মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৬)

শামীম চৌধুরী ২৩ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ০৭:৩৫:৪৩অপরাহ্ন ভ্রমণ ২২ মন্তব্য
পর্ব-১৬
তখন সময় বিকাল সাড়ে চারটা। আমরা ৪ নাম্বার জোনটা সফলতার সঙ্গে শেষ করলাম। কিছু নতুন পাখি ও পূ্র্বের তোলা পাখির ভাল ভাল শট পেয়ে সবাই আনন্দিত হলাম। ৩ নাম্বার জোনে যাবার জন্যে হাঁসতে হাঁসতে জোন থেকে বের হয়ে যার যার রিক্সায় চড়লাম। এই জোনের পথে বনের ক্যান্টিন। তাই চা-পানের জন্য কুড়ি মিনিট বিরতি নিলাম। গরম গরম চা-পান করে শরীরটাকে জুড়িয়ে নিলাম। চা-পানের ফাঁকে ফাঁকে কে, কোথায় কি, কি ভুল করেছে তার আলোচনা চলছিলো। কেউ কেউ তাদের তোলা ছবি কেন শার্প হলো না তারও ব্যাখ্যা চাচ্ছিল। আমি আমার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থেকে সততার সঙ্গে সবার প্রশ্নে উত্তর দিয়ে গেলাম। দলবদ্ধ ভাবে ছবি তুলতে গেলে আমারা ছবির ভুল-ত্রুটিগুলি তুলে ধরি। এটাও ফটোগ্রাফীর একটা অংশ বা শিক্ষা। যারা এই শিক্ষাটাকে কাজে লাগিয়ে ভুলগুলি শুধরে নিতে পারেন তাদের জীবনেও ভবিষ্যতে আর একই ধরনের ভুলের পুনঃবৃত্তি ঘটে না। দলবদ্ধ হয়ে ছবি তুলতে গেলে ফটোগ্রাফীর উপর অঘোষিত একটা ওয়ার্কশপ হয়ে যায়। এই ওয়ার্কশপটি আমাদের আগামীতে অনেকের জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
 
আমিও আমার অনুজদের কাছ থেকে সময় সময় অনেক কিছু শিখেছি। ছোট বা বড় কারো কাছ থেকে শিক্ষা নিতে আমি কখনই লজ্জ্বাবোধ করি না। শিক্ষার কোন বয়স নেই। সেটাকে আদর্শ মনে করি। একটা ঘটনা আপনাদের মাঝে শেয়ার করি। আমার পুত্র সমতুল্য বণ্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফ থেকে কি করে বনের পাখির সঙ্গে মিতালী গড়তে হয়ে তা শিখেছিলাম। শিখেছিলাম বালু যদি ব্যাকগ্রাউন্ড হয় তবে কত আলোতে মানে আইএসও তে ছবি তুলতে হবে। শিখেছিলাম ভোরের আলো ফোঁটার আগে বনের ভিতর মাত্র ৮-১০ শাটার স্পীডে ছবি তুলতে হয়। এখনও শিখতে খুব আগ্রহ বোধ করি। যদি সে শিক্ষাটা গঠনমূলক হয়।
 
বিকেল ৫:১৫ মিনিটে আমরা ৩ নাম্বার জোনে পৌছালাম । জোনে প্রবেশের আগে মূল সড়কের হাতের ডান দিকে বেশ খানিকটা দূরে গাইড জীতেন একটা বাবলা গাছ দেখিয়ে বলে সাহাব উধার Dusky eagle-owl বা মেটে হুতোমপ্যাঁচা হ্যায়। সাত ম্যা বাচ্চাভিও হ্যায়। জীতেনকে রিক্সা থামাতে বললাম। সঙ্গীদের বললাম Dusky eagle-owl বা মেটে হুতোমপ্যাঁচার ছবি তুলবো। নামটা শুনেই পেঁচার ছবি তোলার জন্য সবার ভিতর আগ্রহ বাড়লো । আমারও আগ্রহের ঘাটতি কম ছিলো না। এই পেঁচা আমাদের দেশে নাই। আমাদের দেশে যেটা পাওয়া যায় সেটা Fish owl বা মেছো হুতুমপেঁচা। রিক্সা থেকে নামলাম। দেখলাম বাবলা গাছে বাসা বানিয়ে ছানা ফুঁটিয়েছে। ছানার বয়সও কম নয়। যে কোন সময় উড়ে নিজের খাবার নিজে সংগ্রহের জন্য বাসা থেকে বের হয়ে যাবে।
 
কিন্তু সমস্যা হল বাবলা গাছে ডাল-পালা এমন ভাবে পেঁচাকে জড়িয়ে রেখেছে তাতে ফোকাস করতে গেলেই ডালে ফোকাস হয়। ডানে বা বামে সরে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। গাছটির সামনে যাবারও সুযোগ নেই। কারন আমাদের সামনে বিশাল বিল। আর বিলের ধারে উচু একটা ঢিবির মধ্যে বাবলা গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে খুব আফসোস হলো। জীবনের প্রথম এমন একটা পাখির দেখা পেলাম। অথচ ভাল ছবি নেবার কোন সুযোগ নেই। অনেক কষ্ট করে বাঁয়ে ডানে সরে কোন মতন পাখিটির ছবি তুললাম। ছবি দেখলেই আপনারা অনুমান করতে পারবেন যে, কেমন করে বাবলা গাছের ডাল-পালায় জড়ানো। 
Dusky eagle-owl বা মেটে হুতোমপ্যাঁচা
 
মেটে হুতোমপ্যাঁচার বৈজ্ঞানিক নাম: Bubo coromandus বা ভুমা প্যাঁচা। ইংরেজি নাম: Dusky eagle-owl. Strigidae (স্ট্রিজিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত Bubo (বুবো) গণের অন্তর্গত বড় আকারের প্যাঁচা। পাখিটি ভারত ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এরা বিস্তৃত, প্রায় ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের আবাস। বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা ক্রমেই কমছে, কিন্তু এখনও আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে।
পাকিস্তান, মধ্য ও উত্তর ভারত, দক্ষিণ নেপাল, আসাম এর পত্রপতনশীল বনে দেখা যায়; চীনের পূর্বাঞ্চলে যে সদস্যগুলো দেখা যায় তারা সম্ভবত এ উপপ্রজাতির অন্তর্ভুক্ত।
 
মেটে হুতোমপ্যাঁচা কানঝুঁটিওয়ালা বড়সড় নিশাচর পাখি। এর দৈর্ঘ্য কমবেশি ৫৮ সেমি, ডানা ৪০ সেমি, ঠোঁট ৪.২ সেমি, লেজ ১১.৫ সেমি ও পা ৬.৮ সেমি। এর পিঠ ধূসরাভ-বাদামি। অতি সরু ছিটে দাগ ও বিচ্ছিন্ন কালচে বাদামি ছিটে দাগ দেখা যায়। দেহতল ধূসরাভ সাদা। সূক্ষ্ম আঁকাবাঁকা দাগ রয়েছে। কাঁধ ও ডানা বাদামি। ডানায় পীতাভ ও সাদাটে তিলা থাকে। লেজের পালকে আড়াআড়ি ডোরা রয়েছে। চোখ ফিকে হলুদ। ঠোঁট নীলচে-সাদা। আঙুল ফিকে বাদামি ও নখর কালচে বাদামি। স্ত্রী ও পুরুষ পাখির চেহারা অভিন্ন। ছানা সাদা কোমল পালকে ঢাকা তুলতুলে বলের মত দেখতে।
 
মেটে হুতোমপ্যাঁচা পুরোন আমবাগান, তেঁতুলবন, বাগান ও ঘন বনের বসবাস করে। সাধারণত পানির ধারে এর বিচরণ বেশি। সচরাচর একা কিংবা জোড়ায় জোড়ায় থাকে। গাছে বসে ভূমিতে শিকার খোঁজে ও লম্বা নখর দিয়ে শিকার ধরে খায়। এর খাদ্যতালিকায় রয়েছে ছোট স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, বড় পোকা, জলজ পোকা ইত্যাদি। রাতে, বিশেষ করে ভোর ও গোধূলিতে এবং মেঘাচ্ছন্ন দিনে কর্মতৎপর থাকে। দিনে ছায়াঘেরা গাছে ঘুমায় ও সূর্যাস্তের একঘণ্টা আগে জেগে ওঠে। সচরাচর গম্ভীর স্বরে ডাকে: ও-ও-ও-ও-ও-ও-ওওওওউ। শীতকালে ও বর্ষাকালে বেশি ডাকে। নভেম্বর-এপ্রিল মাসে পানির ধারে বড় গাছের কোটরে এরা বাসা করে। এছাড়া শকুন, চিল ও ঈগলের পুরোন বাসায় সবুজ পাতার আস্তরণ দিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় ২টি।
Dusky eagle-owl বা মেটে হুতোমপ্যাঁচা ও ছানা।
এখানে দশ মিনিট সময় দিয়ে আবারও রওনা হলাম।
(চলবে)
0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ