মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২৮)

শামীম চৌধুরী ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, বুধবার, ০৭:২৪:০০অপরাহ্ন ভ্রমণ ১৯ মন্তব্য

আগের পর্বের লিঙ্ক-মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২৭)

পর্ব-২৮

আমরা সকাল ১১:৩০মিনিটে মধপুর জেলার গড়িয়ানা শহরের হোটেল কিং ভ্যালীতে পৌঁছালাম। আগে থেকেই আমাদের জন্য হোটেল রিজার্ভেশন করা ছিল। গাড়ি থেকে নামার পর হোটেল বয় আমাদের মাল-সামানা নিয়ে গেল। আমরা অভ্যর্থনা রুমে যাবতীয় কাজ শেষ করে যার যার রুমে গেলাম। রুমে মালপত্র রেখে ওয়াশ রুমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
 
রন্থাম্ভোর বনে আমাদের প্রথম দিনের সাফারী ছিলো দুপুর ২:৩০ মিনিটে। আমরা নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই পৌছে যাওয়ায় ঘন্টা খানিক বিশ্রামের সুযোগ পেলাম। যদিও সকালের ভ্রমনে তেমন কোন ক্লান্তির রেশ শরীরে নাই। তারপরও বিশ্রামের যেহেতু সুযোগ মিললো তাই রুমের ভিতর বিছানায় শরীর ছেড়ে দিলাম।
 
দুপুর ১:০০ টার সময় সবাইকে লাঞ্চের জন্য ডাকা হলো। হোটেলের ৫ম তলায় ডাইনিং রুমে খাবারের আয়োজন ছিল। আমাদের রুম হোটেলের ৩য় তলায় ছিলো। সিঁড়ি বেঁয়ে ৫ম তলায় ডাইনিংয়ে গেলাম। খাবার পরিবেশনের আগে আমাদের ট্যুর অপারেটর সুজিত বেরা বলেন, যে কয় বেলা এই হোটেলে খাবো তাতে চমক থাকবে। আমরা কৌতুহুলী হলাম। জানতে চাইলাম চমকটি কি? সুজিত বেরা হেঁসে বললেন দাদা, আগে থেকে বললে সেটা আর চমক থাকবে না। তাই চাপ নিবেন না। আরামছে বসেন। খাবার আসলেই বুঝতে পারবেন। কেমন চমক আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সুজিতের এমন কথায় আমরা সবাই খুশী হলাম।
 
হোটেল ম্যানেজার কোলকাতার বাঙালী। সুজিতের বাল্য বন্ধু। তাঁকে বলে রেখেছিলো আমরা সবাই বাংলাদেশ থেকে আসছি। পাঠক বন্ধুরা, হোটেলের ম্যানেজারের নামটা বলা হয়নি। তাঁর নাম অরবিন্দ কুন্ড। খুব হাসি-খুশী ও মৃদুভাষীর একজন মানুষ। বয়স আনুমানিক ৪২ বছর। বিশাল দেহের অধিকারী। গায়ের রং উজ্জল শ্যামলা। তাঁর সঙ্গে কথায় বুঝতেই পারলাম না বর্তমানে আমরা রন্থাম্ভোরে আছি। আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করবেন বলে অরবিন্দ কুন্ড আমাদের সঙ্গেই ছিলেন।
 
কথার মাঝে ক্যান্টিন বয় এক এক করে খাবারের আইটেম নিয়ে আসলো। প্রথমেই এলো লাল আটার রুটি, তারপর টমেটো,শসা,গাজর,বীট ও লেটুস পাতার সালাদ। পর্যায় ক্রমে বাসমতি চাউলের ভাত, মুরগীর মাংস, বেগুন ভাজি, সামুদ্রিক মাছ, পনির আলুর দম ও ডাল। সুজিতের চমক দেখে সবাই চমকে গেলাম। খাবারের ম্যানু দেখে আমরা সবাই বিস্মিত হলাম। কারন, যে রাজ্য জুড়ে নিরামিষভোজী মানুষের বসবাস সেখানে আমিষ জাতীয় খাবার যেন আলাদিনের চেরাগ পাবার মতন।
আমার ভাবছিলাম স্বপ্ন দেখছি নাতো!
অনেক দিনের দেশীয় খাবারের অভাবটা আজ পূরন হবে ভেবে সতীর্থরা সবাই আনন্দিত হলো। আমার ছেলে বলেই উঠলো, আজ ৫দিন পর আমরা দেশের খাবার খাচ্ছি।
 
আমরা তৃপ্তি সহকারে পেট পুরে সবাই খেলাম। খাওয়ার ফাঁকে অরবিন্দকে প্রশ্ন করলাম। দাদা, এই খাবার কি করে জোগাড় হলো? তার জবাব ছিলো, কোলকাতার ট্যুরিষ্ট যারা আসেন তারা সবাই বাঙ্গালী। আমার হোটেলেই সবাই উঠে। হোটেলের রুম ও বনের গাড়ী বন্দোবস্তের জন্য যখন তাকে কনফার্ম করা হয় তখন তিনি এই খাবারের আয়োজন করেন। আমরা আসবো সেটা সুজিত দুই মাস আগেই বলেছিলো। তার বাসায় মুরগীর ফার্ম আছে। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী গোপনে মাছ সরবরাহ করে। তবে এসব খাবার জোগাড়ে তার বেশ বেগ পেতে হয়। তারপরও বাঙালী ট্যুরিষ্টদের জন্য তাঁকে এসব করতে হয়। আমিষভোজীদের জন্য এমন খাবারের ব্যাবস্থা করতে পারায় নিজেকে খুব গর্ববোধ করে। আর পর্যটকরাও তার আতিথিয়েতায় মুগ্ধ।
 
খাবার পর আমরা হোটেলের গেষ্ট রুমে বসলাম। তখন সময় দুপুর ১:৪৫মিনিট। অরবিন্দ জানালো কিছুক্ষনের মধ্যে বনের ভিতরে সাফারীর জন্য গাড়ি চলে আসবে। তবে আজকের জন্য জিপসী জীপ গাড়ি বন্দোবস্ত করতে পারে নাই। কারন অঘোষিত কয়েকটি শিক্ষা সফরের জন্য বেশ কয়েজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসেছেন। তারা সবাই জিপসী জিপ গাড়িতে ঘুরবেন। তবে আগামীকাল ভোরের সাফারীতে আমাদের জন্য জিপসী জীপ বরাদ্দ থাকবে।
 
অরবিন্দের কথা শুনেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারন আমাদের সাফারী করতে হবে ২০ সিটার কেন্টারে। আমরা ৬ জন ফটোগ্রাফার। কিন্তু কেন্টারে ২০ জনের সিট। বাকিরা ফটোগ্রাফার হবে না। ফটোগ্রাফাররা কখনো বনের ভিতর এত জনের সঙ্গে সফর করেন না। কেন্টারে বাকিরা সবাই যে পর্যটক সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হলো না। অরবিন্দকে অনুরোধ করলাম। কোন ভাবে জিপসী জিপ যোগাড় করা যায় কি না। সে সাফ জবাব দিলো এখানে তার কোন হাত নেই। বন বিভাগ কেন্টারের বন্দোবস্ত করেছে। কেন্টারে আমাদের যে সমস্যায় পড়তে হবে সেটা হলো, বাকিরা জীব-জন্তু দেখেই চিৎকার করবে। হৈ-হুল্লোড় করবে। তাতে আমাদের ছবি ধারন করতে সমস্যা হবে। জীব-জন্তু বা পাখি মানুষের চিৎকারে দূরে সরে যাবে। এসব সাফারীতে সমমনার লোক না হলে ছবি তোলা দুস্কর।
 
অগ্যতা আমাদের কেন্টারেই সাফারী করতে হবে সেটা নিশ্চিত হয়ে মন খারাপ করে বসে ছিলাম। ঠিক ২:০০টার সময় আমাদের হোটেলে কেন্টার চলে আসলো। লক্ষ্য করলাম পুরা কেন্টার খালি। গাড়ির চালক ও বন বিভাগের গাইড ছাড়া আর কেউ নেই। কেন্টারের এমন অবস্থা দেখে মনে মনে খুশী হলাম। কারন ভাবলাম আমরা ছাড়া বোধহয় আর কোন পর্যটক এই কেন্টারে সাফারীতে যাবে না। খুশী ভরা মনে কেন্টারে উঠলাম। আমাদের গাইডের নাম ছিল সঞ্জিত কর্মকার। সেও কলকাতার বাঙ্গালী। সঞ্জিত কে পেয়ে মনে মনে খুশী হলাম। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, তুমি আমাদের ভাগ্যটা সুপ্রসন্ন করে দিয়েছো। বাঙালী গাইড হওয়াতে আমরা মন খুলে কথা বলতে পারবো। আমাদের পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে পারবো।
 
সঞ্জিত আমাদের নিয়ে রন্থাম্ভোর অফিস পাড়ায় ছুঁটলো। আমাদের হোটেল থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে বনের অফিস। সেখানকার আনুষাঙ্গিকতা শেষ করার পর বনের ভিতর প্রবেশের পাশ পাওয়া যাবে। অফিস পাড়া থেকে মূল বনের প্রবেশ মুখ আরো এক কিলোমিটার দূরত্ব। সুজিত বেরা আমাদের সবার প্রবেশ মূ্ল্য প্রতিজন ২০০০ হাজার রুপি গাইডকে পরিশোধ করলো। গাইড আমাদের গাড়িতে বসিয়ে অফিসের ভিতরে গেল।
 
কিছুক্ষন সময় লাগবে বনের ভিতর প্রবেশের পাশ সংগ্রহে। তাই আমি কেন্টার থেকে নামলাম। কারন অফিসে প্রবেশের সময় মূল ফটকের সামনে কারুকার্য খঁচিত উটের গাড়ি দেখেছিলাম। রাজস্থান মরুভুমির অঞ্চল। এখানে উট ও ময়ূরের সংখ্যা বেশী। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, সমগ্র ভারত জুড়ে যত উট ও ময়ূর আছে তার দ্বিগুন রাজস্থান রাজ্য জুড়ে দেখা যায়। তাই মরুভূমির জাহাজ উটের ছবি তুলবো না তা কি করে হয়? আমার পাঠক বন্ধুদের সেই কারুকার্য খঁচিত উটের গাড়িটি দেখার অনুরোধ রইলো।
অফিসে কাজ শেষ করে আমাদের নিয়ে কেন্টার বনের ভিতর প্রবেশের মূল ফটকে ছুঁটলো। তখন কেন্টার জুড়ে আমরা ৬ জন ছাড়া আর কেউ নেই। মনে মনে আনন্দিত হলাম। ভাবলাম যাক এই যাত্রায়ও সৃস্টিকর্তা আমাদের ভাগ্য খুলে দিলেন। প্রতিজনের টিকিট মূল্য ভারতীয় রুপি ৫০০ করে বাঁচলো।
 
এমনটি ভাবতে ভাবতে মূল ফটকের সামনে কেন্টার দাঁড়ালো। সঞ্জিত কর্মকার বনের পাশ নিয়ে ভিতরে গেল। আমরা সবাই গাড়িতে বসা। কাজ শেষ করে সঞ্জিত যখন ফিরলো তখন দেখলাম তার সঙ্গে আরো ১৪ জন পর্যটক। গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তর যা পেলাম তা’হলো বিদেশী পর্যটকদের পাসপোর্টের ফটোকপি ও প্রবেশ মূল্য অফিস পাড়ায় জমা হয়। আর ভারতীয় নাগরিকদের আইডি কার্ড এর ফটোকপি জমা ও প্রবেশ মূল্য এখানে নেয়া হয়। এ ব্যাবস্থা শুধুমাত্র বিদেশী পর্যটকদের সঙ্গে ভারতীয় নাগরিকদের আলাদা করার জন্য।
এত লোক দেখে মনটা বিষিয়ে উঠলো। অধিকাংশ টিন এজার। শুধুমাত্র একটি পরিবারে ৬ জন ছিলো সদস্য ছিলো বিভিন্ন বয়সের। গাড়ি ছাঁড়ার আগে গাইড সবার উদ্দেশ্যে একটা ব্রিফ দিলো। বন সম্পর্কে একটা ধারনা দিলো। বনে কি কি জন্তু জানোয়ার দেখা যেতে পারে তা বললো। পরিশেষে ভারতীয় যুবকদের বলল তোমাদের সঙ্গে ৬ জন বিদেশী আছে। তারা সবাই প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। তাই তাদের সম্মানে তারা যেন চুপ থাকে। কোন উচ্চ স্বরে যেন চিৎকার না করে। যতক্ষন সময় ও যে জায়গায় গাড়ি থামাতে বলবে সেখানে গাড়ি দাঁড়াবে। কারন তারা মেহমান। তাদের কাজে সহায়তা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
 
সঞ্জিত কর্মকারের এমন বক্তব্যে মনের ভিতর সাহস সঞ্চার হলো। ভাবলাম আমরা বাঙালী বলেই এমন আচরন করেছে সঞ্জিত। পরে জানলাম বিদেশী ফটোগ্রাফারদের জন্য এটা বন বিভাগ থেকেই তাদের উপর নির্দেশ দেয়া আছে।
 
স্যালুট সঞ্জিত কর্মকার।
(চলবে)
0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ