মাামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১২)

শামীম চৌধুরী ১৬ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ০৪:৪৬:১৯অপরাহ্ন ভ্রমণ ২৩ মন্তব্য

আগের পর্বের লিংক-  মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১১)

পর্ব-১২

 

বনের শেষ প্রান্তের ৬ নাম্বার জোনে সারস ও ইউরোশীয় চামুচঠোঁটি সহ আরো কিছু প্রজাতি পাখির ছবি তুলে আমরা ৫ নাম্বার জোনের জন্য রওনা হলাম। দূরত্ব হবে আনুমানিক ৯০০ গজের মতন। এখানে বলে রাখা দরকার যে, কেওলাদেও বনের মূল ফটক হইতে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ১০ ফুট চওড়া সোজা পাঁকা একটি রাস্তা। মূল রাস্তার দুই ধারে সাইকেল বা পায়ে হাঁটার ৬ফুট চওড়া মাটির রাস্তা। সেখানে রিক্সা নিয়ে প্রবেশ নিষেধ। এমনকি গাইডদেরও প্রবেশের অনুমতি নেই। সেসব রাস্তা ধরে হাঁটলে অনেকটা বনের ভিতর যাওয়া যায়। জলাশয় থাকায় সেখানে প্রচুর কমনকুট,সাদা বড় বক,বেগুনী বক, কালিম, কালো-মাথা কাস্তেচরা সহ ১০-১২ প্রজাতির হাঁস জাতীয় জলজ পাখি দেখা যায়। পাখিগুলির বিচরন ও দৃষ্টিনন্দন উড়া-উড়িতে আপনাদের মন জুড়িয়ে যাবে। প্রকৃতিকে এদের দেহের বিভিন্ন রঙে এমন করে সাজিয়েছে যে, দেখে মনে হবে এরা সবাই প্রকৃতির অলংকার। প্রকৃতির রং সবুজ। এর বাহিরেও যে প্রকৃতি বিভিন্ন রঙে সাঁজতে পারে তার বড় প্রমান প্রকৃতিতে বসবাসরাত এই পাখিরা। পাখির কলতান, উড়াউড়ি, খাবার খোঁজা সহ নিজেদের মধ্যে মারামারি সবই করে থাকে প্রকৃতিতে। যার জন্য আমি প্রকৃতিকে এদের অভয়ারণ্য বলে থাকি।
 
বনের মূল সড়ক দিয়ে ৫ নাম্বার জোনে রিক্সায় আসার সময় রাস্তার দুই ধারে বাবলা গাছের ঝোপ নজরে পড়লো। পুরাটা রাস্তার দুই ধারে জলাশয় ও ডোবার পাড় ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা। ঝোপগুলি দেখে মনে হলো এখানে Black Bittern বা কালো বক থাকাতে। দীর্ঘদিন পাখি নিয়ে কাজ করায় কোন পাখির আবাস ও খাদ্যস্থল কোথায় বা কেমন পরিবেশে হবে তা আমার মুখস্থ। আমি বছর পাঁচেক আগে ঢাকার দক্ষিন কেরানীগঞ্জে এমন পরিবেশে Black Bittern বা কালো বকের দেখা পেয়েছিলাম। তবে ছবি তুলতে পারিনি। পরে কালো বকের ছবি পাই বাইক্কা বিলে। ছবি তেমন ভাল হয়নি। না হওয়ার কারন ঝোপের ভিতর এমন ভাবে ওঁৎ পেতে বসে থাকে যে,সেখানে আলো পর্যাপ্ত পাওয়া যায় না এবং ঝোপের ডালে ফোঁকাস করাটাও দুস্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জীতেন কি বললাম-“জীতেন জ্বী, আপ বোল সাকতে Black Bittern কাহা মিলেগ্যা”?
 
জীতেনরা পাখি সম্পর্কে এতই অভিজ্ঞ যে, বনের ভিতর কোন পাখি কোথায় দেখা পাওয়া যায় তা মুহুর্তের মধ্যে বলে দিতে পারে। তাছাড়া সব পাখির নাম জানে ও চেনে। এমনকি মাথার উপর দিয়ে কোন পাখি উড়ে গেলে বলে দিতে পারে, কোন পাখি উড়ে যাচ্ছে। এমন গাইড যদি কোন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে থাকে তবে সেই ফটোগ্রাফারের চাহিদার পাখির ছবি তুলতে কষ্ট হবার কতা নয়। আমারও তাই হয়েছিল। শুধু মাত্র মুখ থেকে বের করতে পারলেও হতো। এরা কোন পাখির বাংলা নাম জানে না। সব পাখি ইংরেজী নামে চেনে। তাই মাঝে মাঝে বাংলা নাম বললে জীতেন চুপ করে তাকিয়ে থাকতো।
 
জীতেন আমাকে আশার বাণী শুনালো। বললো সাহাব, আপকো Black Bittern জরুরৎ? ওকে ঘাবড়াইয়ে ম্যাত। জীতেন আপকা লিয়ে সব কুছ করেগ্যা। বলেই সে আমাকে রিস্কায় বসিয়ে নেমে গেল। আমি যে বাবলা গাছের ঝোপের কথা আপনাদের পূর্বে বলেছিলাম, সেখানে শুয়ে শুয়ে উঁকি দিয়ে ঝোপের ভিতর দেখতে লাগলো। আমার জন্য জীতেনের কষ্ট দেখে ওর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা বেড়ে গেল। আমি এই সুযোগে শরীরটা ছেড়ে দিয়ে বিশ্রামের জন্য রিস্কার গায়ে হেলান দিলাম। ভোর ছয়টা থেকে একটানা কিছুটা রিস্কায় কিছুটা হাঁটায় শরীরে ক্লান্তি এসেছিলো। কিন্তু বিশ্রামের সুযোগ জীতেন না দিয়ে মিনিট পাঁচেক পর ইশরায় ডাকলো। আমি বুঝে গেলাম জীতেন Black Bittern বা কালো বকের দেখা পেয়েছে। তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১০টা বেঁজে গেছে। রোদের তীব্রতাও বেড়েছে। শীতের দিনে রোদের তীব্রতা ভালই লাগে যদি আপনি পরিশ্রম না করেন। পরিশ্রম শরীরে সেই সোনা মাখা রোদের তাঁতাল আপনাকে বিষিয়ে তুলবে। আমার অবস্থাও তাই হয়েছিলো।
 
ওর ইশারায় আমি রিক্সা থেকে নেমে গেলাম। কুঁজো হয়ে ধীর পায়ে জীতেনের কাছে গেলাম। হাতের ইশারায় আমাকে শুয়ে পড়তে বললো। রোদের খড়া-তাপে সিমেন্টের ঢালাই রাস্তাটা তখন বেশ তপ্ত। সেদিকে নজর না দিয়ে Black Bittern বা কালো বকের ভাল ছবির নেশায় সব ভুলে গেলাম। ভাল কোন ছবির জন্য যে কোন কষ্ট বা পরিশ্রম আমি হাসি মুখে বরন করতে অভ্যস্ত। আর কষ্টের সঙ্গে মিতালীর পর যখন কোন পাখির ছবি মনের মতন পাই সেই আনন্দে সব কষ্ট ভুলে যাই। একটি ভাল মানের ছবির জন্য কষ্টটা তখন মনে হয় দৈনন্দিন রুটিন ওয়ার্কের মতন।
 
জীতেন ও আমি রাস্তার উপর শুয়ে আছি। জীতেন তার অভিজ্ঞতায় আমাকে যে ভাবে পাখিটি দেখানোর দরকার ছিলো সে ভাবেই দেখালো। আমার হাতে ক্যামেরা ও ভারী লেন্স। দুটার ওজন হবে প্রায় ৬ কেজি। পাঁকা রাস্তার উপর কুনুই গেঁঢ়ে আমাকে ফোকাস করতে হবে। পাখিটি ওঁৎ পেতে আছে মাছ শিকারের জন্য। আমার দিকে তাঁর চোখাচোখি হবার কোন সুযোগ নেই। তখন ওর নেশা ছিল মাছ শিকারের প্রতি। আমিও সেই সুযোগটা কাজে লাগালাম। কুনুইয়ের নীচে ক্যামেরা ও লেন্সর ওজন পড়ায় ব্যাথা হচ্ছিলো। সেই দিকে আমার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাল মানের একটা ছবি দরকার। কিন্তু ঝোপের ভিতর আলো সহায়ক নয়। কারন সূর্যের আলো ঝোপের পাতা ও ডাল ভেদ করে পাখির গায় স্পর্শ করার কোন সুযোগ নেই। তাতে কোন অসুবিধা হলো না। ক্যামেরার আলো মানে আই,এস,ও বাড়িয়ে সেটিংসটা ঠিক করে নিলাম। দম বন্ধ করে কয়েকটি ক্লিক করলাম। দুই হাতের কুনুই লেন্স ও ক্যামেরার ভার সইতে না পারায় লেন্সের সামনের দিকটা হঠাৎ করে পাকা রাস্তায় পড়ে ঠাস করে আওয়াজ হলো। সঙ্গে সঙ্গে চতুর পাখিটি এক নজর আমাকে দেখেই ফুরুৎ করে উড়ে গেল। যে কয়টা ক্লিক করেছি তাতেই চলবে। বাইক্কা বিল থেকে অনেক ভাল ও শার্প ছবি হওয়ায় আমি যানপরনাই খুশী। জীতেনের পরিশ্রম ও পাখিটিকে খুঁজে দেবার জন্য সঙ্গে সঙ্গে ৫০ রুপি বখশিস দিলাম। বখশিস পেয়ে জীতেন আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, সাব আপ আজনবী, হামারা মুল্লুকপে আয়া। বেটার পিকচার ল্যানেছে হাম খোশ। বহুত খোশ। আমিও জীতেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিক্সায় উঠে বসলাম।
কেওলাদেও বন থেকে তোলা।
 
ইংরেজী নাম Black Bittern বাংলা নাম কালোবক। এর বৈজ্ঞানিক নাম: Ixobrychus flavicollis। আঞ্চলিক ভাষায় কালা-বগলা নামেও পরিচিত। কালোবক Ardeidae গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Ixobrychus গণের অন্তভুক্ত এক প্রজাতির কালচে ছোট আকারের জলচর পাখি। দারুণ কুশলী এই বক বুদ্ধিমান-চতুর ও মাছ-ব্যাঙ শিকারে তুখোড়। স্থির ও নিশ্চল থাকতে ব্যাপক পারদর্শী এরা। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ওশেনিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এদের আবাস, প্রায় ৮৬ লক্ষ ৯০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের আবাস। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে, তবে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।
 
দৈর্ঘ্য ৫৮ সেন্টিমিটার। মাথার তালু এদের চকচকে স্লেট রঙের। এই রংটি ঘাড়-গলার উপরিভাগ হয়ে সারা পিঠে ছড়িয়ে গেছে কালো রং হয়ে। গলার তলা দিয়ে কমলাটে-নীল চওড়া একটা রেখা ঘাড়ের পাশ দিয়ে বুক অবধি নেমে এসেছে। বুকে খাড়া খাড়া কালচে টান। ঠোঁট লালচে ধূসর। পা ও পায়ের পাতা ঘন বাদামি।
 
কালোবক সাধারণত ঊষা ও গোধূলি বেলায় শিকার করতে বের হয়। ফুটফুটে জোছনা রাতেও শিকার করতে বের হয়। মাছ, ব্যাঙ,ছোট জলসাপ, পোকা-পতঙ্গ। ঘাসফড়িং এদের অতি প্রিয় খাদ্য।
(চলবে)
বাইক্কা বিল থেকে তোলা।
0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ