, তেমনই আজ আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ হলো, অনেক বাড় বেড়েছিলো ও, ভেবেছিলো সকল সম্পত্তির মালিক ও, অফিসের এমডি সেজে বসেছিলো।

রুদ্রর মা উঠে গিয়ে কষে এক থাপ্পড় মারলেন নীলকে। 

নীল উল্টো ওর মাকে ধাক্কা দিলো, উনি তাল সামলাতে না পেরে রুদ্রের সামনে এসে পড়লেন।

রুদ্র উঠে ওর মাকে উঠিয়ে নিলো। 

রুদ্রর মা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে নীলকে বললেন, ও আমারই রক্তের, ও আমার ভাইয়ের ছেলে। 

তো কি হয়েছে, তুমি ওকে কিছুই দিতে পারবেনা, যদি দাও তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু।

 

রুদ্র মাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নীলের সামনাসামনি দাঁড়ালো, রেনু অবস্থা আঁচ করে নীলের পাশে দাঁড়ালো।

ভাইয়া, এমডি আমি হতে চাইনি, মম, ভাবী মিলে এই দ্বায়িত্ব দিয়েছিলো, রুদ্র এগিয়ে গিয়ে দরজার পাশে রাখা ডেস্ক টেবিল থেকে মোটা ফাইলটা এনে নীলের হাতে দিয়ে বললো, আমি কখনো চাইনি তোমার স্থান নিতে, আজ আমি পদত্যাগ করে সব কাগজপত্র এইখানে দিয়ে দিলাম। 

বাহ ন্যাকামো হচ্ছে, RR টেক্সটাইল মিলটা তাহলে তোর নামে হলো কেমনে? 

ও আমার নামে নয়, ও ভাবী আর রুহির নামে। 

বেশ বেশ, তাহলে আর দেরি কেন, এখনই বেড়িয়ে যা এ বাসা থেকে। 

নীল কি বলছিস, ও বেরুতে যাবে কেন, রুদ্রের মা চিৎকার করে উঠলেন। 

শাটআপ, তুমি কোনো কথা বলবেনা, এ সম্পত্তিতে ওর কোনো হক নেই, এই তুই বের হ এই বাসা থেকে, রুদ্রকে একটা ধাক্কা দিলো নীল। 

রুদ্রের মা আবার এগিয়ে এলেন নীলের সামনে। 

খবরদার মম, তুমি আমার গায়ে আবার হাত তুললে আমি ভুলে যাবো যে তুমি আমার মা, রেনু উনাকে এইখান থেকে নিয়ে যাও। 

রেনু এগিয়ে গিয়ে রুদ্রর মার হাত ধরে বললো, মম চলুন আপনার রুমে। 

না আমি যাবোনা, এ বাসা আমার, রুদ্রও থাকবে এইখানে, এক ঝটকায় রেনুর হাত ছাড়িয়ে নিলো। 

 

খবরদার, তুমি এই ভুল করোনা, তাহলে তুমি আমার অন্য রূপ দেখতে পাবে, এই তুই বের হ এইখান থেকে, বলেই আরেক ধাক্কা দিলো রুদ্রকে। 

রুদ্র হাত দিয়ে ধাক্কাটা এড়িয়ে বললো, ভাইয়া তুমি এমন করছো কেন, তুমি চাওনা যখন আমি কেন থাকবো?

ঠিক আছে আমি চলে যাবো, তার আগে আমি মমের সাথে কথা বলে যায়। 

নাহ তুই আমার মার সাথে কথা বলতে পারবিনা, তুই বেড়িয়ে যা এইখান থেকে।

না আমি মমের সাথে কথা না বলে যাবোনা। 

কি বললি তুই, বলেই নীল এগিয়ে এলো রুদ্রকে মারতে, হাত তুলতেই রুদ্র হাতটা খপ করে ধরে বলে মোচড় দিয়ে ধরলো। 

ওহ মাগো, এই ছাড় আমাকে, নাহলে খারাপ হবে বলে দিচ্ছি, বলেই কঁকিয়ে উঠলো নীল। 

রেনুকে এগিয়ে আসতে দেখে রুদ্র বললো, না ভাবী তুমি এসোনা, আমি তোমাকে অসম্মান করতে চাইনা। 

রেনু থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। 

মম এদিক আসো, রুদ্রর মা এগিয়ে এলে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলো, বললো তুমিই আমার মম, তুমি আমাকে জন্ম দাওনি কে বলেছে। 

রুদ্রর মা হুহু করে কেঁদে উঠে বললেন, তুই যাসনে বাবা। 

না মম, এইখানে আমার আর কিছুই নেই, ভালো থেকো তুমি, দোয়া করো আমাদের জন্য, নীলকে ছেড়ে দিয়ে বললো অনিলা চলো। 

 

কাপড়চোপড় নেবেনা, অনিলা জিজ্ঞেস করলো।

না ওগুলো আমাদের নয়, চলে এসো। 

অনিলা হু হু করে কেঁদে দিলো, ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে রুদ্রর মাকে কদমবুচি করলো। 

রুদ্রর মা জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন, অনিলাও কাঁদছে, তা দেখে রেনু মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। 

রুদ্র এগিয়ে গিয়ে অনিলার হাত ধরলে অনিলা রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। 

চলো বলেই অনিলাকে নিয়ে দরজার দিকে এগুতে লাগলো রুদ্র। 

বাবা যাসনে তুই, তুই চলে গেলে আমি থাকবো কি করে? 

রুদ্র একবার ফিরে তাকালো, এরপর অনিলাকে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো ধীর পায়ে, বাসা থেকে বেরুতেই দেখলো কাজের লোক, গার্ড, ড্রাইভার সবাই দাঁড়িয়ে আছে, সবার চোখে জল। 

তোমরা মাকে দেখে রেখো আর আমাদের জন্য দোয়া করো। 

ওরা সবাই রুদ্র অনিলাকে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।

গেইট দিয়ে বেড়িয়ে দুজনেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো। 

কই যাবে এখন, অনিলা জিজ্ঞেস করলো। 

জানিনা। 

তাহলে বাবার কাছে যায়। 

রুদ্র বড় এক নিশ্বাস ফেলে বললো, চলো। 

 

আফতাবনগরে রিক্সা এসে দাঁড়ালে অনিলা নেমে এসে তাকালো রুদ্রের দিকে, রুদ্র তখন হারিয়ে আছে নিজ অতীতে৷ 

রুদ্র আমরা এসে গেছি। 

রুদ্র চমকে উঠে ফিরে তাকালো, এরপর বড় এক নিশ্বাস ফেলে নেমে এলো রিক্সা থেকে, পাঞ্জাবি হাতড়ে দুইশো টাকা রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে অনিলাকে নিয়ে এগুলো।  

রুদ্র আর অনিলাকে দেখে সুলতান সাহেব বললেন, আরেহ তোমরা, একটা খবর দিলেনা? 

অনিলা বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো। 

কি ব্যাপার মা, কি হয়েছে, রুদ্র কি হয়েছে, আচ্ছা আগে ভিতরে আসো।

ওদেরকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে সব ঘটনা শুনলেন সুলতান সাহেব, শুনে বললেন, তোদের বিয়ের সময়ই ভাবী সাহেবা আমাকে সব খুলে বলেছিলেন। 

একটু দম নিয়ে বললেন, আসলে তুমি ভাবী সাহেবার ভাইয়ের একমাত্র ছেলে, তোমার বাবা মা কার এক্সিডেন্টে ইন্তেকাল করলে তোমার মম তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন, যদিও তোমার ড্যাডের ইচ্ছা ছিলোনা কিন্তু তোমার মমের কারণে উনি বাধা দিতে পারেননি। 

রুদ্রর গাল দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

এই দুই সপ্তাহ আগে ভাবী সাহেবার সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো, বললেন তুমি তোমার অজান্তেই তোমার বাবা মার কবর জিয়ারত করো। 

ও দুটো কবর আমার বাবা মার। 

হাঁ বাবা। 

 

দশ বছর পরঃ

 

রুদ্র অনিলা এখন অস্ট্রেলিয়ার পার্থে থাকে, দুজনই চাকরি করে, রুদ্র এএনজেড ব্যাংকের পার্থ সিটি ব্রাঞ্চের এক্সজিকিউটিভ ম্যানেজার, অনিলা এক করপোরেট কোম্পানিতে উঁচু পদে চাকরি করে।

ওদের সংসারে আরেকজন যোগ হয়েছে, সাত বছরের রিয়া, রুদ্র অনিলার এক মাত্র সন্তান। 

রবিবার বলে রুদ্র ডুপ্লেক্স বাড়িটার উপর তলায় কাজ করছিলো, সাথে অনিলাও হেল্প করছিলো রিয়ার নতুন রুমটা সাজাতে। 

কলিংবেলের শব্দ শুনে রুদ্র বললো, অনু দেখো তো কে এলো, নাহ রিয়াকে বলো দেখতে, তুমি বেডটা এসে ধরো।

অনিলা উপরে সিঁড়ির পাশে গিয়ে বললো, রিয়া চেক দ্যা ডোর।

ইয়েস মম। 

কিছুক্ষণ পর রিয়া ডাক দিয়ে বললো, ড্যাড ইউ হ্যাভ আ ভিজিটর। 

রুদ্র হাতের কাজ ছেড়ে বললো, এ সময় কে আসবে, চলো তো দেখি, তুমি গিয়ে দরজা খুলো, আমি আসছি বলেই রুদ্র লাস্ট স্ট্রিপটা লাগিয়ে নিচে নেমে আসতে লাগলো, লাস্ট দুই তিন সিঁড়িতে থাকতে দেখলো, দরজায় পনেরো, ষোলো বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে, নিচে নেমে এসে জিজ্ঞেস করলো, ইয়েস হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ। 

মেয়েটা দ্রুত এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো, চাচু আব্বি। 

রুদ্র থমকে গেলো, কাঁপতে কাঁপতে মাথায় হাত দিয়ে বললো, রুহি, চোখ গেলো দরজার দিকে, অনিলার হাত ধরে ওর মা প্রবেশ করছে। 

রুদ্র রুহিকে ছেড়ে ওর মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো, কাঁপতে কাঁপতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে জড়িয়ে ধরলো ওর মার পা৷ 

 

কিছুক্ষণ পরে ওরা সবাই বসে আছে ড্রয়িংরুমে, রিয়া অবাক হয়ে দেখছে সবাইকে, রুদ্র ওকে কাছে আসতে বলে বললো, সি ইজ ইউর গ্রান্ড মম, কাম ডিয়ার। 

রিয়া এগিয়ে গেলো ওর দাদীর কাছে, রুদ্রর মা জড়িয়ে ধরলেন রিয়াকে, কপালে চুমু খেলেন। 

মম তুমি কিভাবে জানলে আমি এখানে, ভাইয়ারা জানে তোমরা এসেছো এখানে? 

রুদ্রর মার চোখ ছলছল করে উঠলো, তিন বছর আগে নীল আর রেনু কার এক্সিডেন্টে মারা গেছে। 

রুদ্র শকড হলো, কি বলছো মম, ভাইয়া ভাবী নেই? 

না, আমি আর রুহি আছি ঘরে, সুমীর বিয়ে হয়েছে, ছেলে ওর সাথেই পড়তো। 

অনিলাও হতবাক হয়ে শুনছিলো ওদের কথা। 

সুলতান ভাইকে অনেক অনুরোধ করে তোদের ঠিকানা নিলাম। 

ভালো করেছো, অনু তুমি মম আর রুহিকে উপরের রুমে দাও আর খাবার দাবারের ব্যবস্থা করো। 

চাচ্চু আব্বি, আমি তোমাদের নিয়ে যেতে এসেছি, রুহির কথা শুনে রুদ্র ফিরে তাকালো। 

না মা তা আর হয়না। 

আমার বাবা মা নেই, তুমি ছাড়া আমাদের কেউ নেই, আমি কি রিয়ার বোন নই, তোমার সন্তান নই? 

রুদ্রর চোখ গড়িয়ে জল বেরুলো। 

 

সমাপ্ত। 

ছবিঃ গুগল।

জনস্বার্থেঃ

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ