রঙধনু আকাশ (১৭তম পর্ব)

ইঞ্জা ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ০৭:২৮:৪৫অপরাহ্ন গল্প ২৫ মন্তব্য

ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে রুদ্র ডাক দিলো, মম আসোনা।

আসছি বাবা, তোরা শুরু কর।

অনিলা রুদ্রর প্লেটে ভেজিটেবল আর রুচি তুলে দিলে রুদ্রর মা এসে দুজনের প্লেটেই ডিম পোচ দিয়ে নিজেও বসলেন। 

মম এইসব কেন করলে বলেই রুদ্র বাটি নিয়ে স্যুপের বোল থেকে স্যুপ তুলে ওর মাকে দিয়ে বললো, দেখো কেমন হয়েছে, এরপর নিজের জন্য আর অনিলার জন্য নিয়ে খেতে শুরু করলো। 

মম আজ না কবরস্থানে ড্যাডের কবরের দিকে যাওয়ার সময় খেয়াল করলাম দুইটা কবর কেমন যেন ভেঙ্গে চুরে গেছে, আমার খুব কষ্ট লাগলো। 

তাই? 

হাঁ মম, আমি গোর খোদকের কাছে জানলাম কবর দুইটির এই হাল কেন?

তারপর, চামুচে করে স্যুপ তুলে জিজ্ঞেস করলেন মা।

সে বললো, এই দুই কবর ঠিকঠাক রাখার জন্য নাকি ড্যাড টাকা দিতেন। 

রুদ্রর মা কেঁপে উঠলেন, উনার চামুচ থেকে স্যুপ ছলকে পড়লো। 

রুদ্র বলে যাচ্ছে, আমি ছেলেটাকে বললাম এখন থেকে এ কবর দুইটা ঠিকঠাক করে রেখো, আমিই খরচা দেবো, আচ্ছা মম তুমি কি জানো ড্যাড কেন কবর দুইটির খরচা দিতেন? 

রুদ্রর মার চোখ ছলছল করে উঠলো, তা সামলে কাঁপা গলায় বললেন, আমি জানিনা, তুই সেই কখন থেকেই কথা বলছিস, স্যুপ তো ঠান্ডা হয়ে গেলো? 

খাচ্ছি মম, জানো আজ কবর দুইটা জিয়ারত করলাম, মনটা হাল্কা হয়ে গেলো। 

 

সন্ধ্যা সাতটার পরপরই অনিলার বাবা এবং মামা মামি চলে আসলেন রুদ্রদের বাসায়, এসেই উনারা গেস্টদের দেখবাল করার জন্য রেডি হয়ে গেলেন, গেস্টরা একে একে আসছেন, রুদ্রর মাকে নিয়ে উনারা গেস্টদের রিসিভ করছেন এবং বসতে অনুরোধ করছেন ড্রয়িংরুমে, বয় বেয়ারারা সবাইকে হাল্কা পানিয় আর স্টার্টার অফার করছে। 

আটটার মধ্যে সব গেস্ট এসে পড়লে রুদ্র আর অনিলা বেরিয়ে এলো রুম থেকে, অনিলা রুদ্রর হাতের মাঝে নিজের হাত দিয়ে যখন সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে, তখন সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে হাততালি দিতে শুরু করলো।

রুদ্র অনিলাকে নিয়ে নিচে নেমে এসে প্রথম ওর মা, পরে অনিলার বাবাকে কদমবুচি করে সকল মেহমানের সাথে পরিচিত হতে শুরু করলো। 

অনিলার বাবা বেশ কয়েকজন ব্যাংকারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, যার প্রায় সবাই ব্যাংক চেয়ারম্যান, এমডি পর্যায়ের, এরপর রুদ্র ওর অফিসের সবার সাথে অনিলাকে পরিচিত করিয়ে দিলো, কিছু আত্মীয় পরিজন যারা এসেছিলেন ওরা রুদ্র আর অনিলার সাথে নিজেরাই পরিচিত হলো, অনুষ্টানে আগত মেহমানরা রুদ্র অনিলাকে সাথে আনা গিফট গুলো দিলে রুদ্র কাজের ছেলে খোকনকে দিয়ে সব এক সাইডে রাখা টেবিলে রাখতে দিলো। 

রুদ্র মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সবাইকে অনুরোধ করলো ছাদে যাওয়ার জন্য, সেখানেই খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। 

 

সবাই যার যার প্লেটে খাবার নিয়ে টেবিলে খেতে বসেছে,  রুদ্রর মা রুদ্রর বাবা, মামি সহ ব্যাংকারদের নিয়ে বড় একিটা টেবিল নিয়ে বসে খাচ্ছেন, রুদ্র অনিলাকে নিয়ে টেবিলটার পাশে গিয়ে খোঁজ খবর নিতে লাগলো, এরপর একে একে বাকি টেবিলে গিয়েও খোঁজ নিলো কারও কিছু লাগবে কিনা, খাবার কেমন হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি ব্যাপারে খবরাখবর নিলো, এরপর নিজেরা প্লেটে খাবার নিয়ে চিনু ও চিনুর ফ্যামিলির সাথে বসে পড়লো খেতে।

চিনুর ওয়াইফের সাথে রুদ্রর আগেই পরিচয় ছিলো বলে ওরা খোশগল্পে মেতে উঠলে অনিলাও তাদের আড্ডায় যোগ দিলো।

খাওয়ার পর্ব শেষে সবাই ডেজার্ট নিয়ে খাবারের তারিফ করছে, কেউ কেউ আবার রুদ্র আর অনিলার জুটির প্রশংসায় ব্যস্ত। 

এক সময় গেস্টরা একে একে বিদায় নিতে শুরু করলো রুদ্রদের কাছ থেকে, সবার শেষে অনিলার বাবা, মামা মামি বিদায় নিলে রুদ্র আর অনিলা নিজে গিয়ে গাড়িতে তুলে দিলো, উনাদের গাড়ি বেরিয়ে গেলে রুদ্র ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, মম ইউ আর টু সুইট। 

রুদ্রর মাও জড়িয়ে ধরে অনিলাকে কাছে ডাকলেন, অনিলা এলে ওকেও জড়িয়ে ধরে দুজনের কপালে চুমু খেলেন।

 

পরদিন সকালে রুদ্র ব্রেকফাস্ট করছে, সাথে অনিলা এবং রুদ্রর মা যথারীতি সাথে আছে।

রুদ্র বললো, মম তোমার পাসপোর্ট কই? 

কেন আছে তো? 

ভেলিডেটি আছে? 

তা আছে, তোর ড্যাড চলে যাওয়ার আগে ইটালি জার্মানি ঘুরে এলাম না। 

আচ্ছা খেয়ে উঠে দেখাও তো, অনি তুমিও পাসপোর্ট দিও। 

হটাৎ কি জন্য রুদ্র? 

টিকেট কাটবো? 

কোথায় নিয়ে যাবি আবার? 

ফ্রান্স। 

কি যে বলিস না, তোরা দুজন গিয়ে ঘুরে আয়, আমি তো গেছি অনেক। 

মম তোমাকে ঘরে একলা রেখে কেন যাবো মম, তুমি না গেলে আমরাও যাবোনা। 

মম আপনিও চলুন, আপনার সাথে ঘুরতে মজায় লাগবে, অনিলা বললো। 

না না তোমরা যাও, আমি ঘরে থাকতে পারবো। 

মম তুমি জানো তোমার ছোটো ছেলেটা কেমন, যাও পাসপোর্ট নিয়ে এসো, বলেই রুদ্র কপির মগটি নিয়ে উঠে গেলো, অনিলাও গেলো পাসপোর্ট আনতে, অগত্যা উপায় না দেখে রুদ্রর মাও গেলেন পাসপোর্ট আনতে। 

কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনেই ফিরে এলো পাসপোর্ট নিয়ে, রুদ্র ওর মারটা চেক করে দেখলো সেনজেন ভিসা লাগানো আছে, যার মধ্যে ফ্রান্সও সেনজেনের ভিতরে পড়ে।

 

চারদিন পর রুদ্ররা থাই এয়ারলাইন্সের এক ফ্লাইটে তাদের প্যারিস ভ্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হলো, বিজনেস ক্লাসের পাশাপাশি দুইটা সিটের ঠিক অপর পাশের সিটে বসেছেন রুদ্রর মা, রুদ্রদেরকে পাশাপাশি বসতে দিয়েছেন উনি, রুদ্র প্যারিসের নামকরা হোটেল ভার্সিতে বুকিং দিয়ে রেখেছে, প্যারিস পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র ফ্রান্সের রাজধানী, ওখানে প্রতিবছর তিন কোটির বেশি পর্যটক বেড়াতে যায়, এটি পৃথিবীর পর্যটনকেন্দ্রিক শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। 

রুদ্রদের প্রোগ্রাম হলো পাঁচদিনের, রুদ্রর কাজ যেহেতু একদিনের, বাকি সময় গুলো ওরা ঘুরে ফিরে কাটাবে এমনই প্ল্যান।

ওদের ফ্লাইট প্রথমে থাইল্যান্ডে, এরপর পাঁচ ঘন্টা পর অন্য এক ফ্লাইটে প্যারিস পোঁছালো স্থানীয় সময় সন্ধ্যা সাতটায়, রুদ্ররা সকল সিকিউরিটি চেকের পর বেরিয়ে এসে প্রথমে লাগেজ গুলো কালেক্ট করলো, এরপর চার্লস দ্য গল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে এয়ারপোর্ট থেকে বুকিংকৃত টেক্সিতে চড়ে রওওনা হয়ে গেলো ভার্সি হোটেলের উদ্দেশ্যে। 

হোটেলের সামনে এসে গাড়ি থামলে রুদ্র মিটারে বিল মিটিয়ে নামলো, হোটেলর বেল বয় এসে ওদের লাগেজ নামিয়ে নিলে রুদ্ররা এগিয়ে গেলো রিসেপশনের সামনে, ওখানে নিজেদের পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট দিলে ওদের দুইটা রুমের ডোর কার্ড দিলে বেল বয় ওদেরকে সাত নম্বর ফ্লোরের সামনাসামনি দুইটা রুমের সামনে নিয়ে গিয়ে প্রথমে রুদ্রর মার রুম খুলে দিলে সবাই ভিতরে প্রবেশ করে রুম দেখলো।

 

মম তুমি এই রুমে থাকবে, সামনের রুমে আমরা আছি, তুমি ফ্রেস হয়ে নাও, আমরাও হচ্ছি, এরপর কাছের এক রেস্টুরেন্টে খেতে যাবো। 

রুদ্র তুই তো আগে আসিসনি এখানে, কাছেই রেস্টুরেন্ট আছে তা জানলি কিভাবে? 

মম তুমিও না, আমি গুগল দেখে সব ইনফরমেশন নিয়েছি, আচ্ছা শুনো একটা জ্যাকেট নিয়ে নাও, বাইরে ঠান্ডা হবে। 

আমি তো ভাবছিলাম জিন্স পড়বো। 

এ্যাঃ তুমি আর জিন্স? 

তাতে কি, আমি তোর ড্যাডের সাথে ঘুরার সময় পড়তাম। 

রুদ্র সন্দেহের চোখে তাকালো ওর মার দিকে। 

আচ্ছা দেরি করিস কেন, যা ফ্রেস হয়ে নে, আমি ফ্রেস হয়ে নিই। 

মম, সত্যি পড়বেন, তাহলে আমিও পড়ি, অনিলা দ্বিধাবোধ করলো। 

তুমি ইয়াং মেয়ে, তোমার পড়তে দোষ কি, যাও তোমরা রেডি হয়ে নাও। 

অনিলা খুশি হয়ে এগুলো নিজেদের রুমে।

রুদ্র রুমে এসে সিগারেট ধরালে অনিলা জিজ্ঞেস করলো, কি ফ্রেস হবেনা? 

তুমি ফ্রেস হয়ে এসো, এরপর আমি যাবো।

কিছু সময় পর রুদ্র অনিলা এবং রুদ্রর মা হোটেল থেকে বেরিয়ে হাটতে লাগল, প্রায় আধা ঘন্টা পর এক রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে টেবিল খালি পেয়ে বসে পড়লো, রুদ্র ওয়েটারকে ইশারা করলে ওয়েটার এগিয়ে এলো অর্ডার নিতে।

রুদ্র ক্যাসুলে, ফুয়া গ্রা এবং বিফ স্টেক, সাথে বাবল ওয়াইন দিতে বললো ফরাসি ভাষায়।

ক্যাসুলে যা বিশেষ ধরণের সাদা বিন, হাঁসের মাংস বা ভেড়ার মাংস দিয়ে তৈরি প্রচণ্ড চর্বি যুক্ত খাদ্য এই ক্যাসুলে, ফুয়া গ্রা যা অধিক চর্বি সম্বলিত হাঁসের  লিভারের রান্না। 

এতক্ষণ রুদ্রর মা এবং অনিলা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিলো, ওয়েটার চলে গেলে রুদ্রর মা জিজ্ঞেস করলেন, তুই আবার কবে ফ্রেঞ্চ শিখলি?

রুদ্র হেসে বললো, অস্ট্রেলিয়াতে আমার রুমমেট ছিলো ফরাসি, ওর কারণেই বাধ্য হয়েই শিখেছি যা আজ কাজে লাগলো। 

তুমি পানির কথা বললে না যে, অনিলা জিজ্ঞেস করলো। 

এইখানে পানির দাম ওয়াইনের চাইতে অনেক কম, এছাড়া বাবল ওয়াইন হলো জাস্ট ফ্রুট ড্রিংক্স ধরতে পারো, মম তোমার অসুবিধা হলে পানি নিতে পারি।

রুদ্রর মা ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন, আমি আগেও খেয়েছি। 

দেখেছো আমার মম কতো স্মার্ট, ড্যাডের সাথে প্রায় বিদেশে যেতেন। 

 

....... চলবে। 

ছবিঃ গুগল।

0 Shares

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ