
আজ তিনদিন পর রান্নাঘরে ঢুকেছি। ছোট্ট বিলালু (রোদ বিড়াল ছানাকে বিলালু ডাকে) পা ঘেঁষে পেছন পেছন ঘুরছে। সাত সকালেই তার ক্ষিধে পেয়েছে। ইচ্ছে করছে ঝটকা মেরে পা দিয়ে সরিয়ে দেই। কিম্তু পারছি না। ক’মাস আগে কে বা কারা বিলালুকে এক পা ভাঙা অবস্থায় ফেলে রেখে গেছে। পোষা কোয়েলটি তার খোঁপে ডিম দিতে গিয়ে বিকট চিৎকারে বেড়িয়ে এলো। ঘটনা কি?
আহত বিলালু ঘুমাচ্ছে কোয়েলের খরের বিছানায়। তিনদিন ঘুমানোর পর একগাদা গরম ভাত গপাগপ খেয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘরদোর চিনতে। যদিও ‘ গরম ভাতে বিড়াল বেজার।’ তারপরও ” ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।”
এরপর থেকেই সে আমাদের বিলালু এবং বাড়িময় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই রাজত্ব করছে। বিরক্ত করলেও কিছু করার নেই! ওর উপর কেমন প্রেমময় মায়া হয়েছে, ছাড়া যায় না।
মায়া ব্যাপারটাই এমন, হঠাৎ করেই হয়ে যায়! এরপর একেবারে জ্বীনের মতো ভর করে আর কিছুতেই যেন পিছু ছাড়ানো যায় না। সে যতোই তার জন্য জগত সংসার উজার হোক না কেন?
উজার জগত সংসার বাঁচাতে আপনি মনোকষ্টে ঘুমাতে পারবেন না, জীবনের সাধ শেষ হবার আগে সাইক্রিয়াটিস্ট বা নিউরোর কাছে যাবেন। তিনি দুটো তিনটে ওষুধ দেবেন। জ্বর হবে, টানা ঘুমাবেন। ওঠার পর মাথা ফাঁকা লাগবে। মনে হবে মাথা থেকে সব উবে গেছে। আশে পাশের পরিবেশ লোকজন সবই কেমন হেলুটেড লাগবে। কারও প্রতি কোন মায়া, প্রেম বা টান কোনকিছুই অনুভূত হবে না। এমনকি অভিযোগ বা ঝগড়াও করতে ইচ্ছে করবে না। শুধু মনে হবে যা হবার হোক। কিন্তু কোথায় যেন হাহাকার দিব্যি সে জানান দিতে এতটুকুও কার্পণ্য করবে না। এটা আদৌ কি সলুশন?
মা কিছুটা অসুস্থ তাই এখনও ঘুমাচ্ছেন। উঠেই তিনি পুরোনো কাসুন্দী নিয়ে বসবেন। দোষ সমস্তই আমার। মেয়েদের সহনশীল হতে হয়! অনেক রয়ে সয়ে তিনিও সংসার করেছেন। এখনকার মেয়েরা কেমন যেন। বিয়ে যেভাবেই হোক এখন তো সে স্বামী। তাকে চ্যাতালে চলে।
আমার কানে কিছুই যায় না। আমি ভাবি রান্না দ্রুত শেষ করতে হবে। রোদ স্কুলে যাবে। তাদের খাওয়ানো শেষ করে সংসারের বাকি কাজ শেষ করে কলেজ তো আছেই! কারন সকালে ১০ মিনিট দেরিতে ক্লাসরুমে ঢুকে মেয়েরা অসুস্থ ছিলাম কিনা; কেন আসিনি এসবে নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হয়।
এদেরই বা কি দোষ! এই সময়টাতে নিজেকে ঝেড়ে- ঝুড়ে নতুনত্ব দেই। বলা যায় বেশ ভালো সময় কাটে। কলিগদের সাথে খুনসুটিময় আদা চা মনে করিয়ে দেয় – বাঁচতে হবে। একজনকে নিয়ে তো জীবন নয়। আরও কতো সবুজ প্রাণ ভালোবাসছে উন্মুখ হয়ে। তাদের জন্যই বারবার ফিরতে হয়; হবে!
এতো ব্যস্ততায়ও শেষ বিকেলের মনটা কেন যেন তাকেই খোঁজে। সেও বিলালুর মতো এমন করেই জীবনে এসে জায়গা করে নিয়েছিল। কোনভাবেই ফেলতে পারছি না। আমার জীবনে তার আসার কি কোন প্রয়োজন ছিল ?
জীবন যেমন চলছিল তাতে বেশ অভ্যস্থ ছিলাম। পাশের মানুষটার সাথে যেভাবেই বিয়ে হোক, কিংবা তাকে খুব পাশের মনে না হলেও, ভালো না বাসলেও দিব্যি তার বাচ্চার মা হয়েছি। একান্ত সময়গুলোতে আমার চুমুর প্রয়োজন হোক না হোক অন্ততঃ সে হ্যাপি ছিল।
এভাবে বাকি জীবনটা কেটেই যেতে পারতো। পরপারে কিংবা বেহেস্তে কারও কারও প্রেম দেখে হয়তো হিংসে হতো। এর চেয়ে বেশি কিছু তো ছিল না। অন্ততঃ এমন জ্বলে- পুড়ে মরতে হতো না।
এখন আমার জীবনে যা কিছু ঘটতে চলেছে তাতে আমি যেন দর্শক হয়ে গেছি। চাইলেও অসার মনকে এক বিন্দু টলাতে পারি না। মনে হচ্ছে যা হবার হোক। আমি যেন কোন সমাধানই চাই না।
আবার শেহজাদ আর আমার প্রেম কিনা তাও জানিনা। তবে আমি তার জন্য সব ছাড়তে পারি এটা বুঝতে পারি। হয়তো সে মজা করেই বলেছিলে পিএইচডি করতে গেলে আমাকে নিয়ে যাবে। আর দেশে ফিরবেই না।
অথচ আমি তার সাথে সংসার পেতে বসে আছি। স্বপ্ন দেখছি পাহাড়ে ওঠার, মেঘ ছোঁয়ার। স্বপ্ন দেখছি কোন একদিন আমরা অন্য কোথাও, অন্যজগতে।
আমার পাশের মানুষটা দিনে দিনে অচেনা হতে থাকে। তার উপস্থিতি আমাকে কাঁপিয়ে তোলে, বিরক্ত হই। সে শারীরিক হতে চাইলে বাহানা দাড় করাই। মনে হয় এ শরীরের ভাগ আমি আর কাউকে দিতে পারিনা। জগৎ, সংসার সব বদলে যেতে থাকে এটা ভালোই বুঝি। কিন্তু করার কিছুই নেই।
আমার আমূল পরিবর্তনে সে তার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমি তবুও বিচলিত হই না। আমার মনে হয় – এটাই তো আমার দরকার। আমি চাই সে আমাকে মুক্তি দিক। আমি শুধু একজনের হই। শেহজাদ শুধু আমার হোক!
একসকালে আচারের জন্য জলপাই কিনছিলাম। দোকানীকে বললাম, বড় বড় দেখে দিতে। আমার পাশে একজনও বড় বড় দেখে আলাদা করছিলেন। আমি তার উপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম-
জনাব, আপনি কি দাম বেশি দিবেন? তাই সব বড়গুলো বেছে বেছে নিচ্ছেন? আমার জন্যও রাখুন!
তিনি হাসলেন এবং কোন উত্তর করলেন না। এরপরও বড়গুলোই বেছেই চলছেন। কেউ কথার উত্তর না দিলে আমার রাগ আরও বেড়ে যায়।
আমি ছোটবেলার লুডো খেলায় হেরে যাবার মতো জলপাইগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললাম- নিন! আপনিই সব নিন! আমার লাগবে না।
আমার ছেলেমানুষীতে ভদ্রলোক তাকিয়ে রইলেন। সেদিন বিকেলে বাসায় ফিরতেই মা বললো, কে যেন একগাদা জলপাই দিয়ে গেছে।
চিরকুটে লেখা ছিল – আমি শেহজাদ খান, পেশায় একজন শিক্ষক। আমি অবিবাহিত মানুষ, জলপাই করবো কি! আপনার জন্যই দেখছিলাম। কেন যেন সকালে আপনাকে দেখেই মনে হলো, আপনার জন্য এটুকু করি। মানুষের মুখে এতো মায়া থাকে? আচ্ছা, আপনার নাম কি মায়া? মায়া হলে ভালো হতো কিন্তু? ছেলেমানুষি ক্ষমা করবেন আর আচার পাঠাতে ভুলবেন না। খুঁজতে কষ্ট হবে না কারন এমন মফস্বলে সবাই সবার প্রতিবেশী। আমি আপনার বাড়ির পেছনের ফ্ল্যাটেই থাকি।ফোন নম্বর দিয়ে রাখলাম। মন চাইলে নক দিয়েন।
কি আশ্চর্য! প্রতিবেশী, আমি তো কখনও তাকে দেখিনি। লজ্জায় মাথা কাটা যাবার জোগাড় হলো। এ বয়সে এসব মানায়!
শেহজাদ স্যাটেলড, স্বল্পভাষী, অমায়িক মানুষ। আচার পাঠিয়ে ফোন দিয়েছিলাম। এরপরই শুরু! কি যেন একটা আছে এই মানুষটার মাঝে। স্রোতের মতো টানে। কথা বলতে বিরক্ত লাগে না। সমস্তই কেমন বুঝে ফেলে তখন আমার লজ্জায় গাল কেমন লাল হতে থাকে।
সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা কখন তাকে পেরিয়ে যায় বলা যায় না। গত দুবছরে শেহজাদ কখন যেন সীমারেখা পার করে একান্তে চলে এসেছে আমি বুঝতে পারিনি। শুধু সে ফোন না দিলে ভীষন কষ্ট হতে থাকে। পনেরদিনে একদিন লুকিয়ে দেখা না করলে আমার অস্থির লাগে। হাত ধরলে ফুলশয্যার মতো নতুন অনুভূতি হয়।
প্রথম যেদিন সে আমার ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো। আমি বাঁধা দেবার কেউ ছিলাম না। অজানা ঠিকানায় সেদিন থেকে তার হয়ে গেছি।
দোষ আমার না তার? আমি কিছুই ভাবতে পারিনা, চাইও না। সংসার, চাকরী সব করতে হয় বলে করি। মায়ের জন্য বাচ্চার জন্য মায়া হয় কিন্তু যখনই শেহজাদ উল্টো- পাল্টা করে আমি নিতে পারি না। মরে যেতে ইচ্ছে করে।
জীবনের প্ল্যান যতো সহজবোধ্য করে করা হয় আসলে তা হয় না। শেহজাদ পিএইচডি করতে যাবার বদলে বদলে যেতে থাকে। আরও বদলে যায় যখন আমি জানাই ডিভোর্স নিচ্ছি। হয়তো কোন ভাবে বোঝাতে চায় আমরা কাদা লাগানো ছাড়াই জল ঘোলা করবো। লোকে জানবে না। কলঙ্ক হবে না।
তা কি হয়? ক্লিওপেট্রার জন্য ট্রয় তো ধংস হতে বাধ্য। যা হবার আমারই হলো। একা হয়ে গেলাম। শেহজাদ তার মতোই রইলো। আমার পাঁজরের পাশেই ওই বাড়িতেই, ওই ফ্ল্যাটেই। আমার বানানো সেই খাট, বালিশ, বিছানা, চাদরেই। যেখানে অজস্র বিকেল সাক্ষী আমাদের প্রেমের। শুধু আমার সামনে কখনও আসে না। দু- একবার দেখা হলে চোখ নামিয়ে নেয় কিংবা আড়াল হয়।
আর আমি সমস্ত দিনের শেষে আসায় বসে থাকি সে এসে হাত ধরে আলতো চুমু দিয়ে বলবে- আমি তোমাকে ছেড়ে যাইনি, যাবোও না। পিএইচডি করতে গেলে তোমাকে নিয়ে যাবো। তখন সত্যিই আমরা আর ফিরবো না।
৪টি মন্তব্য
খাদিজাতুল কুবরা
খুব সুন্দর গল্প!
রোকসানা খন্দকার রুকু
অশেষ কৃতজ্ঞতা 🥰❣️
হালিমা আক্তার
বাস্তবতার ছোঁয়ায় অসাধারণ একটি গল্প। শেহজাদরা সব সময় ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকতে চায়। মাছ ধরবে, জল লাগাবে না। শুভ কামনা রইলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
সুন্দর মন্তব্যে অশেষ কৃতজ্ঞতা ❣️🥰