মীরার কথা-১

নীরা সাদীয়া ৪ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ০৯:৫২:৪৭অপরাহ্ন গল্প ২৪ মন্তব্য

অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন মীরার কথা লিখব। কিন্তু কিভাবে লিখব, কি লিখব গুছিয়ে উঠতে পারছিলাম না। আজ ভাবলাম, যেমনই হোক, তা লিখেই ফেলি।

মীরার গ্রামের বাড়ি পলাশডাঙা। সেখানে ছায়াঘেরা ঘন সবুজ প্রকৃতির নিবিড় পরিবেশে বেড়ে উঠেছিল মীরা। বয়স চার কি পাঁচ। বাড়িতে মা, চাচী, চাচাতো ভাই, বোন সহ অনেক মানুষ। সবার আগ্রহের কেন্দ্র বিন্দু ছিলো ছোট এই শিশুটি। আরেকটু বলতে গেলে বলা যায় চাচাতো ভাই বোন সবাই বড় থাকায় একটা মাত্র ছোট বাচ্চা পেয়ে সবাই আহ্লাদিত হত। ফলে মীরা সারাদিন কারও না কারও কাছে আদর পেত। চাচাতো বোন ইভা কখনো চুল আঁচড়ে দিচ্ছে তো বড়বোন নিশু তাকে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। বড় ভাইয়েরা কোলে পিঠে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে। কখনও চাচী ডেকে নিয়ে আদর করে দিচ্ছে। মা সন্ধ্যার পর বিছানায় শুইয়ে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছে। শিপু ফুপু এসে মুখে তুলে ভাত খাওয়াচ্ছে আর গল্প বলছে। এভাবে আদরে আদরে বেড়ে উঠেছিল মেয়েটি।

 

তার বাবা এবং চাচা শহরে চাকরি করতেন। তাই মাসে একবার তাঁদের সাথে দেখা হত। এই মেয়েটি ছিলো বড্ড অস্থির। একটা মুহূর্ত সে চুপটি করে বসত না। সারা গ্রামে টৈ টৈ করে ঘুরত। কখনো যদি পুরো গ্রাম খুঁজে তাকে না পাওয়া যেত, তখন মা বুঝতো নিশ্চয়ই কোন না কোন গাছের ওপর বসে আছে মেয়েটি। গিয়ে দেখতো ঠিক ঠিক লিচু গাছের ওপর মীরা! গাছের পাতা লতা দিয়ে টেলিফোন বানিয়ে খেলা করত। কখনো গাছের ওপর সংসার পাততো, গাছের পাতা দিয়েই পিঠা পায়েস রান্না করত। হেসে খেলে দিন কেটে যাচ্ছিল বেশ।

 

হঠাৎ একসাথে দুটো খবর এলো। প্রথম খবর, মীরার বাবা বিদেশে চাকরি পেয়েছে। আর দ্বিতীয় খবর, মীরার আরেকটা ভাই/বোন আসতে চলেছে। এই দুটো খবরে কোনটাতে খুশি হবে,কোনটাতে দুঃখ পাবে তা ভেবে ওঠার মত বয়স ও বুদ্ধি কোনটাই ছিলো না মীরার। এই খবরের পর আর বেশি দিন গ্রামে থাকা হলো না। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন মীরা ও তার মাকে চট্টগ্রাম বড় ফুপুর বাসায় রেখে যাবেন। খুব অল্প দিনের মাঝেই তা বাস্তবে পরিণত হল।

 

১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাস।মীরা এবং তার পরিবার চট্টগ্রামে এসে পৌঁছাল। চট্টগ্রাম শহরের খুব পরিচিত একটি এলাকা বায়োজিদ বোস্তামীর মাজার। সেই মাজারের কাছেই বড় ফুপুর বাসা। এই বাসায় আসার পর প্রথম কয়েকদিন খুব একা লাগতো মীরার। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে পাহাড় দেখে একমনে কী যেন ভাবতো। কিন্তু এই অখণ্ড অবসর খুব বেশিদিন রইলো না। ইতোমধ্যে তার ফুপাত বোনেরা তাকে চক, পেন্সিল ধরা থেকে শুরু করে অ আ ক খ সব শেখাতে লাগলো। কখনো ধৈর্য্য নিয়ে শিউলি আপা পড়ায়, কখনো শাসনে আদরে তানি আপা পড়ায়। চাল বাছতে বাছতে, রান্না করতে করতে ফুপুও পড়াতে থাকেন। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে চলে আলিফ লায়লা! বিরতি দিলে আবার পড়া। তাঁদের নিরলস পরিশ্রমে ও চেষ্টায় এক মাসের মধ্যেই অ আ ক খ থেকে শুরু করে শব্দ গঠন, ইংরেজি, গনিত সব বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠে মীরা।

 

এবার স্কুলে ভর্তির পালা। শহরের নামকরা বায়োজিদ লাইন স্কুলে তাকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়।প্রতিবেশীদের বেশ কয়েকজন বাচ্চা ঐ স্কুলে ২/৩ বার করে পরীক্ষা দিয়ে অনুত্তীর্ণ হয়ে বসে আছে। আর সেই স্কুলে এক মাসের প্রস্তুতি নিয়ে টিকে যাবে মীরা? এ যেন অলীক স্বপ্ন তানি আপা এবং শিউলি আপার কাছে! তাই তারা কেউ সেদিন রেজাল্ট আনতে যায়নি, পাঠিয়েছিলো একজন প্রতিবেশীকে। তিনি এসে জানালেন "মীরা ২৭ তম হয়ে ভর্তি পরীক্ষায় টিকেছে!" মা,তানি আপা, শিউলি আপা, ফুপুসহ বাসার সবার আনন্দ সেদিন দেখার মত ছিল।

 

চলবে...

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ