রঙধনু আকাশ (২০তম পর্ব)

ইঞ্জা ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ১২:২২:৩৯অপরাহ্ন গল্প ২৭ মন্তব্য

কয়েকদিন পরঃ

প্রায় সাত ঘন্টা লাগলো নীলের অপারেশনের, ডাক্তার এসে জানালো অপারেশন ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে, চিন্তার কিছুই নেই, আপাতত নীলকে অপারেশন থিয়েটারের পাশের আইসিইউতে রাখা হবে, দুইদিন পর সব ঠিকঠাক থাকলে বেডে দেওয়া হবে। 

রুদ্ররা সবাই করিডোর দিয়ে সামনের আইসিউর দিকে এগিয়ে গেলো, গ্লাস দেওয়া এ পাশ থেকে আইসিইউর ভিতরে সব দেখা যায়, নীলকে এখনো আনা হয়নি। 

রুদ্ররা সবাই ওয়েটিংরুমের দিকে এগুলো, সেখানেই বসার জায়গা রাখা হয়েছে।

নীল ঠিক হয়ে যাবে তো, উদ্বীগ্ন মা জিজ্ঞেস করলেন। 

নিশ্চয় মম, এই হাসপাতাল হলো বিশ্বের নামকরা হাসপাতাল, তুমি চিন্তা করোনা। 

অপরদিকে রেনুর অবস্থা বেহাল, চোখে তো যেন জলের বান লেগেছে, অনিলা ভাবীকে সামাল দিচ্ছে। 

রুদ্রর ফোনে রিং হচ্ছে দেখে রিসিভ করে হ্যালো বললো। 

ভাইয়া, বড় ভাইয়ার কি খবর? 

অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে, আগামী দুইদিন আইসিইউতে রাখবে, পরে বেডে দেবে, রুহি কই?

খেলছে ও। 

রুহিকে দেখভাল করার জন্য সুমি বাসায় রয়ে গেছে। 

তোমরা কখন আসবে? 

ভাইয়াকে আইসিইউতে আনলেই চলে আসবো। 

আচ্ছা ভাইয়া, রাখছি।

ওকে বাই। 

 

রুদ্র গিয়ে একবার দেখে আসলো নীলকে আনা হয়েছে কিনা, ওয়েটিংরুমে এসে সবাইকে জানালো নীলকে এখনো আনা হয়নি, সবার নিশ্চয় ক্ষুদা পেয়েছে রুদ্র ভেবে রুদ্র নিজে বেরিয়ে গেলো, সামনের ডেস্কে খবর নিলো ক্যান্টিন কোথায়, জেনে নিয়ে লিফটে উঠে টপ ফ্লোরে উঠে এলো, ক্যান্টিন থেকে সবার জন্য ক্লাব স্যান্ডউইচ, পানি আর পেপসির ক্যান নিয়ে নিচে চলে এলো। 

কই ছিলি এতক্ষণ, রুদ্রর মা জিজ্ঞেস করলেন। 

মম কিছু খাবার নিয়ে আসলাম, সবার নিশ্চয় ক্ষুদা লেগেছে, সব ওর মার কাছে দিয়ে বললো, নাও সবাইকে দাও, তুমিও খাও। 

তুই খেয়েছিস? 

না মম, এখানেই আছে, আগে সবাইকে দাও। 

রুদ্রর মা প্রথমে রেনুকে দিলো, রেনু খেতে না চাইলেও জোর করে দিয়ে বললেন, নীল ঠিক হয়ে যাবে মা, তুই খেয়ে নে।

এরপর অনিলা, রুদ্রকে দিয়ে নিজেও নিয়ে খেতে শুরু করলেন। 

খাওয়া শেষ হলে রুদ্র সব প্যাকেট আর খালি ক্যান গুলো নিয়ে ডাস্টবিনে রেখে এলো, এরপর আবার এগিয়ে গেলো নীলের খবর নিতে, গ্লাস দেওয়া রুমের ওপাশে নীলকে আনা হচ্ছে দেখে রুদ্র দ্রুত ফিরে এলো ওয়েটিংরুমে, সবাইকে নিয়ে ফিরে এলো আইসিইউর পাশে।

 

নীলকে শুয়ে দেওয়া হয়েছে বেডে, পুরা মাথাটায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, হাতে বিভিন্ন মেশিনের তার গুলো লাগানো হচ্ছে, হাতে আগে থেকেই স্যালাইন লাগানো আছে, এখন নতুন করে রক্তের ব্যাগ লাগানো হচ্ছে, আজ সকালেই রুদ্র রক্ত দিয়েছে নীলের জন্য। 

কিছুক্ষণ সেখানে নীলকে দেখে সবাই ফিরে এলো ওয়েটিংরুমে। 

মম তাহলে চলো আজ বাসায় যায়, রুদ্র বললো। 

আমি যাবোনা, তোমরা মমকে নিয়ে বাসায় ফিরে যাও।

রুদ্র রেনুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো, ভাবী এইখানে কাউকে থাকতে দেবেনা, তুমি কিভাবে থাকবে? 

আমি একা থাকলে নিশ্চয় না করবেনা ওরা। 

আমি নিজেই থাকতাম, রিসেপশনেই ওরা বলে দিয়েছে এইখানে কেউ থাকার দরকার নেই এবং তা নীতি বিরুদ্ধ , এছাড়া এরা রুগীদের সুযোগ সুবিধা নিজেরাই নিশ্চিত করে, আমরা আবার আগামীকাল আসবো, চলো আজকে। 

অনিচ্ছা সত্বেও রেনু সবার সাথে বেরিয়ে এলো ওয়েটিংরুম থেকে, সে সময় এক রুগীকে স্ট্রেচারে করে আনছে দেখে ওরা সরে দাঁড়ালে স্ট্রেচারটা ওদের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো, পুরা শরীর কভার করা শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে। 

অনিলা ছাড়া বাকি সবাই অবাক হয়ে দেখলো স্ট্রেচারের রুগীটা আর কেউ নয় শেলি, স্ট্রেচারের পিছনে শেলির বাবা। 

রুদ্রকে দেখে উনি অবাক হলেও নিজেকে ধরে রাখতে পারলেননা, হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে রুদ্রকে জড়িয়ে ধরলেন। 

 

শেলিকে অপারেশনের জন্য ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, রুদ্র শেলির বাবাকে ধরে ওয়েটিংরুমে নিয়ে গিয়ে বসালো, রুদ্রর মা পানির বোতল বাড়িয়ে দিলে রুদ্র ঢাকনা খুলে দিলো শেলির বাবাকে, পানির বোতলটা নিয়ে উনি ঢকঢক করে পুরো পানি সব খেলেন।

আংকেল শেলির কি হয়েছে? 

বাবারে ওরে আমার পাপেই শেষ করেছে। 

আংকে একটু শান্ত হোন, খুলে বলুন কি হয়েছে? 

শেলির বাবা বড় এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলেন, গত পনেরোদিন আগে চট্টগ্রামের নামকরা এক ফ্যামিলির ছেলের সাথে শেলির বিয়ে হয়, ছেলে আমেরিকা প্রবাসী, বিয়ের কিছুদিন পরেই শেলি সহ ওর বর চলে আসে আমেরিকায়, এরপর ছেলেটির আসল রূপ বেড়িয়ে আসে, ও আগেও বিয়ে করেছিলো, বউকে মারধরের কারণে ওকে পুলিশ এরেস্ট করে, একি ভাবে শেলিকেও মারধর করতে শুরু করে সে, আমি পরশুদিন আসি সব খবর শুনে, শেলি নিষেধ করে ওর বাসায় না উঠার জন্য, আজ বিকালে পুলিশ কল করে আমাকে যে শেলিকে পোড়া অবস্থায় উদ্ধার করেছে ওরা। 

শেলির বাবা দম নিলেন, রুদ্র, ভাবী, আপনারা আমাকে, আমার মেয়েকে মাফ করে দিন, ও এখন জীবনমৃত্যুর মাঝে আছে, বলেই উনি কাঁদতে শুরু করলেন। 

আংকেল ছেলেটির নাম কি, অনিলা জিজ্ঞেস করলো।

ওর ডাক নাম অপু। 

অনিলা শিউরে উঠলো। 

 

আংকেল কিছু খেয়েছেন সারাদিন? 

না বাবা। 

মম তোমরা থাকো, আমি আসছি। 

আমি যাচ্ছি তোমার সাথে, অনিলা বললো। 

আচ্ছা আসো।

দুজনই ক্যান্টিনে চলে এলে অনিলা বললো, উনি উনার মেয়েকে কার সাথে বিয়ে দিয়েছেন জানো? 

না, কার সাথে? 

অপু, যার সাথে আমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো। 

রুদ্র মাথায় হাত দিয়ে বললো, ওহ গড, সেই ছেলেটি? 

হাঁ, আমার এখনো ভয় লাগছে রুদ্র, আজকে মেয়েটার বদলে আমিই থাকতাম এই স্ট্রেচারে। 

রাখে আল্লাহ মারে কে, আচ্ছা চলো উনার জন্য কিছু কিনে নিই, বলেই রুদ্র কাউন্টারের উদ্দেশ্যে, ওখান থেকে দুইটা স্যান্ডউইচ, ডায়েট পেপসি আর পানি নিয়ে অনিলার কাছে, ফিরে এসে বললো, চলো।

নিচে এসে দেখলো শেলির বাবা অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন, রুদ্র এগিয়ে গিয়ে উনাকে ওয়েটিংরুমে নিয়ে আসলো। 

স্যান্ডউইচ খেতে খেতে উনি অনিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটা কে বাবা? 

রুদ্রর মা জবাব দিলেন, ও রুদ্রর বউ। 

তাই, রুদ্র কবে বিয়ে করলো? 

আজ প্রায় বিশ দিন হয়।

খুব খুশি হলাম বাবা, দোয়া করি যেন তোমরা সুখে থাকো, বলতে বলতে উনি কাঁদতে লাগলেন।

 

শেলির বাবাকে স্বান্তনা দিয়ে রুদ্ররা আগামীকাল আবার আসবে বলে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে, রুদ্র রেন্টে কার থেকে  একটা কার ভাড়া করেছিলো কয়েক দিনের জন্য, রুদ্রই ড্রাইভিং করছে। 

অনিলা বললো, কি ভয়ংকর, এই অপুকে কি পুলিশ খুঁজে পাবে? 

যতদূর জানি ও এই দেশ থেকে পালানো টাফ হবে, ওকে পুলিশ এরেস্ট করতে বেশি সময় লাগবেনা। 

কোন অপুর কথা বলছিস, শেলির হাসবেন্ড? 

মম তুমি জানোনা, এই সেই অপু যার সাথে অনিলার বিয়ে হতে যাচ্ছিলো। 

রুদ্রর মা মুখে হাত দিয়ে দিলেন, কি বলছিস সেই ছেলেটির সাথে শেলির বিয়ে হলো? 

মম বিষয়টা দুঃখজনক, সত্যি উনাদের জন্য কষ্ট হচ্ছে। 

মম কোন অপুর কথা বলছেন, রেনু জিজ্ঞেস করলো। 

অনিলায় সব খুলে বললো ওর বিয়ে ভাঙ্গা, রুদ্রর সাথে বিয়ে কিভাবে হলো সব। 

হায় হায় সেই ছেলেটায়, আসলে কি বলবো, শেলির বাবা যে স্বার্থপর মানুষ, আমরা দৈউলিয়া হয়ে গেছি মনে করে বিয়েটা ভেঙ্গে দিলো।

কার বিয়ে ভাবী, অনিলা জিজ্ঞেস করলো। 

কার সাথে আবার, রুদ্রর সাথে ড্যাড বিয়ে ঠিক করেছিলেন, ড্যাডের ইন্তেকালের পর উনি মনে করলেন আমরা শেষ হয়ে গিয়েছি, লোন শোধ করতে পারব্যনা, এ জন্য উনি বিয়ে ভেঙ্গে দেন। 

 

রুদ্ররা বাসায় ফিরে চেইঞ্জ করে ফ্রেস হয়ে এলো ড্রয়িংরুমে, রুদ্র টিভি ছেড়ে নিউজ দেখতে লাগলো, রুদ্রর মাও এসে বসলেন পাশে, অনিলা রান্নায় হেল্প করছে রেনুকে। 

নীল কতোদিনে ঠিক হয়ে যাবে ডাক্তাররা কিছু বলেছে, রুদ্রর মা জিজ্ঞেস করলেন।

ভাবীকেই তো ডাক্তাররা বললো অপারেশনের পর ছয় সাত মাস লাগতে পারে, অবশ্য এ বেশি কিছু নয় মম, হয়তো অপারেশনটা বড় হলেও রোগটা ছোটো, তুমি চিন্তা করোনা মম। 

শেলি কি বাঁঁচবে? 

ফোরটি পারসেন্ট বার্ণ, এইখানকার চিকিৎসা ভালো, আশা করছি ঠিক হয়ে যাবে।

মেয়েটির জন্য কষ্ট হচ্ছে।

হাঁ মম। 

অনিলা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে সবাইকে খেতে ডাকলে রুদ্ররা উঠে পড়লো, খাবার টেবিলে বসে সবাই চুপচাপ খাচ্ছে, রুহি যথারীতি অনিলার কোলে বসে খাচ্ছে। 

সুমিই নীরাবতা ভাঙ্গলো, ভাইয়া আগামীকাল আমার ইউনিভার্সিটি নেই, আমিও হাসপাতালে যাবো।

আচ্ছা যাস, পরক্ষণেই বললো, ওখানে তো রুহিকে নিয়ে যাওয়া যাবেনা, তাহলে কে থাকবে রুহিকে নিয়ে? 

অনিলা বলে উঠলো, চিন্তা করোনা, আমিই থাকবো রুহিকে নিয়ে।

 

...... চলবে। 

ছবিঃ কালেক্টেড।

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ