মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৭)

শামীম চৌধুরী ২৫ আগস্ট ২০২০, মঙ্গলবার, ০৮:০৩:৪০অপরাহ্ন ভ্রমণ ২৪ মন্তব্য

আগের পর্বের লিঙ্ক- মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৬)

পর্ব-১৭

মেটে হুতুমপ্যাঁচার ছবি তুলে আমরা ৩ নাম্বার জোনের প্রবেশ মুখে আসলাম। জোনের ভিতরের মূল রাস্তা ধরে হাঁটার সময় মনে হলো ভারতীয় ফটোগ্রাফার অক্ষয় ভগ্যতের সহধর্মনীর কথা। তাঁদের সঙ্গে পরিচয় হবার সময় বলেছিলেন ৪ নাম্বার জোনে Pelican বা বড়-গলা গগণবেড় ছবি তুলেছেন। Pelican এর কথাটা মাথায় ছিলো। Pelican এর ছবি ঢাকা মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক ছাড়া আমাদের দেশে কোথাও দেখা যায় না। আর সেটি কেইজ বার্ড। ২০১০ সালে তুলেছিলাম। কেইজ বার্ডের ফটোগ্রাফীর কোন মূল্য নেই। ফটোগ্রাফারদের কাছে সেটা খাঁচার পাখি হিসেবে বিবেচিত। বার্ড ফটোগ্রাফাী যারা করেন তাদের লক্ষ্য বনের পাখি।
 
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় ১৯ শতকে ঢাকায় এই পেলিকেন দেখা গিয়েছিলো। দীর্ঘ বছর চলে গেলেও এই পাখি পরিযায়ী হয়ে কখনই দেশে আসে নাই। সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে Painted Stork বা রাঙা-মানিকজোড় বা রঙ্গিলা বকের ঝাঁকে একটি Pelican পাখি দেখা যায়। সেদিন ছিলো বুধবার। সময় বিকাল ৫:০০টা। রাজশাহীর একজন বার্ড ফটোগ্রাফার ও কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা হাসনাত রনি Pelican বা গগনবেড়ার ছবি তুলেন। তিনি আমার অনুজ হলেও বন্ধুর মতন ছিলেন। গগনবেড়ার ছবি তোলার পর সন্ধ্যা ৭:০০টায় আমাকে কল দিয়ে বলেন মেসেঞ্জার বক্স চেক করেন। আজ বিকেলে Pelican পাখিটি পেলাম। আমি ফোন কেটে ম্যাসেঞ্জার চেক করি। ছবি দেখে রীতিমত ভড়কে যাই। উত্তেজনায় শরীর স্থির রাখা আমার জন্য খুবই কষ্টকর ছিলো। অস্থিরতা বেড়ে যায়। পরে রনিকে কল দেই। রনি বলেন, মিয়াভাই, যদি ছবি তুলতে চান তবে আজ রাতের বাসে রাজশাহী চলে আসেন। আমি অনিক মাঝিকে বলে রাখবো। অনিক আপনাকে স্পটে নিয়ে যাবে। অনীক নৌকার মাঝি হলেও পাখি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখে। প্রায় সব প্রজাতি জলজ পাখির নাম তাঁর জানা। আমি রনির সঙ্গে কথা শেষ করে অনিক মাঝির সঙ্গে কথা বলি। রাজশাহী যাবার ব্যাপারটা নিশ্চয়তা করি। রাতেই নৌকার ইঞ্জিনের ডিজেল জোগাড় রাখতে বলি। ওর বিকাশ একাউন্টে ১০০০ টাকা বিকাশ করি।
 
শ্যামলী রিং রোডে থাকে আমার পুত্র সমতুল্য বণ্যপ্রানী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ। আদনানকে কল দিয়ে ঘটনা বলি। ও সঙ্গী হবার আগ্রহ প্রকাশ করে। ওর আগ্রহ দেখে আশ্বস্ত হই যে, একা একা যাবার চেয়ে একজন সঙ্গী থাকলে ভালই হয়। তাই আদনানকে রাত ১২টার বাসের টিকিট সংগ্রহ করতে বলি। ব্যাটারী চার্জে দিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র ক্যামেরার ব্যাগে গুছিয়ে নেই। যথা সময়ে কল্যাণপুর বাস স্ট্যান্ডে পৌছাই।
 
ভোর ৫টায় রাজশাহী নামলাম। হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে অটোতে পদ্মার টি-বাঁধ ঘাটে পৌঁছালাম। অনিক আমাদের জন্য দুপুরের হালকা নাস্তা ও পানি সহ ঘাটে অপেক্ষায় ছিলো। সকাল ৬:৩০ মিনিটে নৌকা ছাড়লো। অনিক জানতে চাইলো প্রথমে কোথায় যাবে। Pelican পাখিটির দেখা যেখানে পেয়েছে সেখানে যেতে বললাম। কুড়ি মিনিটের মধ্যে পাখিটির জায়গায় পৌঁছালাম।
হায়..!! বিধি বাম।
সেখানে কোন পাখির দেখা মিললো না। এমনকি Painted Stork বা রাঙা-মানিকজোড়ও না। পদ্মার ৭টি চর তন্ন তন্ন করে পাখিটিকে খুঁজলাম। বিকেল গড়িয়ে এলো। অথচ পাখিটির দেখা পেলাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। যদিও ভাগ্যের উপর কোন হাত নেই। মনকে সেই সান্তনা দিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলাম। কিছু অন্য পাখির ছবি তুলে রাতের খাবার সেরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
 
রাতটুকুর ব্যাবধানে পাখিটি না পাওয়ার কারন আদনানের কাছে জানতে চাইলাম। আদনান যে উত্তর দিলো তার বর্ননা দিচ্ছি-
Painted Stork বা রাঙা-মানিকজোড় এবং Pelican বা গগনবেড়া মূলতঃ উত্তর আমেরিকার আবাসিক পাখি। নভেম্বরের শুরুতে তাদের আবাসস্থলে বরফে ঢেকে যায়। যার ফলে এদের খাবার সংকট হয়। আর Painted Stork বা রাঙা-মানিকজোড় স্থায়ীভাবে আমাদের দেশে পরিযায়ী হয়ে আসে না। এরা মূলতঃ ভারতের বিভিন্ন রাষ্ট্রে চলে যায়। আসামে Painted Stork বা রাঙা-মানিকজোড়ের যে ঝাঁকটি আসে তারা শুধুমাত্র খাবারের জন্য রাজশাহীতে আসে ও খাবার শেষে সন্ধ্যার আগেই আসামে চলে যায়। সেই কারনে আমরা রাঙা মানিকজোড় দেখতে পাই। Pelican সম্ভবত দলছুট হয়ে Painted Stork বা রাঙা-মানিকজোড়ের সঙ্গে পদ্মার চরে রাতটুকু বিশ্রামের জন্য ছিলো। রাতে খাবার খেয়ে সূর্য উঠার আগেই চলে যায়। তারা রোষ্টিং এর জন্য ছিল। আর হাসনাত রনি ভাগ্যবান হওয়ায় সেই মুহুর্তে পাখিটির দেখা পায় ও ছবি তুলে। পরে আমি বাসায় এসে বই পড়ে আদনানের কথার সত্যতা পেলাম।
 
অথচ ভরতপুরের কেওলাদেও বনে শত শত Pelican পাখির দেখা পেলাম। আনন্দে মনটা ভরে গেল। কারন এরা খাঁচার পাখি নয়। বনের পাখি। আমরা যে সময়টায় Pelican পাখির ছবি তুলতে যাই তখন বিকেল। সারাদিন খাবার খেয়ে তখন ওদের বিশ্রামের সময়। তাই প্রথম দলটিকে খুব একটা কাছে পেলাম না। অথচ এই ৩ নাম্বার জোনের শেষ প্রান্ত থেকে যতটুকু কাছে পেয়েছি ততটুকু কাছে পরের দিন ৪ নাম্বার জোনে পাইনি। তবে আমরা উড়ন্ত Pelican এর ছবি ভাল পেয়েছি।
আমি আমার পাঠক বন্ধুদের নিকট Pelican পাখির ছবি ও পরিচয় তুলে ধরলাম।
“বড় গলা গগণবেড়” Pelecan
 
“বড় গলা গগণবেড়” Pelecanidae পরিবারে অন্তর্ভুক্ত একটি বৃহদাকার জলচর পাখি। যাহার দৈর্ঘ্য ১৮২ থেকে ১৮৫সেঃমি এবং ওজন ১১ থেকে ১২ কেজি। বিশ্বে ৯ প্রাজাতির Pelican বা গগণবেড় দেখা যায়।
 
বিশালদেহী জলচর “বড় গলা গগণবেড়” পাখিটি অত্যন্ত লম্বা। ঠোঁট ভারী ও নমনীয়। ঠোঁটের উপরি ভাগ চ্যাপ্টা ও শেষমাথায় বাঁকানো। গলায় বিশাল থলি আছে। যখন থলিটিকে প্রসারিত করে তখন যে কোন শিশু বাচ্চাকে অনায়াসে সেই থলির ভিতর বসিয়ে রাখা যাবে। প্রজননের সময় পুরুষ পাখির দেহ সাদা ও মাথার পিছনে ঝুঁটি ঝুলে থাকে। কপালের পালক ঠোঁটের উপর থরে থরে সাজানো থাকে। ডানার দু’পাশে কালো দাগ স্পষ্ট দেখা যায়। চোখ গাঢ় লাল বর্ণের। ঠোঁটের প্রান্তও লাল হয়। ঠোঁটের মাঝখানে হালকা খয়েরী-নীল বর্ণের ও মাঝখানটায় সাদা বিন্দুর নকশা করা। ঠোঁটের নীচের অংশ হলুদ বর্ণের। গলায় বড় থলি আছে। যা প্রয়োজনে প্রসারিত করে। থলের চামড়া হলুদ। প্রজনন সময় ছাড়া এরা পালকহীন থাকে। তখন মাথায় ঝুটি থাকে না। এদের শরীরে পালক বাদামী সাদা। ঘাড় ও পিঠ বাদামী।
 
এরা হাওর,বিল, বড় বড় জলাশয় ও উপকূলে বিচরন করে। সচারচর জোড়ায় থাকতে পছন্দ করে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঝাঁকেও থাকে। সাঁতার কেঁটে পানিতে ভেসে এরা আহার খোঁজে। মাছ ও চিংড়ি জাতীয় প্রাণী এদের প্রিয় খাবার। শিকারের সময় অগভীর পানিতে মাছের ঝাঁক ঘিরে ফিলে। বিশাল হা করে নীচের ঠোঁট পানিতে ডুবিয়ে গলার থলি প্রসারিত করে জালের মত বিস্তার করে মাছ শিকার করে থাকে। এদের মাছ শিকারের পন্থাটা অভিনব। শিকারের ফাঁকে ফাঁকে ঘোঁত ঘোঁত শব্দ করে। এরা ব্যাঙের মত কর্কশ গলায় ডাকে।
“বড় গলা গগণবেড়” Pelecan
ফ্রেব্রুয়ারী থেকে এপ্রিল মাস এদের প্রজনন সময়। প্রজননের পর ভারতের গুজরাট ও মধ্য এশিয়ায় হাওর বিল বা জলাশয়ের ধারে মাটিতে ডাল-পালা দিয়ে বাসা বানায়। নিজেদেরে বানানো বাসায় ৩ থেকে ৪টি ডিম পাড়ে। এদের ডিম ফুঁটতে এক মাসের অধিক সময় লাগে। বাচ্চা ফুঁটতে সময় নেয় প্রায়েই ৬০-৭০ দিন।
এরা বাংলাদেশে অনিয়মিত পাখি। শেষ দেখা যায় ২০১৭ সালে নভেম্বর মাসের শেষে রাজশাহীর পদ্মার চরে। ইহা ছাড়া ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, আফ্রিকা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলে এদের বৈশ্বিক বিস্তৃত আছে।
“বড় গলা গগণবেড়” Pelecan
আমরা ৩ নাম্বার জোনে বেশ কিছু পাখির ছবি তুললাম। এখানে ৫ প্রজাতি বকের দেখা পাইলাম। খোঁড়লে প্যাঁচা সহ বিভিন্ন প্রজাতির ছবি তুললাম। আস্তে আস্তে সূর্য পশ্চিমে ঢেলে পড়লো। আলোর স্বল্পতার জন্য আজকের মতন ছবি তোলার কাজ শেষ করে বন থেকে বের হলাম। কেওলাদেও বনের মূল ফটকে ক্যান্টিনে গরম গরম চা ও বিস্কুট খেয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে গাড়ীতে উঠলাম।
(চলবে)
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ