
মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর ! কবি জসিম উদ্দিনের ‘কবর’ কবিতার শেষ উক্তি। কবিতায় এতো সুন্দর করে বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলার যে চর্চা তা কবি জসিম উদ্দিনের কবিতা না পড়লে বুঝতেই পারতাম না। বৃদ্ধ দাদুর আকুতি যতোবার পড়েছি ততবার কেঁদেছি। দাদুর আকুল নিবেদনের গভীরতার সন্ধান করতে গিয়ে ভাবনার সাগরে ডুবেছি অসংখ্যবার- কূল- কিনারার সন্ধান পাইনি।
কেয়ামত বা শেষ বিচারের দিন মহান আল্লাহর প্রতিশ্রত দিবস। এটা সংগঠিত হবেই- এতে সন্দেহের লেশমাত্র নাই। সূরা বাক্বারার 48 নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, “ এবং তোমরা সেই দিবসকে ভয় কর যেদিন কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তি হতে কিছুমাত্র উপকৃত হবে না এবং কোন ব্যক্তি হতে কোন সুপারিশও গৃহিত হবে না, কোন ব্যক্তি হতে কোন বিনিময়ও গ্রহণ করা হবে না এবং তাদেরকে সাহায্যও করা হবে না।” কেয়ামত আখেরাতের একটা কঠিন ধাপ হলেও মানুষ তার জীবদ্দশায় কোন না কোন সময় এর ভয়বহতা উপলব্ধি করে।
শুক্রবার, 25 সেপ্টেম্বর 2020 ইং। জুমার সালাত আদায়ের পর পি.ডব্লিও.ডি’র কর্মচারী জনাব নান্নু মিয়ার জানাযা পড়েছি। সকলেই বললেন, তিনি একজন ভাল মানুষ ছিলেন। তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি এবং মহান আল্লার দরবারে তার জন্য জান্নানে সুউচ্চ মর্যাদা প্রার্থনা করছি।
বলছিলাম জীবদ্দশায় প্রত্যেকে কোন না কোন সময় কেয়ামতের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে। এক সময় মানুষ উপলব্ধি করে জীবনের প্রত্যেকটা মুহুর্ত এক একটি হীরক খন্ডের চেয়েও মূল্যবান। যে ব্যক্তি এমন মূল্যবান সময় হেলায়-ফেলায় নষ্ট করেন শেষ জীবনে এসে তার আফসোসের আর অন্ত থাকে না। এই আফসোস কেয়ামতের বিভিষিকার চোয়ে কোন অংশে কম নয়। এটা সে ব্যক্তি উপলব্ধি করে যে আজ জীবনের এই স্তরে এসে উপস্থিত হয়েছে।
আমাদের উত্তর পাড়ার শমসের চাচা, গ্রামের সব চেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি মোবারক সাহেব এখন নিয়মিত মুসল্লি। দৈবাৎ কোন সমস্যা না হলে তাদেরকে প্রত্যেক ওয়াক্তে পাড়ার মসজিদে সকলের আগে উপস্থিত পাবেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতে পড়েন। কিন্তু তাদের অন্তরে শান্তি নাই। প্রায়ই যুবকদের ডেকে কাছে বসান। ওয়াজ-নসিহত করেন। সোনালী যৌবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলো কিভাবে কাটিয়েছেন তার গল্প শুনাতে চান সকলকে। কিন্তু পাড়ার ছেলে-পেলেরা এনাদের যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে। বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকেন নিজেদের গল্প।
আবদুল্লাহ চাচা, কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ইনি একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। হঠাৎ করে তার কাজে, চলনে-বলনে পরিবর্তন সকলের নজর কেড়েছিল। কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারেনি। কেননা পাড়ার সকল সামাজিকতায় তিনি একজন বড় দাতা ছিলেন। কার মেয়ের বিয়ে, কার ছেলের পড়াশুনার খচর, সমাজের কোন উন্নয়নমূলক কাজের খরচ, গরীব-দুখীদের পাশে দাঁড়ানোয় আবদুল্লাহ চাচার সুনাম ছিল চতুর্দিকে। কিন্তু একজন সরকারী কর্মকর্তার বৈধ আয়ের ব্যাপারে এপাড়ার ছোট বালকটিও সম্যক ধারণা রাখে। ইনি আজ নেই। তার রেখে যাওয়া সম্পদ আর ব্যাংকের ডিপোজিট পড়ে আছে, আছে সন্তানেরা। নিজেদের অংশ যার যার মতো করে বুঝে নিতে গিয়ে সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিল। পরিবারের সদস্যরা সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আজ আদালতের দারস্থ হয়েছেন। সেই সুবাদে দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পদের উৎস সন্ধানে উঠে পড়ে লেগেছে। সম্পদ! আবদুল্লাহ চাচার রেখে যাওয়া সম্পদ আজ সকলের জন্য মরণ ফাঁদ হয়েছে।
জীবনের শেষ প্রান্তে উপস্থিত মাত্রই বুঝতে পারে তার জীবনের রোজ কেয়ামত আসন্ন। সম্পদের বণ্টন নিয়ে সন্তাদের বৈরিতা যে পিতা অবলোকন করছেন তিনি বুঝেন তার জীবনের কেয়ামত প্রকট আকার ধারণ করছে। বার্ধক্যে উপনীত ব্যক্তিই বুঝেন তার যৌবনের প্রতিটি সেজদার মূল্য আজ কতো হতে পারে। সুতরাং এর জীবনেও রোজ কেয়ামত চলছে তা বলাই বাহুল্য।
সময়ের কাছে এভাবেই আমি-আপনি হয়তো হেরে যাব। যেমন হেরেছেন শমসের চাচা, মোবারক সাহেব এবং আবদুল্লাহ চাচা। না আমরা হারতে চাইনা। আমরা যুবক-যুবতী। আমাদের শরীরে প্রাণ আছে, কাজ করার শক্তি আছে। মহান আল্লাহর ইবাদত করার মতো যথেষ্ট সময় আছে। মূল্যবান মুহূর্তগুলো আমরা অনৈতিক কাজে মজা নিয়ে নয় বরং আল্লাহর ইবাদতে মজা খুজে ব্যয় করবো। প্রত্যেকটি মুহুর্ত মূল্যবান এই ধ্যান মনে বদ্ধমূল রেখে সামনে এগিয়ে যাব। তাহলে বার্ধক্যে আমাদের সময়গুলো কেয়ামতের মতো মনে হবে না।
সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানোই হোক আমাদের আজকের প্রত্যয়। ব্লগ লিখব, লিখব কবিতা, গল্প-অনুগল্প সবই লিখব কিন্তু তা যেন মহান আল্লাহকে প্রাপ্তির পথে অন্তরায় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখব। যেন শেষ সময়ে বলতে না হয় “ মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কতদূর। ”
১৩টি মন্তব্য
নাজমুল আহসান
মানুষ মৃত্যুকে স্মরণ করে না ভাই। আল্লাহ সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দিন। আমিন।
মোঃ খুরশীদ আলম
আমিন। আল্লাহ আপনাকে আমাকে বুঝার ক্ষমতা দিন।
পপি তালুকদার
আমাদের প্রতিটি কাজই হোক স্বচ্ছ যাতে রোজ কেয়ামতে তার জবাব দিতে কষ্ট না হয়।আপনার লেখা পড়ে সত্যি পরকাল নিয়ে ভাবনা জাগ্রত হল।
মোঃ খুরশীদ আলম
আপনার মন্তব্যে ভাললাগা রইল। পরকাল নিয়ে ভাবনা জাগ্রত হয়েছে জেনে আমি আনন্দিত। আমার লেখা স্বার্থক হয়েছে মনে করছি। আমার জন্য দু’য়া করবেন।
পরকালে মহান আল্লাহর কাছে জবাবদিহি আসলে কেউ করতে পারবে না। কারণ জবাব দেয়ার মতো যৌক্তিক কোন হেতু আমাদের নাই। তাই আল্লাহর ক্ষমা ছাড়া কোন উপায় নাই। তিনি যেন আমাদের সবাইকে ক্ষমা করেন। আমিন।
আরজু মুক্তা
পরকাল ভাবিয়া ইহকালে খারাপ কাজ করে হজ করে আসলেই হবে।
ভালোটা ইহকাল থেকেই হোক
মোঃ খুরশীদ আলম
“পরকাল ভাবিয়া ইহকালে খারাপ কাজ করে হজ করে আসলেই হবে।” – এমন তথ্য আমি কোথাও পাইনি। জানিনা আপনি কোথায় পেলেন। যা হোক, সুস্থতা থাক অবিরত।
রোকসানা খন্দকার রুকু
কজন আর ভাবি বলেন?? এমন ভাবে জীবন যাপন করি যেন শেষ বলে কিছু নেই।
ভালো লাগলো। শুভ কামনা।
মোঃ খুরশীদ আলম
“ প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যূর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে।”- কুরআন।
মোঃ মজিবর রহমান
আল্লাহ সবাইকে পরকাল ও সততা পথে চলারর তৌফিক দিন। আমিন। আর কিছুই বলার নায় ভাই।
মোঃ খুরশীদ আলম
যা বলেছেন অনেক মূল্যবান বলেছেন। আপনার প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করুন।
মোঃ মজিবর রহমান
আল্লাহ মেহেরবান হোক সকলের প্রতি।
খাদিজাতুল কুবরা
আপনার লেখাটি পড়ে সত্যি অনুপ্রেরণা পেলাম ইবাদত বন্দেগী এবং সত্য সুন্দরের সাথে থাকার। এভাবেই ইসলামের সৌন্দর্যকে চমৎকার লেখনীতে তুলে ধরুন।
ইনশাআল্লাহ কেউতো হেদায়েত হবে।
আমিন
মোঃ খুরশীদ আলম
আমার লেখাটি আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে জেনে আনন্দিত হলাম। মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জ্ঞাপন করিছি- আলহামদুলিল্লাহ। দু’য়া করবেন যেন আমল করতে পারি। আমন্ত্রন রইল পরবর্তী লেখায়। ধন্যবাদ।