যৌতুকের বলি ১৩তম

মনির হোসেন মমি ২৪ আগস্ট ২০১৫, সোমবার, ১২:১০:১৪অপরাহ্ন গল্প ১৬ মন্তব্য

ytytতুমি পিংকি না?
-হ্যা সাংবাদিক চাচ্চু।
-এখানে এ সময় কি করছ?
পিংকির চোখের জমে থাকা চাচী হারানোর বেদনার অশ্রু যেন নিমিষেই গড়িয়ে পড়ল মাটিতে তাকে দেখে আবেগ তাড়িত কিশোরী মন আনমনে কেদে উঠে।রায়হান তার মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহের পরশে বৃথা শান্তনা দেবার চেষ্টা করছেন।তারপর হেটে গিয়ে পুকুর ঘাটে বসেন এবং দুজনে দুঃখগুলোকে খোজার চেষ্টায় মত্ত।
-কেদে আর কি হবে রে মা,যা হবারতো হয়েই গেছে,তুমি কিছু জানো তোমার চাচীর কি হয়েছিল?
সে না বলে মাথা নাড়ে,তখনো চোখের জল মুহুর্তে মাটিতে গড়িয়ে পড়ছিল।রায়হান খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন আজ এতোটা মাস হলো মৃত ফুলীর নিখোজের রহস্য উৎঘাটনে তেমন কোন অগ্রগতি হচ্ছে না...সে আবারও প্রশ্ন করলেন।
-আচ্ছা পিংকি তোমার কি মনে আছে সেই  সাত আট মাস  পূর্বে তুমি আমি ঐ যে ঐ বাশ ঝাড়ের পাশ দিয়ে যেতেই তুমি চিৎকার করে উঠছিলে "এ কি করছেন ওখানে পা দিবেন না,ওখানে তোমার চাচী ঘুমিয়ে আছে"....সত্যি কি তোমার চাচী ওখানে আছে?
-আমার তেমন একটা মনে নেই,তবে যত টুকু মনে আছে....,সে অনেক আগের কথা,ঐখানে এক দিন রাতে আমার আব্বু,কাকু,এবং দাদু ভাই গর্ত করেন তারপর কি যেন চাচীর ঘর থেকে মাদুর পাটি  জড়িয়ে এনে ঐখানে পুতে রাখলেন,দূর থেকে আমি  তা দেখে ফেলাতে আব্বু আমাকে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করলেন।
-এত রাত্র করে তুমি জেগেছিলে কেনো,....ঘুমাওনি?
-ঘুম আসছিল না?
-কেনো?
-চাচ্চু বিদেশ চলে যাবার পর আমি চাচীর ঘরেই ঘুমাতাম...যখন আমার ঘুম না আসত তখন চাচী আয় আয় চাদঁ মামা ছড়াটি বলত আর আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।সে রাতে আম্মু আমাকে চাচীর ঘরে যেতে দেননি,বলেছিলেন চাচীর নাকি শরীর ভাল না,তাই আমি নিজ ঘরেই ঘুমাতে শুয়ে পড়ি।অনেক ক্ষণ পর যেই আমার ঘুম আসছিল তখন হঠাৎ চেচামেচির শব্দে আমার ঘুম আর এলো না,পাশে চেয়ে দেখলাম ঘরে আম্মা আব্বু কেউ নেই।
ভয়ে  ধীরে ধীরে উঠে দরজাটা একটু ফাক করে দেখলাম... আমাদের উঠোনে চাচীর ঘর  বরাবর দাদীর চোখে মুখে মাথায় পানি  ছিটাচ্ছেন ফুপি।আমি  দেখতে লাগলাম দাদুর কিছু লোক একটি মাদুর পাটিতে পেচিয়ে কি যেন বের  করে  ঐ বাশ ঝাড়ের দিকে নিয়ে গেল...আমি তখন ভয়ে ভয়ে আব্বু আম্মুর পিছু পিছু  হাটছিলাম।ভয়ে  আব্বুকে ডাক দেই নি,পিছনে ফিরে আমাদের ঘর দেখতে পেলাম না,মনে হয় ঘর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছিলাম।আমার সামনে একটু দূরে আব্বু আম্মুকে দেখলাম লোকগুলোর পিছু পিছু যাচ্ছেন,হারিকেনের আলোতে সব কিছু কেমন যেন অন্ধকার দেখছিলাম হঠাৎ শিয়ালের ডাক  শুনে আমি চিৎকার দিয়ে সেখানেই থেমে স্থির দাড়িয়ে ভয়ে কাপছিলাম।আব্বু বুঝতে পেরে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিয়ে আবার আমাকে ঘরে রেখে দরজার বাহির দিয়ে শিকল লাগিয়ে চলে যায়.....তার পর হতে চাচীকে আর ওঘরে দেখতে পাইনি।
-তুমি জিজ্ঞাসা করোনি?
-মাকে বলেছিলাম মা বলেছিল চাচী মারা গেছেন।ঐখানে ঐ বাশ ঝাড়ে তাকে শুয়িয়ে  রেখেছেন।
পাড়া্-পতিবেশীর মতে ফুলী নিখোজ আর পিংকির ভাষ্যমতে  সে মৃত।তবে যে স্থানটি পিংককির  ভয়   সেখানে  আরেকবার যেতে হবে বলে পিংকির হাত ধরে ঘাট থেকে উঠেন।
-চলো?
-কোথায়?
-তোমার চাচীর কবরে।
-তাকে কি  আর খুজে পাবেন!মেলা  দিন  হইছে এত দিনে চাচী আমার হাড় হাড্ডি নিয়ে স্বর্গে চলে গেছেন।
পা গুলো ছন্দে চলে দুজনের।লম্বা সবুজ হলদে ঘাসগুলোকে মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন,দূর্বা ঘাসে পরিপূর্ণ একটি কবর,সাড়ে তিন হাত কি না সে জানে না তবে মাটির বিভক্তিতায় বুঝা যায় যে এই স্থানটিতে  কিছু একটা আছে।সেখানে দাড়ালেন দু জনে,মাথার উপর দিয়ে বেচে থাকার তাড়নায় বেয়ে যাওয়া ঝুলন্ত শক্ত চিকন গছের ডালটি ভেঙ্গে সেই স্থানে আঘাত করতেই বুক কেপে উঠে তার,সে যতটা না জোড় লাগিয়ে ছিল ডালটিকে মাটিতে পুতে দিতে তার চেয়েও দ্রুত গতিতে ডালটি ভিতরে ঢুকে গেল তারপর সে ডালটি তুলে অন্যত্র তত জোড়ে পুততে চেয়ে ডালটি ভেঙ্গে গুড়ো হয়ে গেল।সন্দেহ নেই এখানে যে কোন একটি গর্ত আছে।তবুও সাংবাদিক রায়হান আরো একটু নিশ্চিত হতে মনস্থির করলেন।
"পাড়ায় মহল্লায় রব উঠেছে
কি হইছে ,কি হইছে
শেষ কালে রশিদ মোল্লার মনে
রঙ্গ লেগেছে,খাবো এবার মজা করে
পোলাও কোর্মা উদর ভরে।
কি হয়েছে কি হয়েছে
রশিদ মোল্লার যৌবন আইছে
পুরাত চাউল রেখে
নতুন চাউলে নজর দিছে
কি হয়েছে কি হয়েছে
পাড়া পরশী ছি ছি করছে"......
images.jbb jbইত্যাদি রশিদ মোল্লার নামে বিভিন্ন গ্রাম্য কথা মালা ছড়িয়ে পড়েছে সারা গ্রামে।তার বউয়ের কানেও এসেছে তবে সে ওসব কথা বিস্বাস করতে  নারাজ কেননা ঘরে এখনো তার সদ্য বিবাহ বিচ্ছেদ  মেয়ে আছেন,আছে অবিবাহিত  ছেলে তাছাড়া বয়সতো আর কম হয়নি না হলেওতো ষাটের উপরে এমন বয়সে!!!,,,,না এ হতে পারে না,নিজের মনকে কিছুতেই বিস্বাস  করাতে পারছেন না সে।ভাবছেন হয়তো উড়ো কথা অথবা শত্রুতা করে কেউ এসব বদনাম ছড়াচ্ছেন।
তার দুতিন দিন পর বাড়ীর আঙ্গিনায় এক বৈঠকে রশিদ মোল্লা যখন তার সাথীদের সাথে কথা বলছিলেন,
-কি রে কেমন হবে,বউতো পাবোই সঙ্গে রাস্তার সঙ্গে বিশাল জমিগুলোও...বুঝলি এ হলো মোড়লের মোড়লগিরী তালতো খাবোই সঙ্গে বিচিও...হা হা হা ....যাক তয় তারিখ ফাইনাল করছ?
-হ,ঐ আসছে বৈশাখের পনের।হুজুর..?
-ক'না, কি কইবি
-চাচীকে কথাগুলো বললে ভাল হইতো না..।
-কেন আমি কি মাইয়া লোক নাকি যে ঘরের লোকরে কইতে হইবো।তাছাড়া তোর চাচী অহন ডেট ফেইল,,,,এক সবজি সব সময় খেলে রুচি থাকে না,,,বুঝলি।যা... তুই বাজারে যা..তোর নতুন চাচীর লাইগা একখান সুন্দর শাড়ী নিয়া আয়...টাকা লাগবে না বাজারের ঐ রহমানের কাপড়ের দোকানে গেলেই দিয়া দিবে।
-ঠিক আছে.....।
আড়াল থেকে মোড়লের স্ত্রী তাদের সকল কথোপকথন শুনেছিলেন।শুনে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলেন না সে সবার সামনেই রশিদ  মোল্লাকে জেরা করতে তার সামনে দাড়ালেন।বৈঠকে সবাই অবাক হলেন দীর্ঘ কালের সঙ্গ মোল্লার বউকে ভাল করে তেমন কেউ দেখতে পাননি আজ যদিও দেখা পেলেন তাও দূর্গার অগ্নিমূর্তি ধারণ করা অবস্থায়...ভয়ে অনেকে সেই স্থান হতে কেটে পড়ছেন অনেকে যাই যাই ভাবে উৎ পেতে আছেন।
-আর কত?বলি আর কত সম্পদ আপনার লাগবে,কন দেহি।কমতো করলেন না আমার বাপের ভিটে মাটি সব খাইলেন,গ্রামের অনেককে ছলে বলে ভিটাশূণ্য করলেন,,,আর কত?এবার ক্ষ্যান্ত দেন আল্লাহ সইবে না।
এরই মধ্যে সাংবাদিক রায়হান পিংকিকে সাথে করে সেই বাড়ীতে ঢুকলেন।এ সব চেচামেচি দেখে পিংকি দৌড়ে তার দাদীকে ডাকছেন জানতে চাচ্ছেন,
-কি হয়েছে,দাদী তুমি কাদছেঁ কেনো?
কে শুনে কার কথা বঙ্গ রমণীর অস্তিত্ত হলো তার স্বামী।পৃথিবীতে সব কিছুর ভাগ করা চলে শুধু বঙ্গ ললনাদের স্বামীর ভাগ চলে না,কেউ মেনে নিতে পারেন না।তাইতো তার চোখে মুখে জেগে উঠেছে এক বিষাদগার স্পষ্ট ছায়া।অনেক ক্ষণ চেচামেচিতে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়লেন মোড়লের স্ত্রী।মনে পড়ে গেল পুত্র বধু নিষ্পাপ ফুলীর উপর তাদের অত্যাচারের স্মৃতি।সামান্য কিছু যৌতুকের জন্য হারাতে হলো সোনার মত পুত্রবধুটিকে।সে আবার হঠাৎপুরুষের ন্যায় গর্জন দিয়ে উঠে মোল্লার নাক বরাবর নাক রেখে চিৎকার করে বলতে থাকেন।
-আপনি কি সরমের মাথা খাইছেন,বয়সটারেও চিন্তা করলেন না।এক পা তো কবরে চলে গেছে।
-আরে রাখো তোমার বয়স টয়স... আমার বাত্তিতে তেল থাকলে তুমি নিবাবে কেমনে।
-আমি কিছুই করুম না,আমারে কিছুই করতে হইব না...এই পাপ আর বউমা ফুলীর পাপই আপনারে জাহান্নামে নিয়া যাইবো।
-শুয়োরের বাচ্চায় কয় কি!... তোর মুখ বন্ধ করবি নাকি আমিই বন্ধ কইরা দিমু......
-আমার মুখ আর বন্ধ হইবো না,এহন থেইকা আপনার হগল কূ-কৃর্তি কইয়া বেড়ামু.....ঐ জমির চাচা মরল কেন?....বিধবা শাহনাজ কেন বিষ পান করল...পাগলী আলেয়ারে কেডায় পাগল বানাইল? আমি...আমি সব ফাস কইরা দিমু।
-আরে চুপ করবি,,,,,
-না..না...না...আমারে আজ কেউ থামাতে পারবে না,.....
চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে প্যাক কাদায় মেখে শরীরের অবস্থা শোচনীয় তবুও তার বিলাপ থামছে না।
-সোনা বউ ফুলীর বাপেরে বাড়ী ছাড়া করলেন তারপরও কেন ফুলীরে বাচতে দিলেন না?বংশের বংশধর সহ তারে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হলো কিন্তু কেনো?
-তবে রে.....
বলে তার হাতে থাকা চলাচলের লাঠিটি দিয়ে আঘাত করল স্ত্রীর মাথায় সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল,লুটিয়ে পড়া অবস্থাও স্ত্রীকে আঘাত করেই চলছেন মোড়ল....তোরে আজ শেষ কইরা নতুন এক জনকে ঘরে আনমুই আনমু....পাশের গ্রাম থেকে দৌড়ে ছুটে আসেন ছোট ছেলে।এরই মাঝে সাংবাদিক রায়হান সাহস করে মোড়লের লাঠিটা ধরে ফেলে মোড়লকে  এক ঝাটকা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে রক্তাক্ত ফুলীর শাশুড়ীকে কোলে তুলে নিলেন সাথে যোগ দিলো ছোট ছেলে মেয়ে বড় ছেলের বউ।ঠেলা গাড়ীতে উঠিয়ে ছুটে চলছেন স্থানীয় হাসপাতালের দিকে।

চলবে....
যৌতুকের বলি  ১২তম পড়ুন

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ