মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-৮)

শামীম চৌধুরী ১৫ জুন ২০২০, সোমবার, ০২:০৭:৪৭অপরাহ্ন ভ্রমণ ২৪ মন্তব্য

আমরা সবাই ভোর ৫:০টায় ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। সকাল ৬:টার মধ্যে কেওলাদেও পার্কে প্রবেশ করলে পাখির বেশ কিছু ভাল ছবি পাব। কারন সকালে পাখিরা খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। বেলা ৯:০ টা পর্যন্ত পাখিরা বনে খাবার খুঁজে বেড়ায় ও খায়। সূর্যের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোদের তাপ থেকে রক্ষা পেতে কোন গাছের ডালের পাতার আড়ালে বা ঝোপের ভিতর চলে যায় । বিকেল ৩:০টা পর্যন্ত এভাবেই নিজেদেরকে ছায়ার রাখে। আর এটাই হচ্ছে তাদের চরিত্র।

 
বণ্যপ্রানীর ছবি তুলতে হলে প্রথমেই প্রানীদের অভ্যাস,প্রজননকাল,বাসা বানানোর সময়, বাচ্চা ফোঁটার সময়, খাদ্য ও চলাফেরা সম্পর্কে জানতে হয়। যিনি যত বেশী জানেন তিনি তত বেশী বণ্যপ্রানী ফটোগ্রাফীতে সাফলতা আনতে পারেন। শুধু ফটোগ্রাফীতে নয়। যে কোন কাজ করতে হলে সেই কাজ সম্পর্কে সম্যক ধারনা থাকলে খুব সহজেই সফলতা পাওয়া যায়।
 
দঃ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বন ও পাখির অভয়ারন্য ভরতপুরের কেওলাদেও। একটু জেনে নেয়া যাক কেওলাদেও সম্পর্কে-
কেওলাদেও জাতীয় উদ্যান (ইংরেজি: Keoladeo National Park) রাজস্থানের সিন্ধু -গঙ্গা নদীর বৰ্ষাকালীন জৈবভৌগোলিক অরণ্য যা প্ৰদেশের মাঝে অবস্থিত। এই উদ্যানের আয়তন ২,৭৮৩ হেক্টর। ১৯৮২ সনে এটিকে রাষ্ট্ৰীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯০০ সনেরও এটি মহারাজাদের আমলে শিকারের ক্ষেত্রে সংরক্ষিত অঞ্চল ছিল। ১৯৫৬ সনে এটি পক্ষী উদ্যানে পরিণত হয়। ১৯৭২ সন পৰ্যন্ত মহারাজাদের এখানে শিকার করার অনুমতি ছিল। ১৯৮১ সনে এটিকে রামসার জলাভূমি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৫ সনে প্ৰাকৃতিক সম্পত্তি হিসাবে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মৰ্যাদা লাভ করে।এখানে জলাশয়ের তীরবৰ্তী অঞ্চলটিকে দুটা অংশে ভাগ করা হয়েছে। জলস্তর সঠিক রাখার জন্যে পানি যোগানোর নিয়ন্ত্ৰিত ব্যবস্থাও গৃহীত হয়েছে। আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, চীন এবং সাইবেরিয়ার প্ৰায় ৩৬৪টি প্ৰজাতির পরিযায়ী পক্ষী এখানে শীতকালে আসতে দেখা যায়। সমগ্ৰ উদ্যানটি ১৭টি গ্রাম এবং ভরতপুর নগর দ্বারা বেষ্টিত।
 
কেওলাদেও ন্যাশনাল ফরেষ্টে আমার এই প্রথম দর্শন। পাখির ছবি তুলবো ভেবেই শরীরের ভিতর টান টান উত্তেজনা ছিলো। এমনিতেই যে কোন নতুন জায়গায় ভ্রমন বা নতুন পাখির ছবির জন্য আমি সবসময় উত্তেজিত হয়ে পড়ি। এমনই উত্তেজিত হই আমার পরিবার বা বন্ধুজন কথা মনে পড়ে না। ভরতপুরে আরো বেশী হলো।
 
আমাদের হোটেল কিওলাদিও ন্যাশনাল পার্কের কাছেই ছিলো ।আমরা সকাল ৫: ৪৫ মিনিটে পৌছে গেলাম। ভোর ৬:০০ টায় প্রবেশদ্বার খোলার সঙ্গে সঙ্গে পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দিয়ে বনের প্রবেশ টিকিট জনপ্রতি ভারতীয় রুপি ৫৫০টাকায় ক্রয় করলাম। মূল দরজা থেকে বনের শেষ পর্যন্ত দূরত্ব ১০ কিলোমিটার। সোজা একটি রাস্তা। মুল রাস্তার দুই পাশে পায়ে হাঁটার রাস্তা। দুই পাশে এমন পায়ে হাঁটার রাস্তা বিশটি। সেখানে কোন যানবাহন প্রবেশ করতে পারে না। যানবাহন বলতে রিক্সা ও সাইকেল।
 
এখানে বলে রাখা ভাল যে, রিক্সাচালকরা সাধারন রিক্সাওয়ালা নয়। তারা সবাই শিক্ষিত ও গাইড হিসেবে সেখানে কাজ করে। রিক্সা ভাড়া সহ গাইডের পারিশ্রমিক ঘন্টা হিসেবে দিতে হয়। প্রতি ঘন্টা ভারতীয় রুপীতে ১৫০ টাকা। ভোর ৬:০টা থেকে সন্ধ্যা ৬:০টা পর্যন্ত আমরা প্রতিদিন ১৮০০টাকা দেই। একটি রিক্সায় দুইজন বসা যায়। সে হিসাবে আমাদের জনপ্রতি প্রতিদিন ৯০০ রুপি খরচ হয়। সাইকেল ভাড়া প্রতিটি ৫০ রুপি। তাতে ৬০০ রুপি ভাড়া। আমরা প্রথমদিন রাস্তা ও স্পটগুলি জানা বা চেনার জন্য গাইডের সুবিধা পেতে রিক্সা ভাড়া নেই। পরের দিন সাইকেল ভাড়া নেই। কোন ইঞ্জিনচালিত গাড়ি নেই। তার মূল কারন শব্দ দূষন। শব্দ দূষনে যেন পাখির অসুবিধা না হয় সেটা মাথায় রেখেই ভারত সরকারের বন বিভাগ এই পদক্ষেপ নেয়।
 
ভারতীয় দেশীয় পাখির পাশাপাশি সারা বিশ্ব থেকে প্রায়ই ৩৬৪ প্রজাতির উপরে পরিযায়ী পাখি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে খাবারের জন্য এই বনে উড়ে আসে। শুধু বণ্যপ্রানী নয়। যে কোন প্রাণীই অবাধ নিরাপত্তা পেলে সেখানে মুক্ত ভাবে চলাফেরা বা বিচরন করে। এখানে উল্লেখ্য যে, অনেক ভারতীয় পাখি আছে যা আমাদের দেশীয় পাখি। নামও এক। ভারত থেকেই কিছু কিছু প্রজাতির পাখি সংখ্যায় দুই থেকে চারটা আমাদের দেশের বিভিন্ন নদী ও হাওড়ে আসে। তারা খুব একটা সময় আমাদের দেশে থাকে না। তবে যে সব প্রজাতির পাখি শুরু থেকেই আমাদের দেশে
পরিযায়ী হয়ে আসছে তারা প্রতিবছরই আসে এবং তিন মাসের অধিক দেশে অবস্থান করে। সঙ্গে আরো নতুন পাখি নিয়ে আসে। ভারত,বাংলাদেশ,মায়ানমার, ভুটান,নেপাল পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় শীতের মৌসুমে বেশ কয়েক প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বিচরন দেখা যায়। তার মধ্যে ওযেদার বা জলজপাখি বেশী। হাঁস ও বক জাতীয় পাখি সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য।
 
ইহা ছাড়াও আমাদের দেশে উপকূলীয় এলাকয় বেশ পরিযায়ী পাখী শীতে চলে আসে। একেকটি ঝাঁকে এক প্রজাতির পাখি কম পক্ষে ১৫০০-২০০০টি সংখ্যায় থাকে। আমাদের সকলের উচিত এই পরিযায়ী পাখি সহ দেশের সব আবাসিক পাখির সংরক্ষন ও জীবন রক্ষা করা। যে দেশ বণ্যপ্রানীর পরিচর্যা ও সংরক্ষন করেছে সে দেশে প্রকৃতি ভারসাম্য দিয়ে মানব জাতিকে উপকার করছে। তাই বন্যপ্রাণীরা প্রকৃতির অলংকার। বনের ভিতর কোন মানুষ দ্বারা গাছ লাগানো সম্ভব না। প্রকৃতির এই প্রানীরাই পরগায়নের মাধ্যমে বনে গাছ জন্মাতে সাহায্য করে। যত বেশী বন্যপাখীগুলি সংরক্ষন করা যাবে ততবেশী দেশ বনায়ন হবে। মানুষও থাকবে সুস্থ্য। কারন বন অক্সিজেনের ফুসফুস।
 
আমরা বন বিভাগ ও পার্কের যাবতীয় কাজ শেষ করে তিনটি ভাড়ার রিক্সায় ২জন করে মোট ৬জন বনের ভিতর প্রবেশ করলাম।
 
(চলবে)
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ