১৮ মার্চ ১৯৭১

উত্তাল-অগ্নিগর্ভ একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে দেশব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছিল। একদিকে সংগ্রামের প্রস্তুতি চলছে, অন্যদিকে চলছিল বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের আলোচনা। এক পর্যায়ে সবাই বুঝতে পারে যে আলোচনার নামে চলছে সময়ক্ষেপণ। বঙ্গবন্ধু আলোচনাতেই শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আলোচনার নামে প্রহসনের অভিযোগ আনেন। তিনি স্বাধীনতার দাবিতে অটল থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করছিলেন।
একাত্তরের এ দিনেই বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালী সৈনিকরা স্বাধীনতার সংগ্রামের জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কর্মীরা বাংলাদেশে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময় চালিয়ে যেতে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষ সামরিক প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মহিলা পরিষদের মেয়েরাও পিছিয়ে ছিল না। তাদেরও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী সামরিক ঘাঁটিকে শক্তিশালী করতে গোপনে গোলাবারুদ আর সৈনিক জড়ো করতে শুরু করেছিল। পাকিস্তানী শাসকরা স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমাতে এভাবে একটু একটু করে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। এদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁও-মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন. ‘এ ধরনের উস্কানি আর সহ্য করা হবে না।’
উনিশ শ’ একাত্তর সাল মার্চ মাস ছিল উত্তুঙ্গ গণজাগরণের সময়। অসহযোগ আন্দোলনের সপ্তদশ দিবস ছিল ১৮ মার্চ। এ দিনও সরকারী-বেসরকারী ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস-আদালত অনুপস্থিত থেকে সর্বশ্রেণীর কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত সংগ্রামের কর্মসূচী সফল করে তোলেন।
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে জনতা সারাদিন ধরে মিছিলের পর মিছিল করে চলমান আন্দোলনের সঙ্গে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও একাত্মতা ব্যক্ত করে। জনগণের কণ্ঠে উচ্চারিত সেøাগান ছিল- ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন. ‘তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। জনগণের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।’।
স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের দ্বারা বাঙালী হত্যার প্রয়াস বন্ধ করার আবেদন জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ অপর এক বিবৃতিতে বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারবার্তা প্রেরণ করে আসন্ন গণহত্যা ও যুদ্ধ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানান।
সুত্র : দৈনিক জনকণ্ঠ

১৯ মার্চ ১৯৭১
একেকটি দিন যেতে থাকে আর দেশব্যাপী উত্তেজনা বাড়তে থাকে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলতে থাকলেও এ কথা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, এ আলোচনা মূলত বাঙালী জাতির সঙ্গে প্রহসন। বাঙালীদের আর একবার বোকা বানিয়ে তারা আলোচনার নামে শুধু কালক্ষেপণ করছে। একাত্তরের এদিন ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে পাক সেনারা ক’জন নিরস্ত্র বাঙালী সৈনিককে গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে ক্ষোভে ফেটে পড়েন বঙ্গবন্ধু।
ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলার দিনগুলোতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী তাদের ঘাঁটিগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ গোলাবারুদ এবং সৈনিক সমাগম ঘটাতে থাকে। পাকিস্তানী স্বৈরাচার সরকার বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার আড়ালে এসব কার্যক্রম চালাতে থাকে।
দেশের অনেকে অবশ্য এদিন পর্যন্ত আলোচনা নিয়ে আশাবাদী ছিল। তারা ভেবেছিল আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা সমাধান চলে আসবে। কিন্তু হঠাৎ ঘটনার মোড় নেয় অন্যদিকে। জয়দেবপুরে নিরীহ বাঙালী সৈনিকদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক সেনারা। হত্যা করে বেশিকিছু বাঙালী সৈনিককে। এর ফলে পাকিস্তানী শাসকদের সঙ্গে আপোসের সব সম্ভাবনার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এমন অতর্কিতে হামলায় প্রথমে হতভম্ব হয়ে পড়লেও পরে দেশজুড়েই সবাই আক্রোশে ফেটে পড়তে থাকে। এই ঘটনার মধ্য দিয়েই পাকিস্তানী বাহিনীর মনোভাব সম্পর্কে বাঙালীর সংশয়ের অবসান ঘটে।
জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চায়। তার অর্থ এই নয় যে, তারা শক্তি প্রয়োগকে ভয় পায়। জনগণ যখন রক্ত দিতে তৈরি হয়, তখন তাদের দমন করতে পারে এমন শক্তি দুনিয়ায় নেই।’
জয়দেবপুরের ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দেয়। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পাকিস্তানী শাসকরা জয়দেবপুরে দীর্ঘ ২৯ ঘণ্টার কার্ফু জারি করে রাখে। কার্ফু উঠিয়ে নেয়ার পর পরই জয়দেবপুরের বিক্ষুব্ধ জনতা আবার পথে নেমে আসে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে শুরু করে। তারা প্রস্তুত হতে থাকে আসন্ন যুদ্ধের জন্য।
একাত্তরের ১৯ মার্চ ছিল অসহযোগ আন্দোলনের অষ্টাদশ দিন। প্রতিদিনের মতো সকল সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। সর্বত্র উড্ডীন ছিল কালো পতাকা। বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া খানের বৈঠক চলে দেড় ঘণ্টা। বৈঠক শেষে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু জানান, ‘আগামীকাল আবার বৈঠক হবে। দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আমাকে সাহায্য করবেন। আজ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টারা বৈঠকে মিলিত হবেন।’
সন্ধ্যায় উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট ভবনে। আওয়ামী লীগের তরফে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং সরকারের পক্ষে বিচারপতি এআর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান অংশ নেন। দু’ঘণ্টা স্থায়ী হয় আলোচনা। দু’দলের উপদেষ্টারা কি ফর্মুলার ভিত্তিতে আলোচনা হবে অর্থাৎ টার্ম অব রেফারেন্স নির্ধারণ করেন।
চট্টগ্রামে মওলানা ভাসানী বলেন, শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা অর্পণ ছাড়া পাকিস্তানকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রখ্যাত শিল্পী কামরুল হাসানের পরিকল্পনা ও ডিজাইনের বাংলা স্টিকার- ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালীর জীবন’ প্রথম প্রকাশিত হয় একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে।
সুত্র দৈনিক জনকণ্ঠ
এই তারিখে উল্লেখ যোগ্য ঘটনা  ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ গাজীপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ!/ সুলতান মির্জা

২০ মার্চ ১৯৭১
১৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পথে। বন্ধ হয়ে যায় সমঝোতার সমস্ত পথ। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা ছাড়া বাঙালীর সামনে কোন পথ খোলা ছিল না। নরঘাতক জেনারেল টিক্কা খানরা গোপন বৈঠক করে নির্বিচারে বাঙালী নিধনে অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে। যদিও চতুর্থ দফা বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু বলেন, আলোচনা আরও হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনা হচ্ছে- এই মর্মে জনৈক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘বাংলাদেশের সব খবর আমার জানা আছে।’
বাঙালী বুঝতে পারে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনায় বসাটা ছিল সম্পূর্ণ লোক দেখানো, প্রহসন মাত্র। আলোচনার আড়ালে পাকিস্তানে স্বৈরশাসকরা বাঙালীদের স্বাধীনতার সমস্ত আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার কৌশলে ব্যস্ত ছিল। এরই মধ্যে পাকস্তানী সামরিক জান্তারা নির্বাচনে বাঙালী নিধনে অপারেশন সার্চ লাইটের সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেলে। এদিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবদুল হামিদ ও জেনারেল টিক্কা খানের এক বৈঠক থেকেই অপারেশেন সার্চলাইটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। একাত্তরের ২০ মার্চ ছিল ঘটনাবহুল উত্তেজনাপূর্ণ একটি দিন। আন্দোলনে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু সংবাদপত্রে দেয়া এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসাবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। এবারের সংগ্রাম প্রতিটি শহর, নগর, বন্দর ও গ্রামে। আবালবৃদ্ধবনিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ, সারা বিশ্বের স্বাধীন জাতি কি ভাবে স্বীয় লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার মানুষ আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’
অসহযোগ আন্দোলনের ঊনবিংশ দিবসে একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনই বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতি দিয়ে ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উপলক্ষে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন। এদিন বিহারী ও পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালীর সংঘর্ষ হয়েছে মিরপুর, চট্টগ্রাম, পার্বতীপুর ও সৈয়দপুরে। আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।
সারাদেশে এক উত্তপ্ত পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। ক্ষুব্ধ বাঙালীরা পথে নেমে আসে। যুদ্ধের প্রস্তুতি চলতে থাকে দেশজুড়ে। কিন্তু তখনও পূর্ব পাকিস্তানবাসী বুঝতে পারেনি যে অতর্কিতেই তাদের ওপর চালানো হবে অপারেশন সার্চলাইট। জেনারেল ইয়াহিয়া খান এদিন তাঁর সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল হামিদ খান, টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতির পূর্ণ রূপ দেন। ওদিকে প্রতিদিনই ৬ থেকে ১৭টি পর্যন্ত ফ্লাইটে পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও যুদ্ধের রসদ আনা হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। স্থল ও বিমান শক্তি দ্বিগুণ করে।
সুত্র দৈনিক জনকণ্ঠ

মার্চ ১৯৭১ – আগুন ঝরা সেই দিনগুলো-৮

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ